Skip to main content

পাখাটা ঘুরছে। ফুল স্পিডে না। এসি আঠাশে করা। ঠাণ্ডা লেগেছে অলোকেশের। ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। ঠাণ্ডা লাগলে হাঁপানিটা বাড়ে। সিগারেটটা ছাড়ো অলোকেশ!

মঞ্জু সোফায় বসে। সাড়ে তিনটে। রাত। ঘরের মধ্যে মিষ্টি গন্ধ। কাবেরীর গা থেকে আসছে হয় তো। কাবেরীর চুলগুলো নীচে চাদর থেকে ছড়িয়ে মেঝেতে লুটিয়ে। অলোকেশের ডানহাতটা কাবেরীকে বেষ্টন করে। কাবেরীর গলার কাছে কালশিটে দাগ। পিঠে পাছায় কামড়ের দাগ। থাইতে কালশিটে। কোন দাগটা ভালোবাসার, কোন দাগটা না-ভালোবাসার বুঝতে পারো কাবেরী? আমার গুলিয়ে যেত। এখনও যায়? আমিই কি আমাকে ভালোবাসি? আমার সব গুলিয়ে যেত কাবেরী শেষের দিকে।

মঞ্জু ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। হাতটা লোহার রডে রাখতেই টাটিয়ে উঠল রেডিয়াস-আলনা…. হাতের দুটো হাড়। মোচড়ের দাগ। ভালোবাসা না অতি-ভালোবাসা? কি চেয়েছিল সে জীবনে? ভালোবাসা, না অতি-ভালোবাসা?

=====

শাঁখাপলা অক্ষুণ্ণ আছে। রমা হাতটা দেখল। সেফটি ট্যাঙ্কে তিনটে বছর। শরীরের সবটুকু ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে ভালোবাসার দাম দিয়েছে। এখন শুধু কঙ্কাল। ওরা যখন সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে গাড়িতে তুলছে, এক পশলা বৃষ্টি এসে পড়ল মুখে। হ্যাঁ, খুলিতেই। চোখের কোটরে ঢুকে গেল দুই বিন্দু আকাশ ধোয়া জল। পাশে বসে কোনো পুলিশ বলছিল, এবারে বৃষ্টি হচ্ছে না….. শুধু নাকি মেঘ জমছে…. এবারে নাকি ভয়ংকর গরম ছিল…..

আমি কি করে জানব? শুনেছি তলা থেকেই মহামারী নাকি গেছে। শুনেছি তলা থেকেই মেয়েরা অনেক পরীক্ষায় নাকি এগিয়ে। নাকি বড় বড় চাকরির পরীক্ষাতেও আছে এগিয়ে। ভালো লাগছে শুনে। না, আমি তেমন কিছু করতাম না। কোথায় সমস্যা ছিল হয় তো জানতাম। জানার থেকে বেশি বিবশ মানুষ ভাগ্যের কাছে। ভাগ্য মাত্র ইচ্ছার জোয়ারভাঁটা। কোন খাতে বইবে তুমি আমি কে ঠিক করার? সংসার কার নিয়মে চলে? সংসার চলে না। গোল গোল ঘোরে। আমার ঘুরতে ইচ্ছা করত না। আমার নাকি অনেক দোষ ছিল। আমি নাকি ভালো ছিলাম না। শুনেছি রতন পুলিশের কাছে বলেছে। ও নাকি ভালোবাসত আমায়। হবেও বা। আমি বুঝিনি। ভালোবাসার মানুষ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে এত তাড়াতাড়ি খুনী হয়ে যায় কিভাবে? শুনেছি কোন মেয়ে… খুব নাকি শিক্ষিত…. কি জানি….. শিক্ষা না… ও তো বাইরের জিনিস…. ভালোবাসা বুকের ভিতরের গুহার জিনিস…কারো গুহায় শক্তিশালী রাক্ষস… কারো গুহায় দুর্বল রাক্ষস…. আমারটা মাতাল ছিল…. কখনও দুর্বল… কখনও……

