সৌরভ ভট্টাচার্য
7 May 2019
হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। অন্যমনস্ক ছিলই। আজকাল কাউকে মিথ্যাকথা বলতে ভালো লাগে না। ক্লান্ত লাগে। একঘেয়ে লাগে সব। অনেকগুলো মেল জমে আছে, উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। উত্তর দেওয়া মানেই মিথ্যাকথা লেখা। বানানো কথা লেখা।
গঙ্গার ধারটা গুমোট লাগছে। জামার উপরের দিকের কয়েকটা বোতাম খুলে দিল পরিমল। মাঝবয়েসী পুরুষ। বয়েসটা গায়ের সাথে ঘামের মত লেগে থাকে। যদিও পরিমল নিজেকে বয়েসের সাথে মেলাতে পারে না। লঞ্চ থেকে ছেলেগুলো লাফ দিয়ে যখন মাঝগঙ্গায় পড়ে তারও লাফ দিতে ইচ্ছা করে, স্কুলের ছেলেগুলো যখন নিজেদের গার্লফ্রেণ্ডদের সাইকেলের সামনে নিয়ে অথবা একহাতে সাইকেল আরেকহাতে মেয়েটার হাত ধরে হাঁটে, তারও ইচ্ছা করে। অথচ এগুলোর একটাও ইচ্ছা করার বয়েস তার নয়। আবার যখন এরকম লাগে, চাকরিবাকরি ঘরদোর সব ছেড়ে কোথাও বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে, তখনও তার আশেপাশে আওয়াজ ওঠে – এই বয়সেই বৈরাগ্য! কিন্তু পরিমলের এর সবক'টাই জেনুইন ইচ্ছা। বয়েসের সাথে এদের কি সম্পর্ক? বয়েসটা আসলে একটা মিথ। মানুষের মনের ডেভলপমেন্ট নিশ্চয় অন্য কোনো এককে মাপা উচিৎ। সংখ্যায় তো কখনোই নয়।
মাথার পিছন দিকটা ধরে আছে। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে গঙ্গার ঘাটের একদিকে নেমে এল। উত্তর কলকাতার গন্ধটা দক্ষিণের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে অবশ্য এদিকে কোথাও থাকে না। তার বাড়ি বারাসাত। পৈতৃক বাড়ি। এখানে একটা ওষুধের কোম্পানীতে ডেস্ক জব তার। বারো বছর হল। ভালোও লাগে না, খারাপও লাগে না।
গঙ্গার ওদিকে বিদ্যুৎ চমকালো মনে হল। ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। মানে ট্রেনের গোলমাল, পৌঁছাতে দেরি। হোক গে। রাস্তার ধারে লাইন দিয়ে ঝুপড়ি। মানুষ কিভাবে ওর মধ্যেই কাটিয়ে দেয় সারাজীবন ভাবতে বিস্ময় লাগে। পরিমল গঙ্গাকে পিছনে রেখে রাস্তার সোনালী স্ট্রিট আলোয় ঝুপড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে। এইভাবে মানুষ কেন বেঁচে থাকে? অপশান নেই বলে নাকি অভ্যাস হয়ে যায়? মন একটু যেন ভালোর দিকে এগোচ্ছে পরিমলের। বিষণ্ণতাটা কাটছে। এরকম হয়। এই মানুষগুলো তাকে ভাবায়। আজও ভাবাচ্ছে। তার সমাজসংস্কারক হতে ইচ্ছা করে না। অনেকে যেমন মাঝে মাঝে এদের দানধ্যান করে, তাও খুব একটা দাগ কাটে না, কারণ সে সুখ তো ক্ষণিকের। আসলে সবাই বাঁচতে চায়। যেটুকু পায় তারই মধ্যে বাঁচতে চায়। মানুষ অসুবিধা মেনে নেয়, কিন্তু অবমাননা মানতে পারে না। পরিমল নিজেকে দেখে বোঝে। তার পিসেমশায় যখন রাঁচির কোম্পানিতে তাকে ডেকেছিল সে এই কারণেই যায়নি, কি হবে গিয়ে?
