মণ্ডপে আমাদের দাঁড়ানোর লাইন দেখেছেন? পুরুষের লাইন দেখেছেন, মহিলার লাইন দেখেছেন। আমাদের? আমরা ওই মহিলাদের লাইনেই দাঁড়াই। আমরা হলাম জ্বলন্ত উৎপাত বুঝলেন তো। ট্রেনে, বাসে, রাস্তাঘাটে আমরা হলাম জ্বলন্ত উৎপাত।
আপনি এসেছেন কেন? বই লিখবেন? ফেসবুকে লেখেন? ওই একই হল। আজকাল দেখি আমাদের নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে তবু। তবে কি জানেন, বেশিরভাগই ওই কৌতুহলের লেখা। আমাদের ইয়েটা কেমন? আমাদের কি দুটোই আছে? আমাদের সেক্স হয় কি করে? – এই সব কৌতুহল। আমাদের হয়ে আমাদের কথা কবে লেখা হবে বলুন তো, যেদিন আমরা লিখব। আমাদের জন্য লিখব। কারোর কৌতুহল মেটাতে নয়, নিজেদের কথা নিজেদেরই জানাতে। আপনি চা খাবেন?
ওই যে লক্ষ্মী, ওকে আমরা পাঁচশো বেড থেকে এনেছিলাম (পাঁচশো বেড, কল্যাণীর হাস্পাতাল), খানকীটা আঠারোয় পা দিল, এইডস বাধিয়ে বসেছে, ক'দিন ধরে ধুম জ্বর। বলছি হাস্পাতালে চ, তা মরবে নাকি এখানেই মরবে। কে ওর গু-মুত-বমি ঘাঁটবে? আর দুটোদিন দেখি, পূজো পেরোলেই টান মেরে হাস্পাতালে ফেলে আসব। চা নিন, কিরে মাগী, দুটো বিস্কুট দিয়ে যা!
আমাদের এখানে মুখ খারাপ করে কথা বলাটা চল, জানেন তো। অভ্যাস হয়ে যায়, নইলে বাঁচবেন কি করে? পড়াশোনা? হ্যাঁ করেছি তো, আমি নিজেই তো মাধ্যমিক পাশ। আমাদের বাড়ি ছিল বাগনানে। একটা দোকানে কাজ করছিলাম, তো সে দোকানীই নষ্ট করল আমায়, (হো হো করে হাসি) আপনি ভাবছেন হিজড়ার আবার নষ্ট হওয়া কি, সে তো আজন্ম নষ্টই। তারপর এসে বিরক্ত করে, বুক দেখা, নীচে কি আছে দেখা। ধুর, ভাবলাম এই করেই যদি জীবন কাটাতে হবে, তবে লাইনেই নেমে পড়ি। সেই শুরু হল। আপনি ‘হলদে গোলাপ’ পড়েছেন? হুম, আমিও পড়েছি। কিছু কথা আমাদের নিয়ে সত্যিই লেখা আছে সেখানে।
আমাদের আসলে রোজই উৎসব। বানিয়ে নিতে হয়, নইলে বাঁচব কি করে? আমাদের তো সমাজ বলতে কিছু নেই। আপনাদের সমাজে আগাছার মত থাকি। এই ধরুন না, গেল চার বছর আগে, আমরা আমাদের মত করে একটা পূজো করব ঠিক করেছিলাম, তাতে কত বাগরা, পুরুত বলল, আমাদের নামে নাকি সঙ্কল্প করা যাবে না। তারপর পাড়ার ক্লাবের ঝামেলা। ওরা বলল, আমাদের তো পূজো হয়ই তোমরা সেখানেই এসো, একই পাড়ায় দুটো পূজো পাশাপাশি, তাছাড়া তোমাদের ও ছক্কাদের পূজো কে দেখতে আসবে? পাড়ার বয়স্করা বললেন, পাড়ার নাকি অমঙ্গল হবে।
হ্যাঁ, আগের থেকে বদলেছে তো নিশ্চই, আমাদের রাজ্যে তো তবু ঠিক আছে, আপনি ওই বাসন্তীকে জিজ্ঞাসা করুন, বিহারে ওদের সাথে কি হয়? বিয়ের রাতে ওদের ভাড়া করে নিয়ে যায় নাচানোর জন্য, তাও পেছনটা খোলা রাখতে হয়, তারপর মদ খেয়ে তেনারা চড়াও হবেন ক্ষেতে, ঝোপেঝাড়ে নিয়ে গিয়ে... মারাও তো যায়... এ-ই তো মরতে মরতে বেঁচে পালিয়েছে...
পড়াশোনাতেই যে মানসিকতা বদলায় তাই শুধু নয়, আরো কিছু একটা লাগে জানেন তো... আগে ভাবুন বামুন-কায়েত এই সব জাতপাত নিয়ে কত ছুঁইছামারি ছিল, এখন কই? অতটা তো নেই। লেখাপড়ার থেকে বেশি শক্তিশালী আমাদের প্রয়োজন অনুভব করা। আমাদের নানা কাজে সুযোগ দেওয়া। সেটা যদিও পড়াশোনা শিখেই হবে, কিন্তু আমাদের কাজের সুযোগ না দিলে কি করে হবে? আমাদের নিজেদের প্রমাণ করতে হবে তো? ঠেলায় পড়লেই সব বাপ বাপ বলে মেনে নেয়।
ঘেন্নাটা? আমাদের একজন নার্সিং-এর কাজ করত। কিন্তু ওই যে ঘেন্না, তাকে অনেক মুমূর্ষুও ছুঁতে দেবে না, সে নাকি মরার পরে নরকে যাবে তবে। আমাদের জানাতে হবে, শরীরে যাই থাকুক, কলজেটা তো মানুষেরই মতন, কি বলেন? সেটা বুঝতে কি বইয়ের ছাপা অক্ষর লাগে বলুন?
অঞ্জলি? হ্যাঁ সকালে দিয়ে এসেছি, আমাদের ছক্কাদের জন্য এ পাড়ায় ওরা একটা আলাদা অঞ্জলির ব্যবস্থা করে। আমাদের ফুল নিয়ে যেতে বলে। আমাদের অঞ্জলির ফুলগুলো আগে একটা আলাদা ডালায় সাজিয়ে ফেলে দিত, আমরা খিস্তিখামারী করায় এখন বদলেছে... আপনাদের আর আমাদের সংসারটা খিস্তির বশে চলে... বুঝলেন... উঠছেন... আচ্ছা আসবেন বিজয়া করতে... হ্যাপি অষ্টমী! গার্লফ্রেণ্ড আছে... না আমাদের এখান থেকে ভাড়া নেবেন... একরাত পাঁচশো দিলেই চলবে... (আবার হাসি)... কিছু মনে করলে নাতো ভাই... ঠাট্টা করছিলাম... যাও আনন্দ করো...
আজ অষ্টমী