Skip to main content

রঞ্জিতা গ্লাসের আওয়াজ শুনে চোখ খুলে তাকালো। বিপ্র জল খাচ্ছে। হাতটা কাঁপছে। ঘরে জিরো পাওয়ারের নীল হালকা একটা আলো। বিপ্র শর্টস পরে আছে। খালি গা। শর্টসে একটা ভাল্লুকের মুখ। সাদা ভাল্লুক।

আজ নিয়ে পাঁচদিন হল হানিমুন থেকে ফিরেছে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। বিপ্রদের ধুপকাঠির ব্যবসা। বড় বাজারে দোকান। রঞ্জিতাকে নিয়ে যাবে বলেছে বিপ্র আজই।

রঞ্জিতা মোবাইল অন্ করল। একটা ছত্রিশ।

"তোমার শরীর খারাপ লাগছে? অম্বল?"

বিপ্র ধুম করে জলের গ্লাসটা মাটিতে ফেলে দিল। বিপ্র তার দিকে তাকিয়ে। রঞ্জিতা চশমাটা মাথার কাছ থেকে নিয়ে চোখে দিল।

বিপ্র ঘুরে তার খাটের কাছে এসে মাটিতে বসল। হাঁটু পেতে। বিপ্র'র চোখের চাহনিটা এরকম কেন?

রঞ্জিতা বেড সুইচটা অন্ করল। ঘরে আলো।

বিপ্র চোখটা কুঁচকিয়ে বলল, তুমি আমায় বিশ্বাস করো? করো?

রঞ্জিতা, বিপ্র'র কাঁপা হাতদুটো ধরে বলল, হ্যাঁ করি, কিন্তু কেন? কি হল?

বিপ্র বলল, এমন যদি হয়, তুমি এত সুন্দর আমি বুঝতে না পারি... মানে.. আই মিন আমার মাথায় এমন কিছু একটা হল আমি রেজিস্টার করলাম না... তোমার হাঁটা-চলা, ঠোঁটের রঙ, তোমার সব কিছু আমার কাছে খুব স্বাভাবিক লাগতে শুরু করল... তখন?

রঞ্জিতার এবার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। এসিটা বাড়ালো। বিপ্র'র কপালে ঘামের বিন্দু। বিপ্র'র এরকম চোখ আগে দেখেনি। রঞ্জিতা বিপ্রকে জোর করে ধরে খাটে বসালো তার পাশে। চুমু খেতে চাইল। ভালোবাসায় না। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করতে। বিপ্র এক ঝটকায় মুখটা সরিয়ে বলল, বি সিরিয়াস রঞ্জিতা... আই অ্যাম ডাম সিরিয়াস ম্যান... যদি তোমায় আমার খুব ইউজুয়াল লাগতে শুরু করে... মানে ধরো... আই জাস্ট সি ইউ নেকেড... লিটিল বিট আরলিয়ার.. আই ওয়াজ থ্রিল্ড….সো এক্সাইটেড... এরকম যদি না হয়... মানে আমি যদি এই চার্মটা আর ফিল করতে না পারি….

রঞ্জিতা কি করবে বুঝতে পারছে না। বিপ্র হঠাৎ তার হাত ছাড়িয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে দিল। সে কি বলে যাচ্ছে বিড়বিড় করে। রঞ্জিতা ফোনটা হাতে নিল। শাশুড়িকে কল করবে একটা?

বিপ্র দেখতে পেয়েই ছুটে এসে ফোনটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল, এখন গেম খেলবে তুমি? হোয়াটস অ্যাপ করবে? ফেসবুক করবে? এই এত রাতে? শিট.. শিট... শিট.. আমায় দেবাঙ্কুর বলেছিল.. ডোন্ট ম্যারি বিপ্র...উ ই উইল বি রুইন্ড...

রঞ্জিতা দেবাঙ্কুরকে চেনে। বিপ্র'র মাসির ছেলে। কিরকম একটা। একটু এফিমিনেট। বিয়ে করেনি। কলেজে পড়ায়। গে নাকি, রঞ্জিতার দাদা ওর ফেসবুক পেজ দেখে বলেছিল.. কিন্তু কেন হঠাৎ তার নাম?...

রঞ্জিতা উঠল। বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। ধীরে ধীরে বিপ্র'র কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতটা চেপে ধরল। বলল, বসো.. আমায় বলো কি হয়েছে তোমার... কি লাগছে…?