পরিমল তখন ছোটো। বাবা মারা গেল। তার মা সামান্য একটা কাজ পেল বাবার কোম্পানিতেই। তার পিসি তখন অবিবাহিত। মায়ের সাথে কোনোদিন ভালো ব্যবহার করত না। এর মধ্যে পিসির বিয়ে হল। পরিমল ছোটো থেকেই দেখত পিসেকে মা একটু এড়িয়েই চলে। তার দেওয়া জামা তার সামনে একবার পরিয়ে রেখে দেয়, পরায় না। ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইলে মা এড়িয়ে যায়। অনেকবার করে তাদেরকে রাঁচিতে যাওয়ার কথা বলত পিসে। এমনকি একবার ট্রেনের টিকিট কেটেও পাঠিয়ে দিল পুজোতে, মা গেল না। পরিমল তখন নাইনে পড়ে, কি প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল তার মায়ের ওপর। খাওয়া বন্ধ করে দিল দু'দিনের জন্য। মা কাঁদল খুব। কিন্তু গেল না। পরিমল আজ বোঝে। তার পিসে ভালো ছিল না। খুব বড়লোকের দুশ্চরিত্র ছেলে ছিল। পিসিও সুখী নয়। যেদিন সে চাকরিটা নেবে না বলে জানিয়ে দিল, সেদিন তার পিসি মাঝরাতে তার ঘরে এসে খুব কেঁদেছিল, তাকে আদর করেছিল। বলেছিল তার মায়ের যোগ্য ছেলে হয়েছে সে। কিন্তু ততদিনে তার মা কোথায়? মারা গেছে যে।
পরিমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উদাস লাগছে। ঘড়ি দেখল। এখনই যদি বেরোয় তবে কালকা মেলটা পেয়ে যাবে। মোগলসরাই নেমে বেণারস চলে যেতে পারে। তার ভীষণ ভালো লাগে বেণারস শহরটায় একা একা হাঁটতে। নিজের সাথে নিজের মনে মনে গল্প করতে। বাবা খুব শিবভক্ত ছিলেন। মা-ও। সে নিজেকে বুঝতে পারে না। কিন্তু বেণারসের রাস্তাটা তাকে টানছে। গলিগুলো তাকে টানছে। খুব চেনা শহরে নিজেকে হারানো যায় না, অচেনা শহরে খুব সহজেই যায়। নিজেকে নিজের কাছে আর ভারি লাগে না। অসহ্য লাগে না। নিজের চিন্তাগুলো আর গোলগোল ঘোরে না একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। কত মানুষ। কত রকম আদবকায়দা। বিশ্বাস। সন্দেহ। চালাকি। সমর্পণ। সব পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। পরিমলের ওলা বুক করা হয়ে গেছে।
ব্যস্ত হাওড়া স্টেশান। সব সময় ব্যস্ত। মানুষের কত বিচিত্র গন্তব্য হতে পারে হাওড়া স্টেশানে এসে দাঁড়ালে যেন বোঝা যায়। পরিমল এয়ারপোর্টে গেছে। কিন্তু এত বিচিত্র শ্রেণীর মানুষের ভিড় সেখানে কই? সেখানে সব কিছু ফিল্টার্ড। এখানেই আসল ভারত। আসল সমাজ। সহস্র মানুষ। নানা শ্রেণীর মানুষ। প্ল্যাটফর্মের মেঝে থেকে শুরু করে উচ্চশ্রেণীর প্রতীক্ষালয়ে থাকা মানুষ। সবার গন্তব্য রেলের লাইন ধরে কোথাও একটা। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রেণী। কেউ একটু আরামে, কেউ একটু বেশি আরামে, কেউ যায় বিনা রিজার্ভে লড়াই করতে করতে। শুধুই কি লড়াই? সে শুধু সিট পাওয়ার আগে অবধি। তারপর যেই ট্রেন ছাড়ল, চেনা শহর, চেনা লোকালয় ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে ছুটতে শুরু হল। তখন সেই লড়াই করা মানুষগুলোই একে অন্যের সাথে কথা বলতে শুরু করবে। "কোথায় যাবেন? বাড়িতে কে কে আছে? .." এই দিয়ে শুরু। তারপর রোগের কথা, বাড়ির লোকের কথা, ভালোবাসার কথা, রাগের কথা, মানঅভিমানের কথা, স্নেহের কথা, মন খারাপের কথা... এসব বলতে বলতে চোখ ভিজবে, হাসির রোল উঠবে, খাওয়ার বিনিময় হবে... মানুষ এভাবেই তো বাঁচে... ভালোবাসায় বন্ধুত্বে লড়াইয়ে প্রতিযোগিতায়... তারপর হঠাৎ করে সব শেষ... যেন স্টেশান এসে গেল... মন খারাপের তল্পি গুটিয়ে চোখের জলের টাল সামলিয়ে নতুন রাস্তায় আবার হাঁটা।
পরিমল থমকে গেল। তার সামনে কিছুটা দূরে কে বসে? পিসি না? পরিমলের ঘোরটা এক মুহূর্তে কেটে গেল। পিসি এখানে কেন? একি চেহারা হয়েছে পিসির? পরিমল ধীরে ধীরে পিসির পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রায় দশ বছর পর দেখা হচ্ছে। যে মানুষটা মোটা থলথলে চেহারা নিয়ে একটা চেয়ারে বসতে পারত না, সে এরকম শুকিয়ে দড়ি হয়ে যাওয়া চেহারাটা নিয়ে কিরকমভাবে গুটিয়ে দলা পাকিয়ে বসে! ঘুমাচ্ছে?
