কথাটা ঠিক মাছ ধরা না। কথাটা হল সময় কাটানো। নইলে এই পুকুরে কি এমন মাছ হয় যে সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো অবধি বসে থাকা যায়?
নকুড় ছিপ ফেলে বসে থাকে। ঘাসের উপর বসা প্রজাপতি দেখে। পুকুরের ওপারে ঘন বাঁশঝাড়ে বসা মাছরাঙা, পানকৌড়ি, বক দেখে। মাঝে মাঝে ছিপে আটকানো মাছ জলে ছেড়ে দেয়। ছিপটা মাথার কাছে রেখে শোয়। আকাশ দেখে। মেঘ দেখে। বুকের ভিতর কাকে যেন খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে খেই হারিয়ে যায়। যেমন তার আশেপাশে সব মানুষ হারিয়ে গেছে। নকুড়ের দুঃখও হয় না। দুঃখ পেতে মন লাগে। নকুড়ের মনই নেই। শুকিয়ে মরে গেছে।
শরৎ আসছে। নকুড় শুয়ে শুয়ে সাদা মেঘের উড়ে যাওয়া দেখছে। আচমকা ওপারের বাঁশঝাড়ে খড়মড় আওয়াজ হতে ফিরে তাকালো নকুড়। একটা বেশ ঢ্যাঙা লোক। সরু সরু হাত-পা। একটা নীল প্যান্ট আর হলুদ ফতুয়া গায়ে দাঁড়িয়ে।
নকুড় ভুরুটা কুঁচকে তাকালো। গ্রামের এদিকে একে কেউ আসেটাসে না। আর একে তো দেখেইনি কোনোদিন এ গ্রামে।
ও বাব্বা! একি একি! লোকটা একটা পা বাড়িয়ে দিল, পা-টা ইয়া লম্বা হয়ে পুকুরের এই ঘাটে এসে পড়ল। নকুড়ের থেকে দশ হাত দূরে হবে। নকুড় ধড়মড় করে উঠে বসল। ততক্ষণে আরেকটা পা ইলাস্টিকের মত লম্বা করে সে এদিকে এসে দাঁড়িয়েছে। কানের পাশ থেকে একটা বিড়ি বার করে বার দুই তাতে বাঁশির মত ফুঁ দিয়ে বলল, মাচিস আছে?
মাচিস মানে দেশলাই। আছে। কিন্তু এ কে রে বাবা?
নকুড় লুঙ্গির প্যাঁচ খুলে দেশলাই বার করতেই লোকটা আবার ইলাস্টিক হাতে ছোঁ মেরে নিয়ে, ফস্ করে বিড়িটা ধরিয়েই, আবার ধাঁ করে তার লুঙ্গির মধ্যে পেঁচিয়ে রেখে দিল।
কি ঠাণ্ডা হাতের আঙুলগুলো রে বাবা!
লোকটা পাশে বসে পড়ল। বলল, মাছ উঠেছে? এদিকের পুকুরে মাছ হয় না তেমন…আগে হত… বঙ্কিম তখন ছোটো… ওর এক পিসের বাড়ি ছিল এখানে… সেই যখন আসত… আহা কি আনন্দ…! এই পুকুর থেকেই কত মাছ উঠত…।
নকুড়ের মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। এটা হয়। নকুড় বুঝল জিভে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগতেই। সে বলল, বঙ্কিম?
লোকটা বলল, বাঙালি তো?
হ্যাঁ…
বইটই পড়া হয়?
