Skip to main content



---
রত্না সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চে বসে। বিকাল পাঁচটা। সদ্য দূর্গাপূজো গেল। লক্ষীপূজোও। রত্নার ছেলে বউ নাতি নাতনি কেউ আসেনি। ওরা আসবে না, বউমা বলেছে (নিজেও চায় না)। “কনকা” বৃদ্ধাশ্রমটা তাদের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার হবে। রত্না আশা করে না আর।
রত্না আজ অবধি কাউকে সহ্য করতে পারেনি। বিয়ে হওয়ার আগে এতটা ছিল না, তবে ছিল। রত্নার বাবা তেমন রোজেগেরে ছিল না। জুটমিলে কাজ করত। পাঁচটা ভাইবোন। সে বড়। বহু ত্যাগ করতে হত। কোনোদিন তার নিজের জন্যে কোনো নতুন জামা হয়েছিল বলে তার মনে পড়ে না। সব ভাগ করে নিতে হত তার পরের ছোটবোনের সাথে – কুহেলী। মারা গেছে। তিন বছর হল। ব্রেস্ট ক্যানসারে।
বাকি তিনটে ভাই। সবার সংসার। আলাদা আলাদা। তার নিজের সন্তান বলতে ওই রমেশ। কত হবে বয়েস এখন রমেশের, তিপান্ন।
রত্না গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বসে। পশ্চিমে সূর্যাস্ত হবার প্রস্তুতি। যেটা বলছিলাম। রত্না কাউকেই সহ্য করত পারত না। তার স্বামী, মানে হরেকৃষ্ণকে দেখলেই তার বাবার মুখটা মনে পড়ত। তার থেকে বয়সে চোদ্দ বছর বড় ছিল। ইলেকট্রিক ডিপার্টমেন্টে ক্লার্কের কাজ করত। খুব অলস আর কামুক প্রকৃতির ছিল। কোনো কম বয়েসী কাজের লোক রাখলেই পিছনে ছুঁকছুঁক করে লেগে থাকত। অসহ্য।
টুবান (ছেলের ডাক নাম) হওয়ার পর, জোর করে স্কুলের চাকরী নেয় একটা। তার প্রথম প্রথম টুবানকেও অসহ্য লাগত। অবিবাহিত মেয়েদের দেখলেই হিংসায় বুকটা জ্বলে যেত। মনে হত কি পেল? একটা বিশ্রী চেহারা হল মাঝখান থেকে।
ধীরে ধীরে মানতে শুরু করল। তবে শুধু আপোষ। বিরক্তিটা ভিতরে ভিতরে শিকড় প্রসারিত করে চলছিলই। কতটা সেটা টের পেল টুবান যেদিন প্রথম পারমিতাকে তার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে এলো। তদ্দিনে তার স্বামী গত হয়েছেন। এটাকে রত্না একটা সৌভাগ্যই মনে করে। মানে স্বামীর মৃত্যুটাকে। স্বামীর মৃতদেহ যখন বাইরে শোয়ানো ছিল, রত্নার মনে একটা দারুন উল্লাস হচ্ছিল। সেই প্রথম মনে হচ্ছিল বাড়িটা তার। কোনো সংকট নেই তার জীবনে আর। সেই কয়েক বছর সত্যিই রত্না ভালো ছিল। ছেলে দু’বছর পর বাইরে পড়তে চলে গেল। পুরো বাড়িটাতে সে একা। পাড়া প্রতিবেশী কাউকে সহ্য হত না। স্বামীর কোনো ছবি রাখত না ঘরে। অসহ্য লাগত।
টুবানের বিয়ের পর শুরু হল তুমুল অশান্তি। ছোটখাটো কিছু নিয়েই বাধত। মেয়েটা খারাপ না, ‘কিন্তু আমার মন তো বিষাক্ত’, রত্না মনে মনে আওড়াতো। রত্না আসলে অশান্তি করার ছুতো খুঁজত। পারমিতাকে হয়রান করে তুলতে না পারলে তার হাত পা কেমন নিশপিশ করত। ছেলেটাকেও অসহ্য লাগতে শুরু করল আবার নতুন করে।

 


