সৌরভ ভট্টাচার্য
20 April 2019
কতগুলো গোছানো শব্দে মাথাটা আর কয়েকটা নির্দিষ্ট প্রথাগত অভ্যাসে জীবনটা কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল শৈলেশ। হল না। যত দিন যেতে লাগল, বয়েস বাড়তে লাগল তত নিজেকে একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত মনে হতে লাগল। এক একদিন সকালে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কাটতে কাটতে নিজের চোখের দিকে তাকাতে সংকোচ হয়। কুণ্ঠা লাগে। চোখের ভিতর দিয়ে যে তার দিকে তাকিয়ে আর মাথার ভিতর যে - তারা যেন এক নয়। কখনও কখনও তো প্রতিদ্বন্দ্বী।
শৈলেশ এখন আটচল্লিশ। অবিবাহিত। যৌনতা, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ – এর মধ্যে কোনো যোগসূত্র কোনোদিন খুঁজে পায়নি। প্রতিটা বিচ্ছিন্ন, আলাদা আলাদা। মাথার মধ্যে ভাবার জন্য নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ের অভাব হয়নি। আবেগশূন্য হয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছে। মানুষের আবেগের মত এমন বেখাপ্পা সৃষ্টি সে আর দুটো দেখেনি। আবেগ মানে আদিম প্রবৃত্তি। ঈর্ষা, প্রতিশোধস্পৃহা আর কাম। এগুলো প্রাচীনতম। বাকিগুলো কৃত্রিম অনেকটা।
ভালোবাসা একটা আবেগজাত বৌদ্ধিক চুক্তি। কাম থেকে জৈবিক প্রেম জন্মায়। সুরক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে সামাজিক ভালোবাসার তাগিদ। প্রথমটা শৈলেশকে কোনোদিন বেসামাল করেনি। অভাবে পড়েনি বলা ভালো। দ্বিতীয়টার আকাঙ্ক্ষা কেন হয়নি কোনোদিন অনেক পরে বুঝেছে। যেন কয়েক সপ্তাহ হল বুঝেছে।
শৈলেশ মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। বলা ভালো অনুভব করতে পারে না। সে কোনোদিন গল্পের বই, বা উপন্যাস যে পড়তে ভালোবাসেনি তার একটা প্রধান কারণ হল এটাই, মেয়েদের এত কথা সেখানে, সে বুঝতে পারত না। তাদের আবেগের সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারে না। শারীরিক প্রয়োজনের বাইরে কি সম্পর্ক তৈরি হতে পারে, বুঝতেই পারে না। যদিও সে গে বা বাইসেক্স্যুয়াল কোনোটাই নয়। কিন্তু সামাজিক জীবনে একজন মানুষকে হয় একজন পুরুষকে অথবা নারীকে সঙ্গী হিসাবে মেনে নিতেই হয়, নিজের নিঃসঙ্গতার জন্য। কোন সমাজে কোনটা কতটা স্বীকৃত সেটা কথা নয়, কারণ শৈলেশ যে চাকরি করে সে যদি সমকামী হত তবে যে কোনো সুবিধাজনক দেশে সে প্রতিষ্ঠিত হতেই পারত। কিন্তু শৈলেশ তা করেনি। কারণ সে জানে সে পৃথিবীর সব দেশেই নিঃসঙ্গ। পশু পুষে সঙ্গ কামনা তার বিরক্ত লাগে।
অর্থাৎ শৈলেশের জীবনে মানুষ নেই, সঙ্গীত নেই, বই নেই, পশু নেই, সিনেমা নেই, থিয়েটার নেই, আড্ডা নেই। আছে সে অফিস আর কিছু প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। তবে তাকে নিয়ে এত ঘটা করে লিখতে বসলাম কেন? কারণ শৈলেশের সুইসাইড নোট। আমি পাই আমার এক বন্ধুর হাতে। সে কেসটার দায়িত্ব নিয়েছিল। কোথায় ঘটেছিল তার গভীরে গেলাম না, শুধু এতটাই বলি আমাদের কাছাকছিই এক শহরের ঘটনা।
“আমার মৃত্যুর জন্য প্রকৃতির খেয়াল দায়ী, অন্য অর্থে আমার কোষের মধ্যে প্রবাহিত আমার জিনপ্রবাহ, যা আমি বংশানুক্রমে পেয়েছি। আমার বাবা আত্মহত্যা করেন, ঠাকুরদার ভাই আত্মহত্যা করেন। যদ্দূর জানি তার আগের প্রজন্মেও আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের পরিবারে আছে। আমার বাবার আত্মহত্যার ঘটনাটা বেশ মনে আছে। