Skip to main content

 

রমেশের মা অবশেষে মরল। দুপুর বেলা। রমেশ তখন কাজে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে। মালিক খবরটা পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। শেষ কয়েক মাস রমেশ মায়ের জন্য আটকা পড়ছিল। কাজে ক্ষতি তো হচ্ছিলই। রমেশকে ডেকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, যা, ভালোভাবে কাজটা সেরে আয়।

রমেশ যখন মা-কে নিয়ে গাড়িতে উঠল তখন সন্ধ্যে নেমেছে। একটা ট্র‍্যাকটারের পিছনে বাঁধা ভ্যান। মালিকই দিয়েছে।

কালীপুজো কাল। রাস্তা দিয়ে যখন যাচ্ছে রমেশ তখন চারদিক আলোয় আলো। ভ্যানে করে করে মা কালীর প্রতিমাকে আনা হচ্ছে। রমেশের বন্ধু রাস্তায় খই ফেলছে। এর মধ্যে কীর্তনের দলও এসেছে। তারাও পাশে বসে গাইছে। রমেশ মায়ের মুখের দিকে তাকায়নি এসের থেকে। এই তাকালো। চশমাটা বাঁকা পরিয়েছে। মুখটা হাঁ। প্রাণ কি তবে মুখ দিয়ে বার হল?

রমেশ মায়ের বাঁ পায়ের পাতাটা ছুঁলো। ঠাণ্ডা। ছুঁয়ে থাকল। একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়ালো। চা খাবে। অনেকে মদ কিনবে। এ সব জানা রমেশের। সেও নামল। চা খেল। বিড়ি ধরালো। একজন এসে বলল, এখন খাবি, নাকি পুড়ানোর পর?

রমেশ বুঝল না কী বলবে। পোড়াবে?

সামনে মা কালী দাঁড়িয়ে। প্যাণ্ডেলে। চারদিকে বাড়ি বাড়ি প্রদীপ জ্বলছে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। মা তার মদ খাওয়া পছন্দ করত না। কিন্তু বলত না কিছু। প্রদীপগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ কান্না পেল রমেশের। মনে হল এত আলোর মধ্যে কেউ যায়? বুকের মধ্যে বাচ্চা রমেশ তার কালো ময়লা টিশার্টের খুঁট ধরে দাঁড়ালো। তার একরাশ অভিমান মাখা মুখ। ভাষা নেই। ওরা ভাষা শোনার সময় নেই রমেশের। অনেকদিনই সে অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছে।

একজন এসে বলল, এই নে….

রমেশ নির্দ্বিধায় নিল। গলায় ঢালল। মায়ের থেকে দূরে বসল। গাড়ি ছাড়ল। এরপর অনেকবার চাইল। যখন শ্মশানে পৌঁছালো তখন সে আর নেই, শুধু বাচ্চাটা। তার ময়লা টিশার্টের খুঁট ছেড়ে মায়ের সঙ্গে একা একা যাচ্ছে।

দাহ করার আগে কিছু তো কাজ থাকে। কিন্তু করবে কে? রমেশ তো দাঁড়াতেই পারছে না। তার বন্ধুরা এগিয়ে এলো। কয়েকজন হাতে ধরিয়ে কাজটা করিয়ে নিল। রমেশ দেখল সেই বাচ্চাটা মায়ের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। তার দিকে তাকিয়ে। ওর ভাষা শুনবে না রমেশ। সে অন্যদিকে তাকালো।

মা'কে কখন চুল্লীতে ঢোকানো হল মনে নেই। রমেশ একটা ধারে এসে শুলো। ঘুমিয়ে পড়ল। কেউ ডাকল। উঠে তাকিয়ে বলল, মা?

======

রমেশের হুঁশ এলো যখন পরেরদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর। একটা চাটাইয়ের উপর শুয়ে। পাখা চলছে। জানলা খোলা।

রমেশ ঘরের চারদিক তাকালো। মায়ের বিছানাটা এখনও পাতা। ছেঁড়া হাওয়াই চটির একটা উলটে খাটের নীচে। সারাঘর ওষুধের গন্ধ। পেচ্ছাপের গন্ধ।

রমেশ উঠল। স্নান করল। কাচা জামাপ্যান্ট পরে দু হাজার টাকা নিয়ে বাইরে এলো। সাইকেলে উঠে চলল বড় রাস্তার দিকে।

আশ্রমে পৌঁছালো যখন তখন খিদেতে মাথা ঘুরছে। মা আসত এখানে। এটা বৈষ্ণব আশ্রম। মায়ের গলায় কন্ঠি ছিল। মা কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল। রমেশ আশ্রমের বাইরে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে ডাকল, অনুজ প্রভু…..প্রভু……

একজন সন্ন্যাসী বাইরে এলো। আশ্রমের অবস্থা সচ্ছল না। সন্ন্যাসীর গেরুয়াও শতচ্ছিন্ন।

রমেশ টাকাটা সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে রাখল। রাস্তায়। বলল, মা মরল কাল। এটা দিয়ে কিছু করে নেবেন। আমি ওসব কাজ করব না। আমার দ্বারা হবে না।

সন্ন্যাসী বলল, মুখাগ্নি করেছ?

রমেশ বলল, নেশায় ছিলাম। হাতে ধরে বন্ধুরা করিয়েছে। ওকে মুখাগ্নি বলে?

সন্ন্যাসী কড়ে হিসাব করল। বলল, কাজের দিন আসবে?

রমেশ সাইকেলে উঠতে উঠতে বলল, না।

সন্ন্যাসী ডাকল। রমেশ ফিরে এসে দাঁড়ালো।

সন্ন্যাসী বলল, প্রসাদ খেয়ে যাও….মুখটা শুকনো…..

রমেশ বলল, আমার অশৌচ…..

সন্ন্যাসী বলল, ভেতরে এসো…..

সন্ন্যাসী ঝুঁকে টাকাটা নিল রাস্তা থেকে। রমেশ কী করবে বুঝতে না পেরে বলল, আমি ভগবান মানি না….

সন্ন্যাসী বলল, খেয়ে যাও….প্রসাদ না জেনে না হয় খেলে….অন্ন জেনে খাও….

রমেশ বলল, মা কেমন ভক্ত ছিলেন?

সন্ন্যাসী বলল, তোমার মা তোমার জন্যে আসতেন….মন্ত্র তোমার জন্য নিয়েছিলেন…তোমার বাবা তোমাদের ছেড়ে যাওয়ার পর উনিও ভগবানে বিশ্বাস হারিয়েছিলেন…..

রমেশ বলল, ফিরে পেয়েছিলেন বিশ্বাস?

সন্ন্যাসী বলল, না। তোমাকেও না, স্বামীকেও না, বিশ্বাসকেও না।

রমেশ চুপ করে থাকল। সন্ন্যাসী সামনে খাবার এনে রেখেছে। মোটা চালের ভাত। ডাল আর একটা ঘ্যাঁট।

রমেশ খাবার মুখে দেওয়ার আগে কপালে হাত ছোঁয়ালো। কেন করল বুঝল না। কিন্তু করল। যেন এক শূন্যতাকে প্রণাম করল।

সন্ন্যাসী বলল, খেয়ে নাও।

রমেশ বলল, আপনি বসুন।