মাঝে মাঝে নিজের জন্য মায়া হয়। নিজের উপর তৃতীয় ব্যক্তির মত মায়া লাগে। মনে হয় নিজের গালে নিজে একটা চুমু খাই। নিজে যখন ঘুমাই তখন মনে হয় নিজের মাথার কাছে জেগে বসে থাকি। নিজের মাথায় নিজেই হাত বুলিয়ে দিই। আপনার এরকম হয়?
জানি না, ভেবে দেখিনি। হয়, হয় তো।
বিকালের পড়ন্ত রোদ্দুর যখন খাওয়ার টেবিলের উপর এসে পড়ে, আমার মনে হয় আমার ঘরে যেন কেউ আছে, অদৃশ্য কেউ। তারা অন্যগ্রহের মানুষ। আমার সারা জীবনের সঞ্চয় ঘরে তিলতিল করে সাজানো। ওরা সেগুলোর উপর বাস করে। আমি ওদের শ্বাস টের পাই, কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কথা হয় না। বুঝলেন?
শুনছি, বলুন।
এই যে এত এত ফাঁকা প্রতিশ্রুতি সারাটা জীবন শুনলাম... না, আমি কাউকে দোষারোপ করছি না.. মানুষের ক্ষমতা কতটুকু?... এই ধরুন সকালে উঠলেন, পায়খানায় গেলেন... কেমন হাগা হবে বলতে পারবেন আগে থেকে?... যেমন চাইবেন কদ্দিন হয় তেমন?.... শালা সেই মানুষের আবার প্রতিশ্রুতি...... নিজের হাগার ভাগ্য বদলাতে পারে না... অন্যের ভাগ্য বদলাবে.... আমাদের পাড়ায় এক জ্যোতিষী ছিল বুঝলেন.... এই আমি আপনাকে বোর করছি না তো….
না না... বলে যান…
তো সেই জ্যোতিষী… মাল সকালবেলা উঠে টেনশানে থাকে হাগা দিয়ে রক্ত আসবে কিনা…. অর্শ বুঝলেন…. আমি ওই এক কথা তাকে বলেছি... আপনি শালা নিজের পোঁদের ভাগ্য জানেন না... আবার লোকের ভাগ্য নিয়ে রং মারেন কেন?.... আসলে দাদা প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর পাদ দেওয়া এক… বুঝলেন…
সে যাক... আপনি বলছিলেন আপনার নিজেকে দেখলে মায়া লাগে... কেন লাগে?
লাগবে না? সব মুখ বুজে চুপ করে সহ্য করে যাচ্ছি…. যেন শালা বাসের চাকা…. ঘুরেই যাও... ঘুরেই যাও…..
ট্রেনের নয় কেন?
বাস, ট্রেন কথা নয়... কথা হল আপনাকে ঘুরে যেতে হবে….
ইচ্ছা না হলে ঘুরবেন না... কেউ তো বাধ্য করেনি…
বাধ্য…. হাসালেন... মানুষ মানেই বাধ্যজীব…. আপনি বাধ্য নন?
বাধ্য, তবে সে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই….
কারণ আপনি... একটা কথা বলব... কিছু মনে করবেন না তো….
না…
মাইরি বলছেন….
না..
আপনি একটা ন্যাতানো গাণ্ডু…..
সে আপনি ভাবতে পারেন…
আমি না, আপনি নিজেও ভাবেন নিজেকে নিয়ে….
কেন? নিজেকে নিয়ে ভাবব কেন?
কারণ আপনি ভালো মানুষ…. তাই আপনাকে এইসব বলছি... আপনি চাইলেও উঠে যাবেন না... কারণ আপনি ট্রেন্ড ভদ্র মাল….
আমি চাইলেই উঠে যেতে পারি…
যান... আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি... যান….
যেতেই পারি…..
পারেন, আমরা সবাই ভাবি তাই…. চাইলেই উঠে যেতে পারি, অন্য সিটে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারি। কিন্তু আমরা যাই না।
যাই, আমার ট্রেন announce হল। কি করবেন, আপনি উঠবেন?
না। আজ আমার ফেরার নেই।
কেন?
এর কোনো উত্তর হয় না।
একটা কথা বলব? মানবেন?
বলুন
দেখুন, আসলে গাণ্ডুটা আমি না, আপনিই….
কিভাবে?
আপনি অভিমানী... কারণ আপনি এখনও বিশ্বাসী... বিশ্বাসী মানুষেরই অভিমান হয়…. আপনি মনে মনে মঙ্গলময় করুণাময় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন... সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনের সুখময় পরিণতিতে বিশ্বাস করেন.. মোট কথা আপনার অবচেতনে এখনও একটা আইডিয়াল, মানে আদর্শ জীবনের প্রতি আশা আছে…. তার থেকেই এত ক্ষোভ, অভিমান... ছেড়ে দিন দাদা এই গাণ্ডুমিটা…. সব ঝেড়ে ফেলে বাঁচুন….