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বাবা কলেজে ইতিহাস পড়াতেন, মা সরকারি হাস্পাতালের চিকিৎসক ছিলেন। কোনোদিন বাবা মায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অশান্তি হতে দেখিনি। পঁচিশে ডিসেম্বর ভোরে বাবার মাথা কাটা দেহ রেললাইনের পাশে পাওয়া যায়। আমায় মৃতদেহটা দেখতে দেওয়া হয় না। অনেক পরে আমি বাবার সুইসাইড নোটটা দেখি, “আমার আর ভালো লাগছিল না”। আমার কথাটা পড়ে খুব শান্তি লেগেছিল, আনন্দ লেগেছিল। যেন এই কথাটাই আমি বলতে চাইছি অনেকদিন ধরে। ততদিনে মা তার কলিগকে বিয়ে করেছেন। আমি দাদুদিদার সাথে থাকি। পড়াশোনার জন্য কাশ্মীরে যাইনি, মায়ের যেখানে পোস্টিং ছিল। মা চাকরি বদলেছিলেন। পরে মায়ের কাছে শুনি, মা বাবার মৃত্যুর জন্য আপ্রাণ অপেক্ষা করছিলেন, কারণ ডিভোর্স দিতেও এমন একটা মানুষকে তার বিবেকে বাধছিল। তাই খবরটা পেয়েই যখন মা কেঁদে ফেলেছিলেন, প্রথমে ভাবেন শোকে কাঁদছেন, পরে বুঝতে পারেন আসলে সেটা আচম্বিতে পাওয়া মুক্তির কান্না। এই কথাটা শুনেই আমার মনে হয়েছিল আমার বিয়ে করা ঠিক হবে না। কারণ আমি বাবার মত, আমি বাবার মত বাচ্চাও ভালোবাসি না। হ্যাঁ আমি আমার বাবার মত অনেকটা। বাবা আমাকে তার স্টাডি রুমে দেখলে বিরক্ত হতেন। আমি বুঝতে পারতাম। আমায় শুধু স্টাডিরুমে না, মায়ের অনুপস্থিতিতে আমায় দেখলেই বাবার মুখটা কিরকম একটা অস্বস্তিতে ভরে উঠত। আমি আগে ভাবতাম রাগ। পরে বুঝলাম আসলে ওটা রাগ নয়, একটা অসহায়তা। আমি একটা বিড়ম্বনা তার কাছে। পরে এটা আমারও হত যখন আত্মীয়ের কোনো বাচ্চা আমার কাছাকাছির মধ্যে আসত। আমার মনে হত সেটা একটা পশু। অনেকটা পরিণত মানুষের মত শরীর। কিন্তু যেন মানুষ নয়, একটা উন্নত পশু। যার অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যাকে ঘিরে অনেকের অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আমার কৈশোর থেকে যৌবন দুটো সঙ্গীই ছিল – হস্তমৈথুন আর জ্যামিতি। প্রথম প্রথম মনে হত ইতিহাস আমার সবচাইতে প্রিয় বিষয়। মাধ্যমিকে হায়েস্ট পেয়েছিলাম ইতিহাসে, একশোতে আটানব্বই। কেউ পায়নি, স্কুলে রেকর্ড। সবাই বলল বাবার জন্য। আমি আটানব্বই পাওয়ার পর বুঝলাম আমি সব চাইতে ঘেন্না করি ইতিহাস। বাবা আমার জন্য ইতিহাসের কয়েকটা বিখ্যাত বই কিনে এনে দিয়েছিল। আমি গঙ্গায় ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। আমার মনে আছে সেইদিন রাতে আমি আটবার মাস্টারবেট করেছিলাম। মনে হয়েছিল সব শেষ হয়ে যাবে সেই রাতেই।
সুইসাইড নোট কারো আত্মজীবনী হয় না। এটাও নয়। আর আমার আত্মজীবনী লেখার মত কিছু নেইও। আমার জীবন ধারাবাহিক বিষণ্ণতার একটা সুর। আসলে আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না। নিজেকেও নয়। নিজের উপর আমার একটা তীব্র আসক্তি ছাড়া আর কিছু নেই। আমি নিজেকে নিয়ে একটা গুহার মধ্যে কাটিয়ে দিলাম সারাটা জীবন, নিজেকে ভালোবেসে নয়, নিজের উপর তীব্র আসক্তিতে। নিজেকে শুষে খেতে খেতে ছিবড়ে করে ফেলেছি, তবু আসক্তি শেষ হল না। হবেও না। পুরো পৃথিবীটা আমার দাঁড়াবার একটা পাদানি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আমি এমনটাই আশা করেছিলাম। আমি তার উপর দাঁড়িয়ে নিজেকে ভোগ করব। এক একটা নারী শরীর তীব্র আসক্তিতে চেটেপুটে দেখছি। মেয়েদের আমি আলাদা করতে পারি না। মেয়েদের কোনো ব্যক্তিত্ত্ব হয় বলে আমি বিশ্বাস করিনি। পুরুষেরও হয় না। আসলে ব্যক্তিত্ত্ব কথাটাই মিথ্যা ছিল আমার কাছে। আমার জগতে একটাই শব্দ ছিল বেঁচে থাকার – আসক্তি। মাঝে মাঝে কেটে যেত, ক্ষীণ আলো বাইরের জগত থেকে আমার গুহাটায় এসে ঢুকত। আমি বুঝতে পারতাম আমি অসুস্থ। আমি চিকিৎসার জন্য গিয়েওছিলাম। লাভ হয়নি। আসলে মেডিক্যাল সায়েন্স এখনও আসক্তি তাড়াবার পথ জানে না। সে যাকে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসর্ডার বলে, আমি তা নই। আমার তা নেই। আমি সম্পূর্ণ সচেতন সব কিছু নিয়ে। আমি প্রকৃতির একটা উদ্ভট খেয়াল। আমি প্রকৃতির অসুস্থতা নই, আমি সমাজের অসুস্থতা। কিন্তু সমাজ ছেড়ে আমি যাব কোথায়? আমি পোশাক, চাষের খাবার, পিচ ঢালা রাস্তা, বৈদ্যুতিক আলো, ফোন, ফ্রিজ, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদিতে অভ্যস্ত তো। জঙ্গলে থাকার ইমিউনিটি কই আমার? তাই সরে গেলাম। আমি শুধু জানিয়ে গেলাম, আমি অসুস্থ ছিলাম না। আমি প্রকৃতির খেয়াল ছিলাম। আগামী প্রজন্ম যেন কোথাও আমার মতই হবে, প্রেমহীন চূড়ান্ত আসক্ত নিজের শরীরে, আবেগে। সাবধান!”