---
একটা মানুষকে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না করলে থাকা যায় তার সাথে! আর একটা মানুষের একটাও সদগুণ নেই? তা কি করে হয়? পারমিতার আশ্চর্য লাগে। পারমিতা যৌথ পরিবারে মানুষ। সংসারে এটাসেটা নিয়ে খিটিমিটি তার কাছে নতুন কিছু না। তা বলে ইনি তো তা করেন না। ইনি যেন কেমন। যখনই টুবানের সাথে আলাদা কথা বলছে, তিনি ঢুকে পড়বেন। চায়ের জল বসালে দু’বার চিনি দিয়ে দেবেন, পরে বলবেন, ‘ভুলে গেছি’। মুখে হাসবেন, কিন্তু চোখ দিয়ে পরখ করবেন সে কতটা বিরক্ত হচ্ছে, পারমিতা যতটা বিরক্ত হবে তিনি ততটা খুশী।
পারমিতার বান্ধবীরা এলে বিরক্ত হন। পারমিতা গান শুনলে উনি ফুল ভল্যুমে টিভি অন্‌ করে নিউজ দেখবেন। আরো মুশকিল হল, পারমিতা যে শাড়ী কিনবে, উনিও সেইরকম বা কাছাকাছি কিছু একটা কিনে আনবেন। পারমিতা বিউটি পার্লারে গেলে উনি সাথে যাবেন। ‘আরে এটা করিস না বাজে দেখাবে’, ‘আরে চুলটা এত ছোট করলি?’... ইত্যাদি নানারকম খুঁত ধরে ধরে অতিষ্ঠ করতে থাকবেন।
পারমিতা বহুবার টুবানকে বলতে চেষ্টা করেছে। সে যায় না। মায়ের কাছে বড় একটা ঘেঁষে না। কি আশ্চর্য, সেই মানুষ স্কুল থেকে রিট্যায়ার করার পরদিনই বৃদ্ধাশ্রম চলে গেলেন। আগে থেকেই সব ঠিক করে এসেছিলেন। কারোর কথা শুনলেন তো না-ই, উপরন্তু তাদের সেখানে দেখা করতে যেতেও বারণ করলেন। পারমিতার মাকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করে গেলেন। তিনি নাকি মেয়ে মানুষ করতে শেখেন নি। পারমিতা ঠিক করেছে সে কোনোদিন ওই মেয়েমানুষটার মুখ দর্শন করবে না। টুবান দু’একবার দেখা করতে গিয়েছিল, উনি দেখা করেননি।

 


