Skip to main content

এক বুক নিংড়ানো সুখ। সাবধানে রাখা। জীবনটা বড় বেশি তো নয়। ভুস করে শেষ হয়ে গেলেই হয়। কিন্তু সব তো হল, জামাটা প্যান্টটা কি করবে?

হল কি, রাস্তায় জল জমেছিল, ভুস করে একটা গাড়ি চলে গেল, তাকে ভিজিয়ে। আপাদমস্তক নয়, খানিকটা।

দে, চা দে।

গরম চা। চিনি ছাড়া। চিনি রক্তে যা জমছে সে-ই নাকি আতঙ্কের। কার আতঙ্ক? ভুস!

অ্যাই.... অ্যাই.... ছাতাটা.... ও মশায়.... ছাতাটা সরিয়ে রাখুন... প্যান্টে লাগছে যে.....

লোকটা বলতেই পারত, "প্যান্টটা তো ভিজেই আছে গাণ্ডু…. চিল্লাচ্ছ কেন?"

লোকটা বলল না। এটা ভদ্রতা। সত্যি কথা বেঁধা কথা হলে বলতে নেই। তবে অনেক বেঁধা কথা জমাতে জমাতে মানুষ ভুস্ করে একদিন যাকে তাকে যা তা কথায় বিঁধিয়ে ফেলে। পরে আফসোস হয়। কিন্তু কি আর করা? মানুষের প্যাটার্নটাই এমন বিটকেলে।

কি বৃষ্টি রে শালা…..! ছাঁট আসছে…. পায়ে চামড়ার চটি…. ভিজছে, পচছে… নষ্ট হচ্ছে…. লিভারের মত…. লিভারের মদের বৃষ্টির ছাঁট….

ডান হাতের তর্জনী দিয়ে লিভারের উপরটা চেপে দেখল। ব্যথা আছে।

এখন বিকেল। মেঘের জন্য সন্ধ্যের আগের বিকেল। কিন্তু আসলে এখন দুপুরের পরের বিকেল।

দাদা…. একটু সরে বসবেন…..

এক মহিলা। অল্পবয়েসী। মনে হচ্ছে বিধবা। সালোয়ার কামিজ পরে, কাকভেজা হয়ে এসেছে। হাতে ব্যাগ। মনে হয় কাজ করে। কি কাজ?

দাদা চা একটা…. চিনি ছাড়া…..

সুগার? নাকি বাড়িতে চিনির খরচ কমানো… তবে কি? সুগারই হবে….

কি সুগার?

আর বলবেন না দাদা…. মায়ের থেকে পেয়েছি…. চার বছর হল…. এই ছত্রিশে পড়লাম… আপনি ওই খোকাদার ওষুধের দোকানে ইঞ্জেকশন দেন না? আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম…. টিটেনাস দিতে….

ওহ… কিচ্ছু মনে পড়ছে না…. কিন্তু চেনে কেন? বিরক্ত লাগছে। কি একটা সুখ যেন ভাঙা কাপের মত চা সমেত পড়ে গেল। মনের মেঝেতে পড়া চা ঘিরে বিষণ্ণতার পিঁপড়ে। কামড়াচ্ছে কুটকুট করে।

অপরিচিত শরীর মনের মধ্যে একটা আদিম গন্ধ পাওয়ার আশা থাকে। চেনা হয়ে গেলে বড্ড একঘেয়ে। অলকার শরীর যেমন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে চেনে। শরীর মন আবেগ সব কাঁসার থালায় সাজানো খিচুড়ির মত। জটিল, কিন্তু সুস্বাদু। অলকা তাকে সুখী করেছে।

কিন্তু জীবনে একটা আদিম গন্ধ চাই। খারাপ পাড়ায় গেছে। এখন যাকে রেডলাইট এরিয়া বলে। ফিরে আসার সময় মনে হয়েছে চুটিয়ে ব্যায়াম হয়েছে শুধু। বাসে বসে বসে সিগন্যালের আলোগুলো দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, কেউ আদিম থাকতে দিচ্ছে না। মানুষ কেন আদিম থাকতে চায় না? নাকি চায়, পারে না। এখনই যদি এই এই মোড়ে একটা দুর্ধর্ষ অ্যাক্সিডেন্ট হত? চারদিকে রক্তারক্তি? হাত পা ভেঙে, কেটে…. উফ্… বীভৎস… কিন্তু সলিড….

মানুষকে আদিম থাকতে দেয় না সিগন্যাল। সব কিছু তছনছ করে চলে যাব বললেই যেন যাওয়া যায়…. ঢংয়ের কথা যত। উকিল ডেকে, মোচ্ছব করে, লোক গিলিয়ে সুখকে পার্মানেন্ট করার সভ্যতায় সাহস কোথায়? তছনছ করার? অবৈধ সম্পর্কে? অবৈধ মানে তো দুর্বলের ছুঁকছুঁকানি… সেকি ভালোবাসা নাকি?

অ্যাই চায়ের দাম ওর থেকে নিবি না…..

ইস দাদা, আপনি কেন আবার.. আচ্ছা… বেশ… দুটো বিস্কুটও নিয়েছিলাম….