পরিমল কাঁধে হাত দিয়ে ডাকল, পিসি?
চোখটা খুলে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বনানী। তারপর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুই? কেমন আছিস রে? কোথায় যাচ্ছিস?
পরিমল পাশের চেয়ারটা ফাঁকা হলে বসে পড়ল। তার হাতটা এত শক্ত করে ধরে কেন পিসি? হাতে কিসের দাগ এগুলো? কালশিটে?
সে কি বুঝল জানে না, কিন্তু অজান্তেই বলল, কাশী যাচ্ছি, যাবে? বনানী একটু চুপ করে রইল। কোনো কথা না বলে, মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ। মুখটা অন্যদিকে ফেরানো। পরিমল বুঝল সে কাঁদছে। তার কাঁধের ব্যাগটা তার কাছে দিয়ে বলল, তুমি বসো, আমি এখনই টিকিট কেটে আনি একটা।
পরিমল টিকিট কেটে এনে দেখে পিসি নেই। একজন বয়স্কা মানুষ তার ব্যাগটা ধরে বসে। সে আসতেই বলল, আপনার নাম পরিমল বসু তো? উনি এই ব্যাগটা আমার জিম্মায় রেখে... আমি অন্যের ব্যাগ নিই না... আজকাল বোমটোম... তবে এমন করে বললেন... মায়া লাগতে লাগল...
পরিমল কিচ্ছু শুনছে না... কান্না পাচ্ছে... এভাবে সে হারাতে পারে না পিসিকে...
মাথার মধ্যেটা কেমন গুলিয়ে গেল। উন্মাদের মত এ প্ল্যাটফর্ম সে প্ল্যাটফর্ম ছুটতে ছুটতে দেখল দূরে একটা লোকাল ট্রেনের জানলায় বসে বনানী। উদাস তাকিয়ে। পরিমল ছুটল। কয়েকটা ভুল বগি উঠতে উঠতে পেয়েও গেল... হাতটা ধরে বলল, ওঠো... বনানী কিছু বলল না। হাসল। অবুঝ দুর্বোধ্য হাসি।
পিসি ভাইপো ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। কাশীতেই গেল। ফিরেও এসেছিল। তবে পিসি ফেরেনি। পিসির গল্পটা নতুন কিছু নয়, তার স্বামী এইডস এ মারা যায়, তার নিজের শরীরেও একই জীবাণু পাওয়া যায়। লজ্জায়, অপমানে সে কলকাতায় চলে আসে। ঝোঁকের মাথাতেই। তারপরেরটা তো আমরা দেখলাম। কাশীতে যে গল্পটা শেষ হবে সেই নিদারুণ উপাখ্যানটার বর্ণনা নাইবা করলাম। কিন্তু মৃত্যুর প্রাক্কালে পরিমল সেখানে ছিল। তিনি একটা কথাই বলে গিয়েছিলেন, তার মায়ের কাছে ক্ষমা না চেয়ে সে স্বর্গে গিয়েও শান্তি পাবে না।
পরিমল জানে মানুষ সুখে শান্তিতে বাঁচে না। মানুষ বাঁচে মানুষেই। নয় অভিমানে নয় ভালোবাসায়৷ অবশেষে ক্ষমায়, শান্তিতে সে অজানা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চায়, নিরুত্তাপ চিত্তে।