Skip to main content
 
 
        রাতের অন্ধকারে ছাদে একা বসেছিল। আজ তার বিবাহবার্ষিকী। তার না, তাদের, তবু রাজীবের মনে হয়, তারই। স্নেহা তার প্রতিদ্বন্দ্বী। সামাজিক জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বী, কর্মজীবনে না। কর্মজীবনে রাজীব একা আর্থিক স্বাবলম্বী। স্নেহা পরজীবী। এইটুকুই রাজীবের জিত। জিত না, পুরুষত্বের অঙ্কুশ। 
        ঘটনাটা নতুন কিছু না। কম আলোচিত। রাজীব পুরুষের শরীরে একজন নারী। যাকে সামাজিক ভাষায় বলে 'সমকামী'। মিথ্যা কথা। 'সম'-তে কাম জন্মায় না। আকারে সমান বলে কি প্রকৃতিতেও সমান? নয় তো। তার প্রকৃতি আর পারভেজের প্রকৃতি কি এক ছিল? না তো। প্রকৃতিতে সমানে সমানে কখনও আকর্ষণ জন্মায় না। এ ডাহা মিথ্যা কথা। রাজীবের মধ্যে যে নারী, তাকে পারভেজ চিনতে পেরেছিল। বিজ্ঞান প্রমাণ চায়, অনুভব নয়। মানুষ অনুভবে বাঁচে, প্রমাণে নয়। তাই মানুষের সাথে বিজ্ঞানের কাজের সম্পর্ক হতে পারে, হৃদয়ের নয়। তবে কি করে বিজ্ঞান তার অনুভবের সংজ্ঞা টানতে আসে? কোন অধিকারে? 
        ছাদের উপর শুয়ে পড়ল রাজীব। তার মাথার উপর অমানবিক জগত। তারা, মহাকাশ, মেঘ - এ সব বিজ্ঞান। অনুভব যদিও, কিন্তু ওখানে দাপট বিজ্ঞানের। মানুষের জ্ঞান মানুষের এত শত্রু হতে পারে? তার অনুভব, কল্পনা সব কিছুকে সে ব্যাখ্যা করবে? কেন কেন কেন?
 
        পারভেজের সাথে তার পরিচয় কলেজে। দু'জনেরই ইতিহাস অনার্স। পারভেজ প্রথম তাকে বুঝিয়েছিল সে ইতিহাসের স্রোতে বিছিন্ন একটা দ্বীপ নয়। পারভেজ তার স্রোতের সুর বোঝে। পারভেজ তার নাবিক হল।
        ভীতু নাবিক। এক ঘূর্ণির মাঝে তাকে একা ফেলে চলে গেল। সমাজের ভয়ে। তখন রাজীব সদ্য স্কুলে চাকরিটা পেয়েছে। পারভেজ wbcs -এর জন্য পড়ছে। এখন পারভেজ কোথায় জানে না রাজীব। জানতে চায়ও না। পারভেজ একটা অনুভব। বিজ্ঞানের ভাষায় পুরুষ। সে বিজ্ঞানকে সার্থক করুক, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলুক। অনুভব মিথ্যা, প্রমাণ সত্য।
 
        তবে স্নেহা তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেন? কারণ বিজ্ঞান। কারণ সমাজ। স্নেহা যাকে পায় সে একজন পুরুষ। রাজীব সেই পুরুষ। স্নেহার চোখে যে তৃষ্ণা রাজীব সে তৃষ্ণার আঁচ জানে। কিন্তু স্নেহা সে তৃষ্ণার জল পায় রাজীবের শরীরে, আর রাজীব? সে বিজ্ঞানের অভিনেতা, সমাজের অভিনেতা। প্রতিবার স্নেহা জিতে যায়। রাজীবকে নিয়েই জিতে যায়। রাজীব ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত স্নেহার পাশে শুয়ে। উলঙ্গ। নির্লজ্জের মত উলঙ্গ। স্নেহা সগর্বে উলঙ্গ। রাজীবের বমি পায়। রাজীব কতবার যে আত্মহত্যা করে। পালিয়ে পালিয়ে সে এতটা রাস্তা হেঁটে ফেলেছে যেন পৃথিবীর আর কোনো পথ বাকি নেই, সবাই চেনে রাজীবকে।
        রাজীব ভীতু। রাজীব কাপুরুষ। নইলে সে বিয়েতে রাজি হল কেন? না হয় আলাদা হত। না হয় পেতো না পৈতৃক সম্পত্তি। তো?
        এই "তো" এর কোনো উত্তর হয় না। ওভাবে বাঁচা যায়? যদিও বা যায় রাজীবের সে সাহস নেই। তাই সে পারভেজকে এড়িয়ে যায়। পারভেজ যদি তার বিয়ের কথা জেনে ফেলে সেও বুঝে যাবে আসলে তারা দু'জনেই পারেনি। ভীতু ছিল। কাপুরুষ।
রাজীব জানে, তার আর পারভেজের সমাজ আছে, বিজ্ঞান আছে, প্রমাণ আছে - অনুভব নেই। তারা ভয়কে বাঁচিয়ে রাখে। ভয় নিয়ে তবু বাঁচা যায়, ভয় চলে গেলে বাঁচবে কি নিয়ে? ভয় অভ্যাস যে তার। তার আর পারভেজের। হয়ত তাদের মত আরো অনেকের।
 
 (এতটাতেই আমার আখ্যান শেষ হতে পারত। যদি না রাজীব কোনো একদিন বর্ষার রাতে তার দু'বছরের বাচ্চা আর স্নেহার খাবারে বিষ মিশিয়ে নিজে গলায় দড়ি দিয়ে মরত। তার সুইসাইড নোট একটা বিখ্যাত দৈনিকে ছাপা হত। নানা মনরোগ বিশেষজ্ঞেরা নিজেদের জ্ঞানগম্ভীর আলোচনায় এই মানসিক টানাপোড়েনকে আলোকিত করতেন। 
        তখন এক বিশেষ কারণে আমায় দক্ষিণ ভারতে প্রতি বছর যেতে হত। খবরটা আমায় ভাবিয়েছিল। কিন্তু বলার সাহস করিনি। মনে হয়েছিল যদি অবিচার করি। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের নানা গলি ঘুরতে ঘুরতে বেশ কয়েক বছরে আমার মনে হল আমি যেন বুঝতে পেরেছি। তাই লেখার সাহস রাখলাম। নামগুলো মনে নেই। তাই বঙ্গীয় নাম। 
        আমাদের সমাজের কাদার যোগান যত আছে যুক্তির যোগান অনুরূপ নাই। তাই এ ধরণের নানা ঘটনা আমাদের বিশ্লেষণের মর্যাদা না পেয়ে কাদামাখার খেলায় ডাক পায়। আজ সেই একই রাজ্যে যখন মন্দিরে নারীর প্রবেশ অশুচি হয়, এবং তা দুই পুরুষ দেবতার সঙ্গমজাত দেবতার আরাধনার কারণে, তখন সবটাই বড় হাস্যকর ঠেকে।)