Skip to main content

পুরো সংসারটা ছেদরে যাচ্ছে। কিচ্ছু মনের মত হচ্ছে না। কিচ্ছু না। বাঁচাটা কেমন যেন প্ল্যাটফর্মের শেডের মত হয়ে গেছে। এ সে এসে দাঁড়াচ্ছে, চলে যাচ্ছে। সবাই ঠকাচ্ছে। কেউ নেই এমন একজন যে ক'টা মনের কথা খুলে বলা যায়।
পার্কের বেঞ্চে বসে আছেন রজনীবাবু। অঙ্ক করাতেন মাধ্যমিক ক্লাস অবধি স্কুলে। গেল বছর রিট্যায়ার করেছেন। হঠাৎ পাশে একটা ছেলে এসে বসল, চ্যাংড়া ছেলে। দেখেই মাথাটা জ্বলে গেল রজনীবাবুর, একটা খিস্তি দিলেন মনে মনে। শাঁখ বাজল সামনের ফ্ল্যাটের থেকে, সন্ধ্যে দিচ্ছে। ন্যাকামি যত, নিজের মা-বাবাকে দেখে না, এদিকে ধম্মকম্ম। কেন গাল পাড়ছেন? জানেন না। ইচ্ছা করছে গাল পাড়েন। এই সামনের বাচ্চাদের স্লিপের মাথায় উঠে দাঁড়িয়ে, ন্যাংটো হয়ে সবাইকে প্রাণ খুলে খিস্তি দিয়ে, এর ওর মাথায় হিসু করে দিয়ে কাশী চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কাশী কেন? না, কাশীই হতে হবে তেমন কোনো মানে নেই, গেলেই হল। মোট কথা পালালেই হল। এমন জায়গায় যেন নিজেকে আয়নায় দেখলেও নিজের অচেনা লাগে।
রজনীবাবু নিজেকে এখন উদো কাত্তিক বলে ভাবছেন। উদো কাত্তিক কে? কেউ নয়, একটা মানুষ। যে কেউ একটা এলেবেলে মানুষ।

- স্যার তখন থেকে কি বিড়বিড় করছেন?
- তুই কে বে? ঠিক এই কথাটাই জিভের গোড়ায় এসে গিয়েছিল, সামলে নিয়ে বললেন, আমার ছাত্র ছিলে বুঝি?
- হুঁ
- এখন কি করো?
- বেকার
কি বলবেন এখন? “বাহ! কি ভালো তুমি চাকরি পাওনি...”। মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে চলে যাবেন? নিজেকে কেমন একটা অপরাধী অপরাধী লাগছে, পড়িয়েছেন যখন তখন কিছুটা দায় তো বর্তায়। এটা কি তার ইনিফিওরিটি কমপ্লেক্স? মনে হচ্ছে তাই। যা হোক, কেন চাকরি পাওনি?

- হল না... জেনেরাল কাস্ট...
- অ, তা ঠিক নয়, জেনারেল কাস্ট কত চাকরি পাচ্ছে তো?
- সরকারি? আপনি আপনার চেনা এক্ষুণি ক'টা নাম বলুন
- থাক, ওসব কথায় অন্যের যোগ্যতাকে ছোটোচোখে দেখা হয়...
ছেলেটা কিছু একটা বিড়বিড় করে বলল, রজনীবাবু ওরফে উদো কাত্তিকের ছেলেটার ঠোঁটের চলন দেখে মনে হল খিস্তি দিল – বাল।
দারুণ শব্দ। রজনীবাবু যখন উদো কাত্তিক তখন তিনি বিশ্বের সেরা সেরা গালাগালগুলো দিয়ে গান করেন। এমনকি এবারের বর্ষায় মিঞা মল্লার আর গৌড় মল্লার মিশিয়ে তার কালেকশানের সমস্ত গালাগালগুলো দিয়ে একটা বন্দীশ তৈরি করে গেয়েছেন। আহা, চোখে জল এসে গিয়েছিল। ছেলেটা এখন যেমন বলল, বাল... উদো কাত্তিকের এখন এই সন্ধ্যায় ছেলেটাকে এই শব্দটা দিয়ে পুরবীতে একটা আলাপ করে শোনাতে ইচ্ছা করছে। থাক, ছেলেটা ঘাবড়ে যাবে। যেই জিভে অঙ্ক শুনেছে সেই জিভে খিস্তি শোনা কি উচিৎ? কিন্তু এত ফ্রাস্ট্রেশান কেন জীবনে? ভারতে নাকি দশ জনের মধ্যে ছ'জন প্রায় ডিপ্রেশানে ভোগে। এই যেমন তিনি আর ...