---
সন্ধ্যে হব হব। রত্না এখনো বসে। এখানেও কারোর সাথে কথা বলেন না। কাউকেই সহ্য হয় না তার। ঘড়ি দেখলেন, ছ’টা। টুবান একটা মোবাইল কিনে এনে দিয়েছিল, টান মেরে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছেন। মানুষের গলা অসহ্য লাগে এখন। চেনা লোকের তো আরোও।
গঙ্গার ওপারের মন্দিরে আরতি হচ্ছে। কাঁসরের আওয়াজ আসছে। মন্দিরাদি ভজন গাইছেন। নিশ্চয় সব বুড়োবুড়িগুলো জড়ো হয়েছে পূবদিকের বারান্দাটায়। ওনাকে জোর করে নিয়ে গেছে ক’বার ওরা। বিরক্তিকর লেগেছে। ওসব ভাঁড়ামো ভালো লাগে না তার। ঈশ্বর নিয়ে কোনোদিন ভাবনা-চিন্তা করেন নি। আজও করার প্রয়োজন দেখেন না। তিনি থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি, কিছুই খুব একটা পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না তার।
মাথার মধ্যে কেমন একটা গুমগুম আওয়াজ হয় আজকাল। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। হাঁটতে গেলে পা’টা টলে যায়। সেই সময় চুপ করে বসে থাকেন। এখন ওরকম কিছু একটা হচ্ছে কি? চন্দননগরের এই দিকটায় বেশ ঠাণ্ডা পড়তে শুরু হয়েছে। কলকাতায় নাকি এখনো গরম এই সন্ধ্যেতে, আভাদেবীর বড়ছেলে নাকি বলেছে। যাকগে। কি হবে, একটু না হয় সর্দিকাশি। রোগকে খুব একটা পাত্তা দেন না। তার স্বামীর যখন কি একটা স্কিন ডিজিজ হল, সবাই বলল সাবধানে থাকতে। তিনি থাকেননি। নিজের হাতে সব করেছেন। ভালোবেসে না। চ্যালেঞ্জ নিয়ে। জিতেছেনও। স্বামী মারা গেল ওতেই। কিন্তু উনি থাকলেন সুস্থ, কিচ্ছু হয়নি।
মাথার মধ্যে ঝিমঝিম ভাবটা বাড়ছে। গুমগুম করে কি একটা যেন পেটাচ্ছে। ইঞ্জেকশানটা দিতে বলব? ভাবলেন কিছুক্ষণ। থাক, দেখি না আরেকটু, যদি নিজের থেকে কমে।
কেন বাঁচলেন এতবড় একটা জীবন? এইটা তার কাছে অসহ্য লাগে ভাবলে। আয়নার সামনে দাঁড়ান না। কোনোদিনই পছন্দ করতেন না, এখন তো নিজের ঘরেও আয়না রাখেন না। নিজেকে একটা জন্তু মনে হয়। শরীরের অনুভূতি খুব একটা বেশি ছিল কি? মনে পড়ে না। একবার একটা ভুল করে ফেলেছিলেন। তাদের বাড়িতে যে লোকটা ইলেকট্রিকের কাজ করতে আসত। তার সাথে একবার একটা গোলমাল হয়েছিল। ভালোবেসেছিলেন? না। সেটা সম্পূর্ণ শারীরিক ছিল। কয়েক মাসের মোহ। কেউ টের পায়নি। স্বামী তো নয়ই, সে একটা মাংসের তাল ছিল।
তবে সে নিজে কি? সেও কি একটা মাংসের তাল নয়? কি আছে তার? না প্রেম, না ভক্তি, না স্নেহ, না মায়া। কিচ্ছু না।
হঠাৎ বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার হন্তদন্ত হয়ে এলেন, পিছনে মন্দিরাদি, আভাদি, মিত্রবাবু, ঘোষবাবু। কি হল?
“টুবানের ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন আশা খুব কম।” ম্যানেজারের গলা কেঁপে গেল।
রত্না মুখ তুলে বলল, “মারা গেছে, তাই তো?” কঠিন গলাটার প্রত্যেকটা শব্দ তীরের মত বিঁধল প্রত্যেকের কানে। আভা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “রত্না ওঠ। তৈরি হ। আমি গাড়ি ডাকতে বলছি।” বলে সে ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকালো। ম্যানেজার ইঙ্গিতটা বুঝে বলল, “আচ্ছা।” চলে গেল প্রায় ছুটতে ছুটতে।
রত্না বলল, “তোমরা যাও। আমি আসছি।” তার মাথার মধ্যে গুমগুম হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে। কান্না পাচ্ছে না বিরক্ত লাগছে? বুঝছে না। পারমিতার মুখটা মনে করার চেষ্টা করল, পারল না। নাতির মুখটা, পারল না। ছেলের মুখটা, পারল না। স্বামীর মুখটা, আবছা আবছা। কার মুখটা স্পষ্ট হচ্ছে? তার বোনের। কুহেলী, তার ছোটবোন। তার হাত ধরে কি বলতে চাইছে? “দিদি আসবি? তোর নতুন শাড়ীটা দিবি? এই দিদি আয় না রে... আমার ভয় করছে... এই দিদি জামাইবাবু, টুবান সবাই আসবে বলেছে, তুই নতুন শাড়িটা নিয়ে আয় নারে... এই দিদি দি...” রত্নার মাথার মধ্যে লক্ষ হাতুড়ি পেটানোর শব্দ। চোখের সামনে মিলিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা, আকাশ, চাঁদ, তারা... তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে... ইঞ্জেকশানটা আনবে?... তার বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ব্যাথা করছে... হাত পা অবশ হয়ে আসছে...।
ম্যানেজার যখন এলো, তখন বেঞ্চে একটা নিথর ঠাণ্ডা দেহ।