আশি ছুঁই ছুঁই মানুষকেও দেখেছি মাকে খুঁজতে। মায়ের অভাবকে অনুভব করতে। মামু ছোটোবেলায় একটা কার্টুন দেখত, ডোরেমন। মাঝে মাঝে আমিও দেখতাম। সেখানে একটা এপিসোডে দেখেছিলাম, ডোরেমন টাইম মেশিনে বা ওরকম কিছু একটা করে নোবিতার ঠাকুমাকে এনে দিয়েছে। নোবিতার বাবা অফিস থেকে ফিরে মাকে দেখতে পেয়ে কি ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল। অফিসের জামা পরেই মাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কত সুখদুঃখের কথা বলতে শুরু করল। তারপর বাচ্চা ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়ল কোলে।
এক বৃদ্ধ মানুষকে দেখতে গিয়েছিলাম। বললেন, জানো সারা রাত গতকাল যন্ত্রণায় ছটফট করেছি আর মাকে ডেকেছি। যেন মা এসে দাঁড়ালেই আমার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যেত।
এ হয়। খুব হয়। নিজেকে খুঁজতে গেলে উৎস বিন্দু তো সেই মা। আগে মা, পরে আমি। তারপর বিশ্বজগত। মা চলে যায়, কিন্তু মায়ের প্রয়োজন যে আর ফুরায় না। মাতৃত্বের আশ্রয়ের জন্য ব্যকুলতা যে আর ফুরায় না।
দুর্বল তো আমরা কম বেশি সবাই। কিন্তু নিজের দুর্বলতাকে মায়ের সামনে ছাড়া আর কার কাছে অমন সহজ স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করা যায়? মায়ের সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করতে হয় না আসলে। মা জানে বলেই জানাতে লজ্জা হয় না। কিন্তু তারপর? কার কাছে বলব আমার ভয় করছে, আমার দুর্বল লাগছে, আমার খিদে পাচ্ছে, আমার কষ্ট হচ্ছে। কাকে বলব?
মাতৃত্বের আশ্রয়ের অভাব নিয়েই মানুষ বড় হয়। বুড়ো হয়। সে অভাবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হয়। নাভির দাগের মত ব্যথা। বড্ড সত্য, বড্ড স্পষ্ট। একটু উপরের আবরণ সরালেই দগদগে।
বিদ্যাসাগর নাকি মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়েছিলেন। চোখ বেয়ে নেমে এসেছিল নির্বাক জলের ধারা। আমরা প্রত্যেকেই মায়ের স্মৃতির সামনে দাঁড়াই। দাঁড়াতেই হয়। ভার লাঘব করি। যতটুকু জুড়ে আমাদের মায়ের স্মৃতি ততটুকু জুড়ে আমরা বড্ড খাঁটি। বড্ড সহজ। বড্ড নিষ্পাপ। ওইটুকুই তো সম্বল। ওইটুকুই আশ্রয়। ওইটুকুতেই জীবনসংগ্রামের যাবতীয় যা কিছু রসদের বীজ।
নিজেকে খুঁজতে গেলে তাই এই সমীকরণেই দাঁড়াতে হয়, আগে মা, তারপর আমি, তারপর জগত, বাদবাকি যা কিছু। এই সমীকরণ ঠিক থাকলে সব ঠিক। সে আশ্রয় বাইরে হারিয়ে গেলেও ভিতরে থেকেই যায়। 'আমি' র আগে তার অস্তিত্ব বলেই থেকে যায়। তাকে মুছলে তো আমিই মুছে যাই।