তাই? খেয়াল করিনি। কিন্তু করলেই কি মুখে বলা যায় নাকি? মেয়েটা উঠে যাচ্ছে। যেখানে বসেছিল সেখানে পাছার দাগ রেখে যাচ্ছে। জলের দাগ। একটু পরেই মুছে যাবে বাতাসে। মেয়েটা কি তাকে ইউজ করে গেল? কাম যখন দরদের ছদ্মবেশে আসে তখন বড্ড বেইজ্জত করে যায় মাঝে মাঝে। আগেও হয়েছে।

কিন্তু আদিম সুখ কোথায় আছে? একটা ভীষণ "দর্দনাক" মৃত্যুকে চাইবে? রেল লাইনে শুয়ে না, হাতের ধমনী কেটে… কথামৃতটা পড়তে পড়তে মারা যাবে? কিম্বা একটা পর্ণ ম্যাগাজিন… বিন্দু বিন্দু প্রাণ বেরিয়ে ভেসে যাচ্ছে…. অলকা চিৎ হয়ে পাশে শুয়ে, গভীর ঘুমে। বুকের উপর থেকে আঁচল খসে গেছে। মদিরা-গর্ব-হীন দুটো স্তন…নাভি…. ভীষণ কল্পনাহীন বাস্তব হয়ে লুটিয়ে আছে শরীরে….. গর্ভ শূন্য…. সন্তান বিয়ে করে বাইরে…. ছেলে… ভালো সম্পর্ক নয়…. গর্ভ জানে…. কেটে ফেলা ফোঁড়া…. টাটায়…. বশ মানে না…. বাঁচুক সে….

অলকা জানে না ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে কৌস্তুভ… রক্ত খাটের পাশে রাখা টেবিলটার পায়া ভিজিয়ে বাথরুমের দরজার দিকে যাচ্ছে….. হাতে ধরা কথামৃত কিম্বা পর্ণ ম্যাগাজিন….. একটা আদিম মৃত্যু সুখ উপভোগ করছে সে….. কেউ জানল না… এমনকি ভোরের শুকতারা…. গীতবিতানের প্রেম আর বর্ষা পর্যায়ের গানগুলো…. আর উঠানের নয়নতারা গাছটা….. কেউ জানল না…. অথচ যাদের সবচাইতে আপন মনে হয়েছিল…..

বৃষ্টি ধরেছে। ছাতাটা ভিজে। মুখে তিতা চায়ের স্বাদ। সব অভ্যস্ত। বড় চেনা। আজ মন্দিরে যাবে। মঙ্গলবার। মায়ের মন্দিরে। সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা চাইবে। ছেলেটার জন্য প্রার্থনা করবে। এর কোনোটাই সত্যি নয় জেনেও করবে। কেউ বললে, চুপ করাবে। তারপর বাড়ি এসে আবার কোনো আদিম সুখের অপেক্ষা করবে। মৃত্যু ছাড়া আদিম সুখের প্রত্যাশা কারোর কাছে নেই। মানুষ নাকি আদিম সুখের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেকে সভ্য করেছে। ঢং। নিজেকে বেইমান করেছে। ঈর্ষা, আদিম সুখের একমাত্র প্রতিনিধি। চাইলে সব পারে। সব করায়। সময়ে করাবেও। আয় ঈর্ষা আয়, আমার বুক জ্বালিয়ে যা…. আমায় বর্বর করে যা…. আমাকে আদিম সুখে নাচিয়ে দিয়ে যা…. আমি মাতাল হই… আমি এই সভ্যতার ঢঙের প্রাচীর ভাঙি…. আয় আয়… ঈর্ষা আয়….

দাদা, টিকিট…..

পঞ্চাননতলা….

এক বাস উলঙ্গ মানুষ। উলঙ্গ মানে আদিম না। উলঙ্গ মানে প্রাচীন। আদিম মানে হিংস্র…. বর্বর…. চাই চাই….

দাদা একটু ধরবেন?

একটা বাচ্চা…. মা টিকিটের টাকা বার করবে…. তাই তার কোলে দেবে….

কয়েক মাসের মানুষের শরীর… তুলতুলে… কোলে…. আলতো হাত পিঠের উপর রাখল… এক হাতেই গোটা পিঠ…. তার কোমল হাত ঘাড়ের কাছ ছুঁলো….. টিশার্টের কলার ধরে…. আদিম গন্ধ…সুখ…. চোখে জল….অলকা প্রাচীন সুখের মুহূর্তের সাক্ষী করেছে তাকে….. অলকা ধন্য…. তার স্তন… গর্ভ ধন্য….

দিন দাদা….

আমার অসুবিধা হচ্ছে না….

দিন… আপনার জামা নোংরা করে দেবে…..

বাসের ঝাঁকুনি। ঝিমুনি লাগছে। চারদিকে বাচ্চা। মানুষের বাচ্চা। হামাগুড়ি দিচ্ছে। উলঙ্গ। উলঙ্গ মানে প্রাচীন। আগলাতে হবে। অলকা…একবার এদিকে এসো…. দেখো বাবু কি মুখে দিয়ে ফেলেছে…..

বাবুর নাম্বার। মোবাইলের ব্যাটারির শক্তিতে জ্বলজ্বলে স্ক্রিণের উপর…. অলকা…. তুমি কত একা… তোমার তো আদিম সুখের স্বপ্নও নেই…. তুমি চাও কুলোর মত ঝেঁটিয়ে দিতে অমঙ্গল…. অনুচিত যা… আমি তোমার সামনে নতজানু.…. আজ পেঁয়াজি আনব…. খাবে?

এনো… আর চা পাতাটা… ফুরিয়ে গেছে….

আমিও ফুরিয়ে গেছি অলকা। বলতে পারছি না। আমি একটু পরে আসব। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এসে বলব চপের দোকানে ভিড় ছিল। তুমি বিশ্বাস কোরো অলকা। প্লিজ। নইলে আমার মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না। অলকা, আমায় ঢাকো, ঢাকো, ঢাকো। আড়াল করো।