Skip to main content

 

আশ্রমে এসে পৌঁছাতে দেরি হল। ভীষণ বৃষ্টিতে স্টেশানেই আটকে থাকতে হল প্রায় ঘন্টা খানেক। যা হোক, একটু বৃষ্টিটা ধরলে একটা টোটো করে আশ্রমের কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখি গোঁসাই টোটোতে উঠছেন। আমায় দেখেই একগাল হেসে বললেন, ওহে আর কয়েক মুহূর্ত দেরি হলে বৃথা অভিসার হত গো…..

বলেই টোটোতে একটা হাত রেখে, আরেকটা হাত অদ্ভুত ভঙ্গিমায় নাড়াতে নাড়াতে গেয়ে উঠলেন, “আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনা পারে এসেছি…”

গান থামিয়ে বললেন, উঠে এসো।

আমি আমার টোটোর ভাড়া মিটিয়ে গোঁসাইয়ের সঙ্গে টোটোয় উঠলাম। গোঁসাইয়ের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে আর সঙ্গে মনে হল তার মা। পরে জানলাম ছেলেটার পিসি। ওর মা বাবা মারা গেছেন কোভিডে। ছেলেটার ভার নিয়েছেন গোঁসাই। নাম রেখেছেন, মানিক।

======

আমরা যাচ্ছি কোথায় গোঁসাই?

গোঁসাই কোলের উপর রাখা ঝোলাতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, আমিও আজ অভিসারে চললাম গো। গতকাল রাতে গুরুদেবকে স্বপ্নে দেখলাম। সকালে উঠেই মনে হল, যাই। তোমার তাড়া নেই তো?

আপনি কী ওখানে থাকবেন?

আরে না গো…. সেখানে থাকার কিছু নাই…. আজ রাতের দিকেই চলে আসব…তুমি আশ্রমে থেকে কাল ফিরো?

======

তাহেরপুরে নেমে টোটোতে করে যখন গোঁসাইয়ের গুরুদেবের আশ্রমে নামলাম তখন বিকেল চারটের আশেপাশে।

কিন্তু আশ্রম কোথায়? গোঁসাই মূল রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। মাটি ভিজে ভিজে। বৃষ্টি হলেও কমই হয়েছে মনে হয় এদিকে। মানিক লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে। আমাদের পিছনে মানিকের পিসি, বিন্দু। ফোনে কথা বলছেন। কোনো বাড়ি কাজ করেন হয় তো। সেই নিয়ে বলছেন, আজ যাবেন না।

এ    কটা বড় দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। মানিক পিসিকে বলল, এসো এসো…এদিকে এসো……

এই বলে পিসিকে নিয়ে মানিক দীঘির বাঁধানো ঘাট ধরে নামতে শুরু করল। গোঁসাই সেদিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, বিন্দু আমরা এদিকে আছি…ওকে নিয়ে এদিকটায় আসিস।

গোঁসাইয়ের ডান হাতের তর্জনী একটা ঝোপঝাড়ের দিকে।

======

চারদিকে ঝোপঝাড়ে ভর্তি, তার মধ্যখানে একটা মন্দির। যথেষ্ট পুরোনো মন্দির। তবে নিত্য পুজো হয় দেখে বোঝা যাচ্ছে। মন্দিরে শ্রীগোবিন্দ আর রাধার বিগ্রহ।

গোঁসাই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন মন্দিরের ভাঙা চাতালে শুয়েই। আমি মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম।

গোঁসাই প্রণাম সেরে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এইখানেই আমার গুরুদেব থাকতেন। ওই যে অশ্বত্থগাছটা দেখছ, ওর নীচেই একটা ঘর ছিল। কাঁচা ঘর। এখন আর নেই।

কী নিস্পৃহভাবে বললেন, তবু ব্যথার একটা সুর লাগল গলায়।

“আশা তৃষা আমার যত ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত

মোর জীবনের রাখাল ওগো, ডাক দিবে কি সন্ধ্যা হলে”

গোঁসাই এই লাইনদুটো কয়েকবার ফিরে ফিরে গাইল। বড্ড আনমনা গোঁসাই আজ। কী যেন খুঁজছে।

বললাম, গুরুদেবের সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

গোঁসাই বলল, সে তো আকাশে, বাতাসে, জলে, মাটিতে, আলোয়। তার সম্বন্ধে বলব আর কী গো….বরং কান পাতো, শুনবে বাতাসে গুরুদেব কথা বলছেন….. এই.. এইখানে এসে বিকেলে বসতেন…. গ্রামের লোকজনেরাও সব আসত। উনি মুখে মুখে ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারতের গল্প বলতেন। শোনো…..