বিপ্র খাটে আধশোয়া থাকল কিছুক্ষণ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে। তারপর উঠেই রঞ্জিতার চোখের উপর চোখ রেখে বলল, এটা ষড়যন্ত্র.. আমি জানি... কার কারসাজি এটা... এটা চালাকি.. জানি আমি... চিরটাকাল এই করে এসেছে….

বিপ্র বলতে বলতে উঠে গেল। দরজাটা খুলল। বাইরের গরম হাওয়া ঢুকে এলো ঘরে। রঞ্জিতা ধীর পায়ে বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। ধৈর্যের ধীরতা না, আতঙ্কের।

টানা বারান্দা। শাশুড়ি-শ্বশুরের ঘর নীচে। ঠাকুরঘরের পাশে। বিপ্রকে দেখা যাচ্ছে ওদের ঘরের দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। আলো জ্বলল। শাশুড়ি বেরোলো। বিপ্রকে ওর বাবা হাত ধরে টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। শাশুড়ি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাকে খুঁজছে। এবার উপরের দিকে তাকিয়ে তাকে দেখেই স্থির হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে ঢুকে, খানিক বাদেই বেরিয়ে, দরজাটা ভেজিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে শুরু করল।

রঞ্জিতা স্থির দাঁড়িয়ে। শাশুড়ি এসে দাঁড়ালো। হাতে একটা কৌটো। রঞ্জিতার হাতে দিয়ে বলল, ওর ওষুধ, এক'দিন মিস গেছে। ডাক্তারের বারণ আছে, মিস যেন না যায়। তুমি দেখো।

রঞ্জিতার মাথাটা ছুটির পর স্কুলমাঠের মত ফাঁকা। বাক্সটা হাতে নিল। শাশুড়ি ফিরে যাচ্ছে। নীচ থেকে কান্নার আওয়াজ। বিপ্র'র গলা। অচেনা, তবে আন্দাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে না।

রঞ্জিতা নিজের কাঁপা গলাকে যতটা সম্ভব শক্ত করে বলল, দেবাঙ্কুরদার সঙ্গে…

শাশুড়ি ফিরে দাঁড়ালো। আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কি আশ্চর্য লাগল শাশুড়িকে দেখতে রঞ্জিতার। সবচাইতে আশ্চর্য লাগল নিজেকে দেখে। এই সময়েও তার শাশুড়ির উপর যেন করুণা হল। একই বারান্দায় দু'জনে দাঁড়িয়ে যেন, দু'প্রান্তে। আলো আঁধারিতে।

শাশুড়ি বলল, তুমি আটকিয়ো পারলে.. আমার এর থেকে বেশি কিছু করার ছিল না... টাকার অভাব ছিল না... চিকিৎসার খামতি করিনি…. কিন্তু কপাল..

রঞ্জিতা বলল, আপনি সর্বনাশ করলেন... সব শেষ করলেন…. তিনটে জীবন….

শাশুড়ি ফিরে এসে দাঁড়ালো মুখোমুখি। বলল, জানি। তবে আমাদের দু'জনকে ধরলে না। আমাকে আর ওর বাবাকে। সর্বনাশ আমাদের যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি শেষ ভরসা... দেখো….

রঞ্জিতা ওষুধের বাক্সটা নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বিকট আওয়াজ হল। শিশি ভাঙল হয় তো। বেড়াল একটা পাঁচিল ডিঙিয়ে পাশের বাড়ি চলে গেল। রঞ্জিতা দাঁত চেপে বলল, আপনারা পাগল!!

শাশুড়ি যেতে যেতে ফিরে তাকালো। বলল, বিচিত্র কিছু না... পাগলের মা তো... আজ ও নীচেই শোবে…. তুমি শুয়ে পড়ো... যদি ক'দিন বাবা-মায়ের ওখান থেকে ঘুরে আসতে চাও... যেও... আটকাবো না... তবে তোমার মা জানেন সবটা…. উনি বলেছেন তোমার বাবারও এ সমস্যা ছিল... উনি ঠিক করেছেন।…

রঞ্জিতার মাথাটা স্কুলের ফাঁকা মাঠে যেন হঠাৎ আসা কালবৈশাখী ঝড়ের মত হয়ে গেল। সব এলোমেলো। পুরোনো খাতাপাতা, ডাস্টার, চকের গুঁড়ো, স্কেল সব ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। বাবার মুখ, মায়ের মুখ, চাপা দেওয়া সব ঘটনারা, কান্নারা, অশান্তিরা সারা মাথা ফিসফিস করে কথা বলছে। সবাই সব জানে... সব জানে…. সব জানে….

রঞ্জিতা আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। এসিটা অন। দরজাটা খোলা। গরম হাওয়া আসছে। আসুক।