Skip to main content
অন্তর্লীন


 


---

তিন্নির বয়স এখন আট। রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় পুকুরটার ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের গ্রামের এটাই সবচেয়ে বড় পুকুর। পুকুর ঘিরে গাছগুলোকে দেখতে দেখতে সে যেন তার ভাইয়ের কাছে পৌঁছে যায়। কখনো কখনো স্কুলে না গিয়ে পুকুরের পাড়ে বসে। জামা ভেজে ভেজা মাটিতে, সে ভাবে, ভিজুক। তারপর পুকুরের পাড়ে বকগুলোকে দেখে। জলের মধ্যে হেলেসাপ, মাছ, পানকৌড়ি দেখতে দেখতে তার মনে হয় ওরা সব তার ভাই টুবুকে চেনে। তিন্নি ওদের সাথে কথা বলে। ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করে। মনে হয় এই বুঝি তার ভাই জলের ভিতর থেকে উঠে এসে, 'তিন্নি' বলে তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। লোকে বলে তার ভাই এই পুকুরে ডুবে মারা গেছে। বোকা ওরা। জলে এত কিছু বেঁচে আছে আর তার ভাই মরে যাবে? তা কি হয়? তা হলে মাছ, সাপ এরা কবে মরে যেত।
     তা হলে টুবু আসে না কেন? ও কি নতুন কোনো বন্ধু পেয়েছে জলের তলায়? সে কি তিন্নিকে ভুলে গেছে? এসব ভাবতে ভাবতে তার খুব অভিমান হয়। সে উঠে পড়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য। ধুর আর আসবে না, ভাই কোনো কথাই বলে না। দুদিন সে পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। রাগে না, কষ্টে। তারপর যেই একটা প্রজাপতি তার গায়ে বসল পুকুর ধার থেকে অমনি তার রাগ পড়ে গেল। সে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পুকুরের জলে। ভাইয়ের সাথে ভাব আবার। ভাই যে প্রজাপতিটাকে পাঠালো, ভাব করার জন্য।


---

     এখন সে তিন্নি না। তিয়াসা। কলেজে পড়ে। সে জানে টুবু আর নেই। না এটা সে মানে না। এই তো টুবু। পুকুরটার ছলছল জল টুবুর চোখের মত। পাড়ের ধার দিয়ে গাছগুলো যেন টুবুর হাত পা। তিয়াসা এখনো মাঝে মাঝেই পুকুরের ধারে বসে, বিশেষ করে কলেজ না থাকলে।
     আজ সে খুব কাঁদছে পুকুরের ধারে বসে। সে বলছে কি করে সঞ্জুর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল দুবছর পরে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকে খুব ব্যথা। রাতে ঘুমাতে পারছে না। সব বলছে তিয়াসা। একটু পরেই একটা দমকা হাওয়ায় বেশ কিছু আমপাতা তার গায়ে এসে পড়ল। সে জানে টুবু সব শোনে তার কথা। ওই তো পুকুরের জলটায় হঠাৎ কেমন ঢেউ খেলে গেল। তিয়াসা পুকুরের জল আঁচলা করে নিয়ে তার চোখে-মুখে দিল। বুকের কোণায় একটা শান্তির অনুভুতি হল।


---

তিয়াসা এখন দুবাইতে। তার দুটো বড় বড় ছেলে। বহু বছর পর সে এসেছে দূর্গাপুজোয়। বাড়িতে কেউ নেই। জমি জায়গা বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে সে দুবাইতে চলে যাবে।
     গ্রীষ্মের বিকাল। তিয়াসা না সে এখন। তিয়াসাদেবী। তার মাথার চুলে পাক ধরেছে। পুকুরের পাড়ের হাওয়ায় উড়ছে সে চুল একটু একটু করে। তার বড় নাতিটা তাকে খুব বোঝে। পলাশের বয়স এখন আট। সে ঠাকুমার কোলে হাত রেখে চুপ করে বসে আছে টুবুদাদুর দিকে তাকিয়ে। হ্যাঁ তো, এই পুকুরটাই তো টুবুদাদু, ঠাম্মি বলেছে। সে দেখছে ঠাম্মির চোখের থেকে জল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। ঠাম্মি হাঁটুতে মাথা দিয়ে কাঁদছে। সে বলল, ঠাম্মি কেঁদো না। এই দেখ আমি ওয়াটার বোতল এনেছি। দাদুকে নিয়ে যাব আমাদের সাথে।
     তিয়াসা পলাশকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, না দাদুভাই, দাদু এখানেই থাক। ওর ছোট জায়গায় কষ্ট হবে যে, তাই না!
     পলাশ বলল, হুঁ।
    তিয়াসাদেবী চোখ মুছে উঠে বললেন, আসি রে টুবু। আর হয়তো দেখা হবে না রে। ভাল থাকিস। তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেললেন হাউ হাউ করে।
    একটা কাঠবিড়ালি আচমকাই পলাশের গায়ে উঠে পড়ল। পলাশ বলল, দেখো ঠাম্মি স্কুইরেল!



---

শীতের দুপুর। বহুবছর পার হয়ে গেছে। একজন সুদর্শন পুরুষ পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে। একটা ছোট্ট চারাগাছ হাতে।
     একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, গ্রামে নতুন বুঝি?
     ছেলেটির যেন ধ্যানভঙ্গ হল। সে বলল, "হ্যাঁ, আমি পলাশ। দুবাইতে থাকি।"
    তারপর নিজের থেকেই বলল, "আমার ঠাকুমা মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন এই গাছটা যেন এখানে পোঁতা হয়, এটা গাছটা উনি খুব যত্ন করে লাগিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে, তারই চারা।"

    এখন চারাগাছটা অনেক বড়। তার ছায়া পড়ে পুকুরের জলে। পুকুরের জলের ঢেউ লাগে গাছটার গোড়ায়। পুকুরের জলে ডুব দিয়ে পানকৌড়ি বসে গাছটার ডালে। রোদে ডানা শোকায়। আর বাতাস গাছের পাতাগুলো দুলিয়ে, পুকুরের জলে ঢেউ খেলিয়ে ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে। 


(ছবিঃ সুমন দাস)