শোনার কান নেই আমার। কিন্তু তবু কান পাতলাম। পাখির ডাক। মানিকের গলার আওয়াজ। দূরে চাষীর গলার আওয়াজ। গরুর ডাক। শুনতে শুনতে ভুলেই গেলাম আমার কী যেন শোনার ছিল। হঠাৎ ঝোপঝাড় পেরিয়ে মানিককে আসতে দেখে সম্বিৎ ফিরল আমার। দেখি গোঁসাই মাটিতে উবু হয়ে বসে, কিছু একটা দেখছে।

কাছে যেতেই গোঁসাই বলল, এই ফুলটা দেখো। ঘাসফুল। কী নীল রঙ! আহা! যেন একবিন্দু আকাশ এসে মাটিতে পড়েছে। এই রঙ আমার ভীষণ প্রিয়।

ঝুঁকে দেখলাম নীল ফুল। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুটো পোকাও দেখলাম। দেখতে ভালো তো নয় মোটেই। গোঁসাই তাকালো আমার দিকে। বলল, চলো দীঘির দিকে যাই। গুরুদেবের স্নানের জায়গা।

======

দীঘির সিঁড়িগুলো ভাঙা ভাঙা। সাবধানে নামতে হল। গোঁসাই শেষধাপে বসল। হাঁটুমুড়ে।

বললাম, গোঁসাই তোমার ভাবনার গতি কীরকম আজ?

মানিক বলল, ভাবনা কী গোঁসাই দাদু?

গোঁসাই বলল, বড় কঠিন প্রশ্নে ফেললে হে মানিক গোঁসাই….

মানিক হেসে একটা লাফ দিয়ে উপরের সিঁড়িতে উঠে বলল, ধুর, আমি আবার গোঁসাই নাকি? আমার কি দাড়ি আছে?

সিঁড়ির একটা কোণে মানিকের পিসি চুপ করে বসেছিলেন। এইবার কথা বললেন। খুব ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাবনা কী গোঁসাই? সত্যিই বলো না….সে আমাদের শত্রু, না বন্ধু? মানুষকে তার ভাবনা ছাড়া আর কে এত জ্বালায়, এত কষ্ট দেয় বলতে পারো গোঁসাই? তোমার শ্রীগোবিন্দ যখন জানেনই যে যা ঘটাবার তিনি ঘটিয়েই রেখেছেন, তবে ভাবনাটা কেন দিলেন গোঁসাই…. সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিল যে সে…..

মানিকের পিসির গলা ধরে এলো।

মানিক কী বুঝল বলতে পারি না। কিন্তু সে এসে পিসির পাশে বসল। কোলঘেঁষে।

আমি গোঁসাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। গোঁসাই জলের দিকে তাকিয়ে। এই জলে নেমে স্নান করতেন গোঁসাইয়ের গুরুদেব। শ্রান্তি যেত নিশ্চয়ই। আমরা ভাবনায় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি গোঁসাই। যে ভাবনায় সুখের কল্পনার নেশা, সে-ই ভাবনাতেই দুঃস্বপ্নের তাপ। পুড়ে ছাই হচ্ছি গোঁসাই ভাবনায়। শাস্ত্রে বলে, আমরা নাকি কলি হত জীব। কলি মানে কি এই ভাবনার আগুন গোঁসাই? কোন দীঘির জলে এ জুড়াবে বলবে গোঁসাই?

======

গোঁসাই একতারাটা হাতে নিল। চোখ বন্ধ। একতারার টানে টুং টুং করে সুর বেজে উঠতে লাগল। সূর্যাস্ত হয়েছে খানিক আগে। দীঘির জলের রঙ কতবার বদলে বদলে গেল। মানিক পিসির কোলে মুখ গুঁজে। পিসির চোখের জল গাল গড়িয়ে শাড়ির উপর এসে পড়ছে। গোঁসাই কিছু বলছে না, শুধু একতারার তারে একটার পর একটা আঘাত করে যাচ্ছে। ধ্বনি উঠছে। এক ঝাঁক বক উড়ে গেল। শাঁখ বেজে উঠছে এদিকে ওদিক থেকে। সন্ধ্যা নামছে। গোঁসাই গাইছে….

“আশা তৃষা আমার যত ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত

মোর জীবনের রাখাল ওগো ডাক দিবে কি সন্ধ্যা হলে”.....