======

মঞ্জু ভিজছে। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। মৌসুমি বাতাসে ভিজছে। বাতাসেও ভেজে মানুষ, যদি ভিজতে জানে। "ম্যায় তো মরকর ভি মেরি জান…তুঝে চাহুঙ্গা…." ... মেহেদি সাহেব। মৃত্যুর পরেও ভালোবাসতে চাওয়া…মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে চাওয়া…. স্বর্গীয় সুখে…. এও কি অতিচাওয়া না? মঞ্জু কি চেয়েছিল? ধরাবাঁধা জীবনের ছক না। সে রাস্তায় তো অনন্তকাল ধরে হেঁটেইছে মানুষ। সে চায়নি। সে মিনমিনে ভালোবাসাও চায়নি। চেয়েছে ভাবের জোয়ারতোলা ভালোবাসা। মাঝে মাঝে বেসামাল হয়েছে। সে তো হতেই হয়। বাড়ির সামনের এঁদো পুকুরে স্নান করা আর শ্রাবণের উত্তাল সমুদ্রে স্নান করার অভিজ্ঞতা কি এক?.... বেসামাল হয় না মানুষ? হাত পা ভাঙে না? ওটুকু তো স্বীকার করে নিতেই হয়।

কাবেরী জল খেতে উঠল বোধয়। নাকি টয়লেটে যাচ্ছে? হ্যাং ওভার কাটেনি এখনও। টলছে। টয়লেটে যাচ্ছে। কাবেরী টয়লেটে ঢুকে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে। পোশাকটা খুলে ফেলল। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে। ফোঁপাচ্ছে, না গোঙাচ্ছে? সারাটা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাছার কালশিটেটা নতুন। কামড়টাও টাটকা। একটা ওয়েব সিরিজের একটা ডায়লগ মনে পড়ছে মঞ্জুর…. "কুত্তি বন… কুত্তি বন….."

কাবেরী বসে পড়ল। হাঁটু মুড়ে মাথাটা হাঁটুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। হাতটা কাঁপতে কাঁপতে শাওয়ারের নবটা ঘোরালো। ক্লক ওয়াইজ। জলের সহস্রধারা নামছে। জল মানে সান্ত্বনা। হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে দেওয়াও সান্ত্বনা। মানুষ মনের এক এক অবস্থায় এক এক পশ্চারে বসে শোয় দাঁড়ায়। প্রতিটা পেশী হাড়ের জয়েন্ট বোঝে মন তাকে কেমনভাবে চাইছে। তুমি বোঝো না কেন অলোকেশ? তোমার মধ্যে কি আছে যে তোমায় মাঝে মাঝে এমন নরপিশাচ বানায়? তোমার পড়াশোনা… তোমার সামাজিক উচ্চ অবস্থান… কেউ তো আটকাতে পারে না….. তোমার পেশী… তোমার হাড়ের জয়েন্ট জানে তুমি কি চাও…. তোমার স্নায়ুতে যে বিষ সে ভালোবাসা নয়…. অথচ তুমি চাইলে কি ভীষণ ভালোবাসতে পারো…. নাকি ওগুলো নেশা তোমার?.... তুমি শুনতে পাচ্ছ না কাবেরীর কান্না….. আমার কান্নাও যেমন তোমায় আমোদ দিত হয় তো….. তোমার স্নায়ুতে বিষ…. আমি সে বিষ সরিয়ে তোমায় ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলাম…. আরো ভালোবাসা…. অতি-ভালোবাসায় উন্মাদ হতে চেয়েছিলাম…. জীবনটাকে নিংড়ে সবটুকু সুখ উজাড় করে পেতে চেয়েছিলাম…. আমার ভাষায়…. আমার ছন্দে তাদের ধরতে চেয়েছিলাম…. কিন্তু আলোকেশ বিষাদের যে এমন নেশা আছে….. কেউ তো বলেনি আমায় আগে…. এই যে আমি, তোমায় আমায় মিলিয়ে….. এই যে আমি, তোমায় আমায় ছাড়িয়ে, বিষাদের কি অবসন্নতায় ডুবে যেতে শুরু করলাম… বিষাদ মানুষকে বদলে দেয়…. ভালোবাসা যা পারল না আলোকেশ…. বিষাদ পারল… আমাকে মৃত্যুর সামনে দাঁড় করালো….. কি অনায়াসে….. আমাকে কত কেউ বারণ করেছিল……

========

ওর রাক্ষসটাকে আমি চিনতাম। সেফটি ট্যাঙ্কের মধ্যে আমি আপ্রাণ চাইতাম এই শাঁখাপলার বেষ্টনী থেকে রেহাই পেতে। এই শাঁখাপলার ভিতর থেকে আমার মা ঠাকুমা ঘুম পাড়ানি গান শোনাতো। আমি না চাইলেও ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাকে আমার মা ঠাকুমারা দেখতে আসত। বলতো কি নিরাপদ জায়গা রে! ভালো আছিস। এই তো শান্তিতে আছিস। মানিয়ে নিলেই সবটুকু হয়ে যায়।

শুনেছি ওকে আবার ডেকেছে পুলিশ। ডাকুক। শাস্তি দেবে ওকে? কিসের শাস্তি? বাতাসকে শাস্তি দেওয়া যায়? আমাদের সমাজে এক বিষাক্ত বাতাস আছে….. গুহার রাক্ষসদের জাগিয়ে দিয়ে যায়….. দুর্বল রাক্ষসও কখনো কখনও তেড়েফুঁড়ে ওঠে…. আমি এরকম কত দেখলাম…. এতো এক বিন্দু…. সহস্র বিন্দু আছে এমন.… বাতাসকে বন্দী করতে পারবে? পারবে ফাঁসিতে ঝুলাতে?