- এই তোমার নাম কি?
- বিপ্র, বিপ্র মুখার্জী।
সদ্য বিড়ি খেয়ে এসেছে ছেলেটা। বিড়ি খাওয়া মানুষ আর সিগারেট খাওয়া মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, বিড়ি খাওয়া মানুষ কম মিথ্যা কথা বলে, এরকম একটা কথা মনে হয় রজনীবাবুর। কেন মনে হয়? কোথাও পড়েছেন? না অভিজ্ঞতা বলে। অভিজ্ঞতা মানে সচেতন প্রচেষ্টাবিহীন স্ট্যাটেস্টিক্স। মনের পাতা উল্টে যাও, দেখো তোমার অজান্তেই তুমি কত সিদ্ধান্তকে পাকা করে বসে আছো। মানুষ বিশ্বাস থেকে চিন্তা করে, বিশ্বাসটাকে নিয়ে চিন্তা করে না। যদি করত তবে এত মূর্খামি থাকত না সভ্যতায়।

- কি নিয়ে পড়েছ?
- ইতিহাসে এম এ, তারপর বি এড...
- আচ্ছা শিক্ষকতার ইচ্ছা, বেশ...
কবে যেন শেষবারের স্কুল সার্ভিস হল মনে করতে পারছেন না রজনীবাবু। নিজের ছেলেকে নিয়ে অবশ্য চিন্তা নেই, ছেলে ইঞ্জিনিয়ারীং পড়ে এখন বাইরে আছে, দেদার টাকা।
হঠাৎ মুষড়ে গেলেন রজনীবাবু। কি বিচ্ছিরি হল না ব্যাপারটা, যেই নিজের ছেলেকে সিকিওর লাগল অমনি একটা কেমন বিচ্ছিরি আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন? এটা নীচ মানসিকতার লক্ষণ। এত নীচ হলে তিনি উদো কাত্তিক হবেন কি করে?

- আচ্ছা, তা তুমি আর কিছু ট্রাই করছ না কেন?
- মানে বিড়ি ছাড়া অন্য কোনো নেশা, গাঁজা, মাল, ড্রাগ... এরকম? না চপ ভাজা, বিড়ি বাঁধা...
বমকে গেলেন রজনীবাবু আর উদো কাত্তিক এক সাথেই। ছেলেটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে, নইলে উচ্চারণে কেমন একটা আলগা আলগা টান কেন। ভালোবাসা নেই, ভরসা নেই জীবনে আর। আত্মহত্যা করবে হয় তো কাল, বা আজ রাতে। কাল খবরের কাগজে ছবি বেরোবে... না না... আজকাল এসব এত আখছার হচ্ছে যে ছবি ছাপে না, শুধু একটা ছোটো খবর ভিতরের পাতায় ছাপা হবে, “মানসিক অবসাদে ভুগে গলায় দড়ি লিলুয়ার গোবিন্দপাড়ার এক যুবকের”। তার ঠিক নীচে “এলো শীতের রুক্ষ শুষ্ক দিন”... গ্লিসারিন হাতে স্নান করতে যাওয়া একটা মেয়ে, টাওয়েল জড়ানো। মানুষ মেয়েটাকে দেখতে দেখতে ভুলে যাবে কার যেন অবসাদ, কার যেন মৃত্যু।