হ্যাঁ… ওই কিছু কিছু…
এ সব মাস্টারি কথা ভালো লাগে না নকুড়ের… সত্যি বলতে স্কুলে যেতেই ভালো লাগত না… কি জানে না সেই নিয়ে মাস্টারদের এত উৎসাহ তার ভালো লাগত না… সাপের গর্ত, ইঁদুরের গর্ত চেনে না… ওদিকে নাকি গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব কষছে… না পারলে কান মুলে দিচ্ছে… দূর দূর…
ঢ্যাঙা লোকটা বলল, আরে মশায় বঙ্কিম চ্যাটুজ্জের নাম শোনেননি? লিখতেন টিকতেন… বন্দে মাতরম…
ও হ্যাঁ হ্যাঁ… মানে আপনি…
হ্যাঁ হ্যাঁ… আমি মানুষটানুষ নই… ওসব পাট অনেক দিন হল চুকিয়েছি… মেলা দিন কারোর সঙ্গে কথাটথা হয় না… তা আপনাকে রোজ দেখি মাছ ধরার ঢং করে এখানে পড়ে থাকেন… তাই ভাবলাম আপনার নিশ্চয়ই সাতকূলে কেউ নেই… তাই আমায় দেখে অক্কা পেলেও কারোর খুব একটা ক্ষতিটতি হবে না…তাই না?
নকুড়ের ভয় লাগতে শুরু করছিল… কিন্তু এমন একটা দুর্বল জায়গায় আঘাত পড়ল… ভয় কেটে অভিমান হল। কার উপর হল জানে না। কিন্তু হল। নকুড় বলল, তা আমার কেউ নেই বটে… তা আপনারও তো কেউ আছে বলে মনে হয় না…
লোকটা তার দিকে তাকালো। হাসল। বলল, মনে লেগেছে কথাটা না? লাগবেই তো… তা যাক… সত্যিটা মেনে নেওয়াই ভালো… নইলে রাস্তা বেড়ে যায়… না?
নকুড় 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলল না। সামনে একটা নীলকণ্ঠ এসে বসেছে। কি রঙ!
লোকটা বলল, আমার নাম যতীন। যতীন বাড়ুজ্জে। জন্ম আঠারোশো তিরিশ, মৃত্যু বিষ খেয়ে আঠারো শো বাহাত্তর। নিবাস নৈহাটি।
নকুড় চুপ করে থাকল। দিনদুপুরে এমন আলাপী ভূতের সঙ্গে বসে থাকাটা কেমন হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তার কি ভয় পাওয়া উচিৎ? রামনাম করা উচিৎ? আসলে কোনোদিনই যখন যেটা দরকার সেটা অনুভব হয় না নকুড়ের। ফুলশয্যার রাতে বউকে গোপালভাঁড়ের গল্প শুনিয়ে রাত কাবার করে দিয়েছিল। বউ তো রেগেমেগে বাপের বাড়িই চলে গিয়েছিল মাস তিনেকের জন্য। ভেবেছিল সে পাগল বুঝি! পরে অবশ্য বুঝেছিল পাগল নয় নকুড়, তবে আর পাঁচটা লোকের মতও নয়।
দু'জনেই চুপ করে বসে। ভূত হোক আর যাই হোক, একেবারে কথা না বলাটা অভদ্রতা, সে যখন যেচে এসে আলাপ করেছে। নকুড় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, তা আপনার থাকা হয় কোথায়?
যতীন সামনের বাঁশঝাড়টা দেখিয়ে বলল, ওর পিছনে একটা জলা আছে না? তার পাশে যে মৈত্রদের বাড়ি… তার দোতলায়, ভাঁড়ার ঘরে।
নকুড়ের কথা শেষ। এমনিতেই বহুদিন হল কথা বলার অভ্যাসটাই চলে গেছে। কেউ তার সঙ্গে তেমন একটা কথা বলে না, সেও বলে না। মানুষের সঙ্গেই যখন কথাটথা নেই, তখন আবার ভূতের সঙ্গে…
যতীন বলল, চলো একটা জিনিস দেখাই তোমায়…।
এই বলে নকুড় কিছু বোঝার আগেই যতীন ধাঁ করে নকুড়কে তুলে সামনের বটগাছটার একদম মগডালে বসিয়ে দিল। নিজেও বসল পাশে। বলল, দেখো, কি দারুণ দেখায় না এখান থেকে? … ওই দেখো চূর্ণী নদী… ওই দেখো ট্রেন লাইন… ওই দেখো হরেন বক্সির মাঠ…
নকুড় এত হতভম্ব হয়ে গেছে যে সে কথাই বলতে পারছে না। রাগ হওয়া উচিৎ ছিল তার। হল না। বরঞ্চ ভীষণ হাসি পেল। এই এত বয়সে কেউ তাকে কোলে নিতে পারে ভাবতেই ভীষণ হাসি পেতে শুরু করল। হাসা তো যায় না। কি মনে করবে যতীন। নকুড় বলল, বাহ! দারুণ সত্যি। আচ্ছা আপনি আমায় এইভাবে পুরী নিয়ে যেতে পারেন? আমার আসলে…।
বলতে বলতে একরাশ লজ্জা এসে তার গলা চেপে ধরল। তার মধ্যে যে এখনও কোনো ইচ্ছা এইভাবে ঘাপটি মেরে তাকে লুকিয়ে জীবিত আছে জেনেই লজ্জায় মাথাটা নীচু হয়ে গেল নকুড়ের।
যতীন বলল, সে হতেই পারে। কিন্তু আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন। অতটা রাস্তা ঝোলাপথ…মানে ঝুলে ঝুলে যাওয়া ঠিক নয়… তাই না?
