গোঁসাই বসে দীঘির ধারে। গুনগুন করে গান ভেসে আসছে, “গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা নাই তরণী পারের... বাঞ্ছা করি দেখব তারে কেমনে সেথা যাই রে…”
গোঁসাই, বসি একটু?
গোঁসাই চোখের ইশারায় বলল, বসো।
যোজন যোজন ফাঁকা মাঠ। দীঘির উপর মেঘের ছায়া। কয়েকটা হাঁস নামছে জলে। জলের উপর তরঙ্গ খেলে গেল।
গোঁসাই, পাই না কেন?
ভাবো বলে…
না ভাবলে কি পায় মানুষ?
গোঁসাই মুখের দিকে তাকালো। চোখের কোনে দুষ্টু হাসি। গোঁসাই বলল, ভাবের জিনিস ভাবলে মেলে না ভাই... বুদ্ধি বিচারের জিনিস কি সে?
বুদ্ধি বিচার কি ফেলনা গোঁসাই?
গোঁসাই জলের দিকে তাকিয়ে। বাতাস বইছে। জোলো বাতাস। গোঁসাই বলল, বুদ্ধি-বিচার জাগে কিসে?
কিসে জাগে?
জাগে দরকারে, স্বার্থে, কুতুহলে….. তোমায় যদি বলি, ভাবো তো... তুমি অমনি জিগাবে, কি নিয়ে? মানে ভাবতে একটা বস্তু লাগে... তাই তো?
তা তো নিশ্চয়ই…
মানুষের মনে কুতুহল জাগে... মেঘ কেন কালো... জলের মধ্যে কি তত্ত্ব… বৃষ্টির জল কেন পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ধায়... হাজার একটা জিনিস নিয়ে মানুষের কুতুহল জাগে... মানুষ বুদ্ধিকে খাটায়... মন্থন করে নিজের মধ্যে... তত্ত্বের পর তত্ত্ব খুঁড়ে সূত্র পায়... সে সূত্র বাইরে পায় না নিজের মধ্যে নিজের যুক্তিতে পায়?
নিজের মধ্যে যুক্তিতে পায়…
হ…. সূত্র পাওয়া যায়... জগতকে নিজের বোধের বাঁধনে বাঁধার... কিন্তু বোধের পারে যে... তারে বাঁধবে কিসে?... তাই বলি বুদ্ধি-বিচারের নাগাল কি সে? সেটার নাগালে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য খানিক... যত খোঁজো আরো রহস্য... আরো খোঁজো আরো রহস্য... মানুষ মজা পেয়ে যায়... জানার উত্তেজনায় মজে... সুখ পায়… দৌড়... দৌড়... আরো জোর দৌড়...
তবে?
তবে আর কি? এও খেলা... তবে এই খেলার মধ্যে ধরা দেয় কি সে?.. তার জন্য লাগে হৃদয়ের ফাঁদ.... হৃদয় জাগে কিসে?
কিসে গোঁসাই?
কান্নায়... শূন্যতায়... সব ফাঁকা যখন... তখন। চারদিকে সব আছে, কিন্তু সে সবের মধ্যে সুতো গাঁথার সুতো গেছে হারিয়ে... তখন বুকের মধ্যে জাগে হৃদয়। তার আগে হৃদয়ের উপরে থাকো ‘তুমি’..... নিজের “আমি” ঘিরে…. তখন ‘আমি’ ভিতে সুখ-দুঃখের ঘর.....সে ভিত নড়লে জগত আঁধার... যা মনে হয় অনড় অচল... সেই ভিতই হঠাৎ দুলে ওঠে... ভাঙব ভাঙব করে... কখনও সখনও ভেঙেও পড়ে... হৃদয় জেগে ওঠে বিস্ময়ে…
এমন দুর্দিনে বিস্ময় জাগে গোঁসাই?
জাগে গো... সেই তো আসল বিস্ময়!.. আমার ‘আমি’-র বাইরেও আমার অস্তিত্ব আছে... এ অনুভবের এক পরম বিস্ময় জাগে প্রাণে... প্রাণ যেন আগে আভাসে জানত... আজ জানল স্পষ্ট... অনুভবে... আঘাতে। তাই এ আঘাতের বিস্ময়... শোকের বিস্ময়... বুদ্ধি যেমন জাগে প্রয়োজনে, কুতুহলে, স্বার্থে... হৃদয় তেমন জাগে আপনিই... বিনা দরকারে... বিনা কুতুহলে... বিনা স্বার্থে…
বৃষ্টি এলো ঝেঁপে। গোঁসাই উঠল না। গলা ছেড়ে গান ধরল…
“পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেতো দূরে।
সে আর লালন একখানে রয়, – তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথা একঘর পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”
হাঁসগুলো জলের মাঝখানে। দীঘির জলের উপর বৃষ্টির তরঙ্গ। তরঙ্গ থামে কই গোঁসাই?
গোঁসাই শুনল না। গোঁসাই আর শুনবে না। বুদ্ধি-বিচারে নাগাল পায় না যে দেশ, সে দেশে যাই কি করে গোঁসাই? আমারও যে পড়শির সঙ্গে দেখা করার আছে গোঁসাই!
আমি ফিরছি। আষাঢ়ের অঝোর ধারায় মাঠঘাট সব অস্পষ্ট। কানে আসছে গোঁসাইয়ের সুর। এই সুরই আমার নাবিক গোঁসাই। সুরই আমার আলো। আমার চিত্তের পশম। তুমি গাও গোঁসাই। আমি এই দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনি। রাস্তার উপরের মাটি বৃষ্টির জলে গলে গলে ভেসে যাচ্ছে, যে মাটি কিছুক্ষণ আগেও ছিল কঠিন ঢেলা, এখন তার উচ্ছ্বাস দেখে কে! সে জানলোও না কোন খাল-বিল-নদী-সমুদ্রের জল ভরা মেঘের করুণায় সে ভেসে যাচ্ছে। আমাকেও গলিয়ে নাও গোঁসাই। আমায় ভাসিয়ে নাও। আমিও অপেক্ষায়... আমারও মাথার মধ্যে সুরের মেঘ জমছে... বুকের ভিতর বৃষ্টি নামবে... আমি অপেক্ষায়... গান থামিও না গোঁসাই... আমিও অপেক্ষায়।