অত সোজা... আপনি যা বললেন তা হয় তো মনস্তাত্ত্বিকভাবে ঠিক... আমিও জানি…
শুধু জানলে হবে? ফেলে দিন ওসব ধারণা…
বলতে চান আপনি এ সব থেকে মুক্ত... কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায় না আপনার?
যায়…. লকডাউনে সংসার চালাতে প্রায় বিচি বন্ধক দিতে হয়েছিল…. তবু হাল ছাড়িনি…. লড়ে গেছি….
আপনি কিছুকে বিশ্বাস করেন না তবে?
দেখুন, বিশ্বাস একটা ফিলিংস… ফিলিংস বলুন, চিন্তা বলুন, সিগারেটের ধোঁয়া আর আগুনের মত... যত টানবেন হুস করে উঠবে... শেষে সব ঠাণ্ডা….
মানে আপনি ভালোবাসেন না কাউকে…..
না হয় তো…. তার মানে এই না যে আমি নিষ্ঠুর…. কিন্তু আমি ভালোবাসা মানে বুঝি না…. টান বুঝি... মানে বুঝতাম…. এখন সে টান আর নেই…..
আপনি ফুরিয়ে গেছেন…. যন্ত্র হয়ে গেছেন….
আর আপনি ছাই হয়ে জ্বলে উঠতে চাইছেন…. কে বেশি ভালো জায়গায়? ছাই না যন্ত্র?
দুটোর কোনোটাই ভালো না…. আমার আসলে ভীষণ ঈর্ষা…. আমি কি চাই আমি জানি না... আপনার ট্রেন চলে গেল….
যাক
আমি জানি না আমি কি চাই... কিন্তু অন্যে কিছু পেলে আমার সহ্য হয় না... মনে হয় ওটাই আমি চাই…. ওটা পেলেই আমি সব চাইতে সুখী হতাম হয় তো… একে আপনি কি বলবেন?
কিছুই না... আমাদের শিক্ষা মানেই তো তাই…. জ্ঞান খড়গে অজ্ঞানকে না, প্রতিযোগীকে বধ করো... ক্রমে আমি নিজেই খড়গ হয়ে উঠে…. আমার তখন কাজই হল সবাইকে বধ করা….
ঠিক বলেছেন…. আমি কারোর সুখ সহ্য করতে পারি না... আমার অসুস্থ লাগে….
এ রোগে আমরা সবাই অসুস্থ…. ছোঁয়াচে রোগ…. সারালেও আবার হবে…. অজান্তে হবে…..
আমি ঈর্ষামুক্ত হতে চাই… বিশ্বাস করুন…. আমার মনে হয় তবেই আমি শান্ত হব... নইলে এ বিশ্বের গূঢ় কোনো তত্ত্বকথা জেনে আমার কি লাভ বলুন.. আসলে তো আমি নিজেকে নিয়ে নিজে ক্ষুব্ধ, কারণ আমি সবার শত্রু…. সবার সুখের, অ্যাচিভমেন্টের শত্রু…. আমি সবার জন্য দুর্ভাগ্য চাই... কেউ অসুস্থ হলে.. কারোর জীবনে দুর্ঘটনা ঘটলে আমার মধ্যে কি এক বিকৃত সুখ জন্মায়... আমি শান্তি পাই... আমার সান্ত্বনা দিতে কি আরাম লাগে... এ রোগ.. ভয়ানক রোগ... আমি অনেক ধাপ নেমে আসি…. সবার থেকে সবার অজান্তে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করি…. আসলে আমি ভীষণ পরশ্রীকাতর…. প্যাথলজিক্যালি মে বি….
আপনার এখন সুস্থ লাগছে…..
লাগছে... তবে জানি এ ভালো লাগাটা থাকবে না বেশিক্ষণ… আমি আবার আমার পুরোনো খেলায় স্লিপ করে যাব নিজের অজান্তেই….
আপনি বরং খুঁজুন…. আপনার নিজের জন্য কি করতে ভালো লাগে…. নিজেকে নিজের পোষ্য ভাবুন…. দেখুন খুঁজে, একা একা নিজে নিজে কি করলে নিজেকে বাচ্চার মত লাগে…. আমাদের সেই আনন্দই খাঁটি... যে আনন্দে আমরা আমাদেরকে বাচ্চার মত ফিল করতে পারি….. সেইটাই খাঁটি… সমস্ত শুদ্ধতার মানে আসলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব... মানুষ সারাটা জীবন তার হারিয়ে যাওয়া শৈশব খুঁজে বেড়ায় বলে এত গল্প বানাতে হয়…..
আমার কান্না পাচ্ছে…..
কাঁদুন... শৈশব কান্নার বড় কাছাকাছি….. ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদুন... আমি আপনার জন্য লজেন্স নিয়ে আসি….