সৌরভ ভট্টাচার্য
10 November 2019
এ হল গিয়ে বাণী। পড়া তো হল, কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ এর উদাহরণ দেখব বলে ভক্ত, অনুরাগী, সাধু, পণ্ডিত কার না দরজায় দরজায় ঘুরলাম। পেলাম না। বাণীর ব্যাখ্যা, ব্যাখ্যার ব্যাখ্যা, তার ব্যাখ্যা, সুক্ষ্ম ব্যাখ্যা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুক্ষ্ম ব্যাখ্যা পেলাম। কিন্তু বস্তু পেলাম না। দেবী অলক্ষ্যে হাসলেন, বললেন, ধৈর্য ধরো বৎস, তোমারে বুঝাবে যে হালিসহরেই বাড়িছে সে।
অবশেষে তার দর্শন হল। ধরাধামে তার লীলার বর্তমান বয়েস হবে পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ বছর, কিন্তু ইতিমধ্যে সে বুঝেছে, "জগতে কেউ তোমার পর নয় বাবা, জগতকে আপন করে নিতে শেখো"। সে এগরোলের লাইনে অপরিচিত মানু্ষের পেট জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, প্রথম দেখা মানুষকে বাড়িতে লুচি-তরকারির আমন্ত্রণ জানায়, তার চাইতে চল্লিশ বছর বড় প্রায় মানুষকে প্রথম দেখা হতেই, সহাস্য বদনে, "কেমন আছো" জিজ্ঞাসা করে তাকে নতুন করে মনুষ্যজাতির উপর ভরসা আনতে উদ্বুদ্ধ করে, যাকে দরকার মনে তাকেই ভিডিও কলে চাক্ষুষ দেখে, কুশল সংবাদ নিয়েই ফোন কেটে দেয়, বাচ্চাদের মধ্যে টিফিন ভাগ করে নেয়, যদি কেউ উৎকৃষ্ট খাদ্য লোভে পড়ে ভাগ করতে না চায় তবে বিদ্যালয় কার্য শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে ফেরার পথেই তাকে উচিৎ রকম শিক্ষা দেয়, যদি তাতে কিঞ্চিৎ কঠোর হতে হয় তবে তাও সে হতে দ্বিধাবোধ করে না। অবশ্য আজ অবধি তার সামনে কাউকে বঞ্চিত করে তার হাতে কিছু দিতেও পারিনি আমি, যাই ওকে দিতে হয়, তা সামনে বসা সবাইকে সমান সংখ্যায় না দিলে সে রীতিমত অসন্তুষ্ট হন। সে লক্ষ্মীপুজোর গুজিয়াই হোক, কে লেস, কি ক্যাডবেরি, মায় চুমু অবধি তাকে একা না, সামনে অন্যকোনো বাচ্চাকে উপেক্ষা করে একদম না।
একবার আমার ক্লাসরুমে ঢুকে আমার প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর আসন্ন দুর্গাপুজোয় কার ক’টা জামা হয়েছে, এবং আরো ক’টা জামা হতে পারে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নিয়ে নিজের ষোলোটা জামা হওয়া, এবং প্রয়োজনে তাদের সে জামা ধার অবধি দিতে সে রাজী এমন আস্বস্ত করে আমার ক্লাসরুম থেকে বিদায় গ্রহণ করে। ও ইতিমধ্যে একজন ছাত্রের বৃহত্তর প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য বাড়ি যাওয়াকেও সে ভালো চোখে দেখে না, তার মা বাবার এমন দশম শ্রেণীতে পড়া বালকটিকে হাগিস না পরিয়ে পাঠানো নিয়ে কঠোর ভর্ৎসনা করে কঠিন প্রাণে। সেই ভর্ৎসনায় শিক্ষক ও বাকি ছাত্রছাত্রীদের হাস্য উৎপাদনের কারণ কিছু বুঝতে না পেরে যারপরনাই বিরক্তি বোধ করে, যা পরে ক্যাডবেরি ভক্ষণে শান্ত হয়, ও সেই হাগিস বিস্মৃত অবিবেচক অভাগা বাবা-মা বেঁচে যায়।
একবার আমার রাত্রে বমন কার্যের কথা শুনে গম্ভীর বদনে আমার সম্মুখে বসে প্রশ্ন করে, জল কে দিল? আমি চমকিয়েই উঠলাম, অর্থাৎ আমি বমি করলে রাতে জল দেওয়ার মানুষ যে ঘরে আনা হয়নি সে ব্যাপারেও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি বুঝলাম। এবং হজমের গোলোযোগ হওয়ায় আমার মুড়ি তরকারি খাওয়াটাকে সম্মতি জানিয়ে নিজেও কয়েক চামচ খেয়ে উপস্থিত কয়েকজনের মধ্যে বিতরণ করতে উদ্যোগী হয়। আমরা তাকে পুরোপুরি বিরত করতে সক্ষম হইনি যদিও।
তিনি প্রবল বিক্রমে বাড়ি যখন মাথায় করেছেন, যাকে নিন্দুকে দুষ্টুমি বলে, হঠাৎ আমার পিতৃদেবের কাশির আওয়াজ শুনে ক্ষণিকের জন্য স্থির হন, কাশির আওয়াজের উৎস সন্ধান করে মদীয় পিতৃদেবের ঘরে প্রবেশ করে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করে আমায় উপদেশ দেন, আমি যেন সারাঘর দুষ্টামি না করে পিতৃদেবের পাশে বসি।
দুর্গাপুজোয় তার প্রতিদিনের নিয়ম ছিল তার বাবা মানে আমার বাল্যবন্ধু Aditya-র বাইকে বসে সকালে আসা। এসেই বাড়ির যতগুলো দরজা রাস্তা অবধি খোলা যায়, সব ক’টা দরজা খুলে আমার বন্ধুদের আসার পথে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আমার বন্ধুদের Suman, Joydeep, Debasish, সাগর, Subhajit, Tanmay, Biswadip, Surajit প্রমুখরা তার 'কাকাই', যাদের সে ভীষণ "তুই" বলে ডাকতে ইচ্ছুক, তার বাবার মত, কিন্তু নানা শাসনে হয় কি তাই! আমি আর সে যখন একা থাকি, মানে আরকি আমাদের বয়েসী যখন কেউ ধারেকাছে না থাকে, তখন আমরা নিজেদের 'তুই' বলে ডাকতে অবশ্য চুক্তিবদ্ধ। তাতে সংসারে যদি মহাভারত অশুদ্ধ হয় হোক, আমরা কেয়ার করি না।
আমাদের বন্ধুমহলে এমন নতুন সদস্য আসার খবরটা জগতকে জানানোর জন্যেই এ পোস্ট। যে কাজটা তার সৌরভকাকাই পারেনি, সে পেরেছে, সদর দরজা আর অন্দরমহলের দরজা এক সাথে হাপাট্টা করে খুলে বলতে পেরেছে, বন্ধ কোরো না, ওরা আসবে যে।
খুব একটা বড় মানুষ হোক, এই প্রার্থনা, মানুষটা বড় হলে বাকি সব কিছু বড্ড তুচ্ছ ম্যাড়মেড়ে লাগে তার কাছে, তাই যেন হয়, এই আশা। অনেক অনেক চুমু, আরাধ্যা পাল।
[ছবিঃ জয়দীপ ঘোষ, লেখক]