নকুড় বলল, তা তো ঠিক।
কতক্ষণ গেল সময় বলতে পারবে না নকুড়… হঠাৎ দেখে কই, যতীন নেই তো? চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। নেই। এদিকে আর খানিক বাদেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে। এইবার? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল নকুড়। আর অপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু এই এতবড় গাছে তো ওঠেইনি কোনোদিন, নামবে কি করে?
কান্না পেল নকুড়ের। দুটো হাতে দুটো গাছের ডাল ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। আবারও আশ্চর্য হল। এত কান্না আছে তার মধ্যে জমে? যত কাঁদে তার মনটা তত তাজা হয়ে যায়। কি আশ্চর্য! সবার কথা মনে করে করে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল নকুড়। যত কাঁদে তত মনের মধ্যে কি একটা উৎসাহ ভরে ওঠে। এই তো বেঁচে আছে সে…এই তো বেঁচে আছে…
এদিকে এত কান্নাকাটির চোটে খেয়ালই করেনি কখন অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। জোনাকি জ্বলছে। শিয়াল ডাকছে। এইবার?
কিছু বোঝার আগেই ঠাণ্ডা দুটো হাত তাকে জাপটে ধরল। নকুড় ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিল। চোখ খুলেই দেখে সে তার বাড়ির উঠোনে শুয়ে। তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে আছে যতীন। বলছে, এক ঘন্টা পরে উঠো, কোমরটা টাটাবে নইলে… আর শোনো, বুঝেছ তো এখনও অনেক কাজ বাকি… যা করতে হবে শুরু করে দাও…
নকুড় মাথা নাড়ল। মনের মধ্যে এমন মিহি সুখ কদ্দিন পায়নি। ঘুম চলে আসছে।
এরপরের গল্প তেমন কিছু নেই। নকুড় একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি খোলে। নাম দেয় যতীন ট্র্যাভেল। পুরী, কাশী আর হরিদ্বার। তীর্থযাত্রী নিয়ে যায়। লাভ যত না হয় তৃপ্তি হয় তার চাইতেও বেশি। লোকে বলে নকুড়দার সঙ্গে যাওয়া মানেই তীর্থ সার্থক।
নকুড় বুঝেছে, সংসারে চলতে চলতে পরিজন বাড়লেও আপনজন বাড়ে না। আপনজনের খোঁজেই মানুষ তীর্থে পা বাড়ায়। সবাই কি আর পুণ্য খোঁজে? বুকের ভিতর ঈশ্বরকেও আপনজন করে চায় মানুষ। আপনজনের স্পর্শ জগতের পবিত্রতম স্পর্শ। সেই স্পর্শে লোহা সোনা হয়। মানুষের আসল খোঁজ সেই আপনজনের খোঁজ।
মাঝে মাঝে অবশ্য উদাস হয় নকুড়। যতীনকে খোঁজে। পায় না। যতীনকে মনে পড়লেই বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে নকুড়। ভালো লাগে। মন খারাপের মধ্যেও সুখ হয়। কেউ যেন তার আছে। কোথায় আছে তা জানে না। কিন্তু কেউ একজন যে আছে সে জানে। আর সেই জানাতেই কি শান্তি!
(ছবি Suman)