======

আমি শুনতাম না। কারোর কথাই শুনতাম না। আসলে যে শোনে, যে বোঝে, যে ভাবে, যে সাড়া দেয়…. সে কোথায় তখন? সে তখন অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে। ক্ষণ গুনছে। বিষাদ অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরেছে তাকে। চিনিয়ে দিচ্ছে গোটা সংসারের অলিগলি। এত মনোটোনাস। এত আবছা সব। কুয়াশার মধ্যে যে রহস্য আছে, আবছা আলোয় তা নেই তো….. আবছা আলোয় যে দাঁড়িয়ে…. সে একজন নরপিশাচ….. আমি চিনিয়ে যাব তাকে…..

কাবেরী ঘুমিয়ে পড়েছে। শাওয়ারের তলায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে। তার বুকে মাথায় পাগলা কুকুর দাপায় রাতদিন। সে বাইরে ঘুমাচ্ছে। জেগে উঠলেই চেনা অচেনায় অন্য মানুষ। এই খানেই তো সমস্যা। যাকে চিনি আর যাকে চিনি না তাদের নিয়ে তো সমস্যা নেই। সমস্যা এই চেনা অচেনার সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে….. ভালোবাসা আর অতিভালোবাসার ফাঁকে চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে….. মানুষ আর পিশাচের মধ্যে কেমোফ্লেজ হয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে…….

কাবেরীর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে মঞ্জু। রমা এসে বসল কাবেরীর পাশে। মঞ্জুর দিকে হাতটা বাড়িয়ে বলল, এইগুলো খুলে দেবে দিদি?

মঞ্জু শীর্ণ কালশিটে পড়া হাতটা দিয়ে টানল। রমা ভিজছে। কাবেরী ভিজছে। মঞ্জু ভিজছে। শাওয়ারের ট্যাঙ্কিতে ধরা জলে।

মঞ্জু বলল, পরতে গিয়েছিলে কেন?

রমা বলল, পরিয়ে দিয়েছিল তো…. আমরা তো পরি না…. তুমি না পরেই বা…..

কাবেরী উঠে বসেছে। মঞ্জু আর রমা নিজেদের গুটিয়ে কোণে এসে বসল।

কাবেরী উঠে গিয়ে ঘরে এলো। নিজেকে মুছল, আলতো করে। ব্যথায় টাটালো। চুপ করে থাকল। এসিটা বন্ধ করল। অলোকেশের গায়ে চাদরটা টেনে দিল। অলোকেশের বাঁ হাতের আঙুলে ধরা কাবেরীর হেনা করা চুল কয়েকটা। কাবেরী ডান হাতের আঙুলে নিয়ে ব্যালকনিতে এলো। বৃষ্টি থেমে গেছে। একটু থুতু দিয়ে চুলগুলো উড়িয়ে দিল। এ চুল ভালোবাসার, না অন্য কিছুর বুঝবে কি করে? চোখের খুব কাছে এনে কোনো জিনিস দেখলে ঝাপসা লাগে….. সে অলোকেশের এত কাছে….. সব ঝাপসা লাগে….. সুখ… অসুখ…. ভালোবাসা…. কাম… স্বপ্ন…. সব ঝাপসা…… কিন্তু নিজের অস্তিত্বের মধ্যে এমনভাবে কারোর অস্তিত্ব তো অনুভব করেনি কোনোদিন কাবেরী…… এ এক নেশা….. আশ্চর্য নেশা…… নিজের সবটুকু বিকিয়ে দেওয়ার…..

মঞ্জু… রমা কাবেরীর উড়ন্ত চুলকে বলল….. ওকে ফেরা…..বল…. নিজেকে শেষ করে দেওয়া যায় না….. চাইলেও যায় না… নিজেকে নষ্ট করে দেওয়া যায় খালি…..

উড়ন্ত চুল কারোর কথা শুনল না। তাকে নিয়ে মেতেছে আষাঢ়ের ঝোড়ো সজল হাওয়া….. সে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে তার হাতে….. এ এক অদ্ভুত খেলা…..