সারাদিনের স্তবস্তুতি শেষ হয়ে গেল। মন্দিরের ফেলে যাওয়া বাতাসায় ক্ষুধার্ত পিঁপড়ের সারি। সারাদিন জ্বলার পর ক্লান্ত প্রদীপ ঘুমিয়ে পড়েছে কালিমাখা শরীরেই, বাকি আধপোড়া সলতেকে বুকে নিয়েই। পুড়ে যাওয়া ধুপের ছাই ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শুকিয়ে আসা মালা থেকে আসছে অল্প অল্প বাসী ফুলের গন্ধ। দেবতার ঠোঁটে লেগে থাকা সন্দেশের কণার উপর বসে ক্ষুধার্ত অন্ধ মাছি কয়েকটা। শূন্য মন্দির। অনেক রাত। ঘুমন্ত সংসার। মন্দিরের ভিতরে বড় অন্ধকার। বাইরে তারার আলো।
দেবতা ধীরে ধীরে উঠে এলেন মন্দিরের ছাদে। শুকনো মালা পড়ে রইল সিঁড়ির উপর। শুকিয়ে আসা চন্দনের বিন্দুগুলো বড় অবাধ্য, কপালটা জবরদখল করে বসে। চোখের কোলে ধুলো মাখা কাজল টাটিয়ে উঠছে থেকে থেকে।
দেবতা আকাশের দিকে তাকালেন। কি করুণ সে চোখ। আকাশের কান্না পেল, সে ভেজা বাতাস বুলিয়ে দিল দেবতার মুখে, কপালে, চোখে। মুছে নিল সারাদিনের স্তব-মহিমা শ্রবণের ক্লান্তি।
দেবতা তাকিয়ে রইলেন ঘুমন্ত সংসারের দিকে। নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা বুকের মধ্যে ভ্রমরের মত গুঞ্জন করে বেড়াচ্ছে; সে গুঞ্জনে সুর আছে, সুখ নেই। কেউ সারাদিন একবারও জিজ্ঞাসা করল না, "তুমি কেমন আছ?" সজল চোখে দেবতা মুক্তি চাইলেন। কিন্তু কার কাছে জানালেন এ আর্তি? কোনো উত্তর নেই। সমস্ত বিশ্বচরাচর নীরব নিস্তব্ধ।
দেবতা ধ্রুবতারাকে বললেন, অলৌকিকত্ব খোঁজে বিশ্বাসহীন শুষ্ক হৃদয়, নাবিক পথ পায় তোমাতে দৃষ্টি রেখে স্থির।
ধ্রুবতারা বলল, আমায় সেই দেখে, যে তাকায় আকাশের দিকে।
দেবতা বললেন, আমি কি তবে ক্ষণিকের রামধনু?
শুকতারা বলল, ভোর হয়ে আসছে। আপনি মন্দিরের গর্ভে যান। মীমাংসার ভার থাকুক মহাকালের হাতে। কর্তব্যের থেকে চ্যুত হতে পারি না আমরা কেউ প্রভু।
মন্দিরের গর্ভগৃহে শুরু হচ্ছে মঙ্গলারতির প্রস্তুতি।