- এই তুমি চপ খাবে?
- খাওয়ালেই খাব
রজনীবাবু উঠে গেলেন মাঠের মোড়ে বিষ্ণু'র চপের দোকানে। চারটে গরম গরম আলুর চপ, ঠোঙাটা তেল চপচপে হয়ে যাচ্ছে, এই তেল ধমনীতে জমলেই ক্যাঁচাল। বুকের যন্ত্রটা ধড়াস করে বন্ধ হয়ে মারা যাবেন। কোলেস্টেরলটা চেক করতে হবে।
এদিকটা অন্ধকার, কারণ পার্কের এদিকের সবক'টা লাইট ভেঙে দিয়ে যায়। কারা? যাদের পরিত্যক্ত কণ্ডোম মাঠের এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায় তারা।
ছেলেটা একটা জিন্স আর লাল টি-শার্ট পরে বসে আছে দূরের দিকে তাকিয়ে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এককালে জিম করত মনে হচ্ছে, বেশ চেহারা। চুলগুলো এলোমেলো। ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ধরো...
ছেলেটা নিল, গরম চপের সামনেটা কামড়ে বলল, থ্যাঙ্কস... দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। ছেলেটার জিভ প্রচণ্ড খিদের সাথে গরমের সমঝোতা করছে চপের টুকরোটা নাচিয়ে নাচিয়ে। জীবন নাচায়। আমরা নাচতে চাই নাচায়। নাচ সংসারের অভিব্যক্তি। নৃত্যের তালে তালে... নটরাজ অকারণ নাচতেন কেন?
একটা বড় ইলিশের টুকরো পেটে ডিগবাজী খেল রজনীবাবুর, দুপুরে খেয়েছেন। যদিও বারণ। তবু খেয়েছেন। মায়া হল ছেলেটার জন্য। বাবা কি করেন?
- নেই, মারা গেছেন, ছোটোবেলায়, মা নার্স, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, মায়ের চাকরি আর এক বছর... টাকাপয়সা মোটামুটি আছে, একতলা বাড়ি নিজেদের, এসি নেই, ফ্রীজ আছে ডাবল ডোরের একটা, একটা স্কুটি আছে, মা নিয়ে বেরোয়। আর কিছু?
থতমত খেয়ে গেলেন রজনীবাবু। তাই তো! একটা মানুষকে তো এতসব নিয়েই জানতে হয়। মানুষের আভা, তার উজ্জ্বল সম্পদ।
- আচ্ছা, বলে রজনীবাবু চুপ করে বসে গেলেন। ছেলেটা মনে হচ্ছে সবক'টা চপ নিজেই খাবে। খাক, খায়নি আজ দুপুরে কিছু। কিন্তু দুপুরে ভাত খাবে নাই বা কেন? না খেলে কি চাকরি মিলবে? আর মা’টা কষ্ট পাবে না হাস্পাতাল থেকে ফিরে এসে? আচ্ছা হাস্পাতাল কেন? নার্সিংহোমও তো হতে পারে। ছেলেটা এই ডিটেলিংটা মিস করেছে। জিভটা টাটাচ্ছে, চপের গন্ধে। উফ্..., কি চকাম চকাম করে চপ চিবোনো বাপু, এই খালি পেটে কেউ চপ খায়, অ্যাসিড হবে না?
- এই নিন, ছেলেটা একটা চপ বাড়িয়ে দিল।
কিছু বলার আগেই ছোঁ মেরে চপটা হাতে নিয়ে বললেন, একটু মুড়ি আনব?

- হ্যাঁ আনুন।
       কি হাড়বজ্জাত ছেলে রে বাবা... আরে আমি তো ভদ্রতা করে...
       যা হোক... মাঠের থেকে বেরিয়ে রাস্তার মোড়ে গিয়ে মুড়ি নিয়ে এলেন দুটো ঠোঙায়। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল, বসুন। আর জ্বালাব না।

- তা তুমি প্রাইভেটে চেষ্টা করছ না কেন?...
- নো জ্ঞান প্লিজ... মুড়ি-চপ বেটার চয়েস স্যার...
- আচ্ছা। এখন কি বলবেন? কি বলা উচিৎ? যাই বলবেন বড্ড নাটকীয় হয়ে উঠবে না? থাক, কিছু বলার দরকার নেই। রজনীবাবু উঠলেন। চা তেষ্টা পাচ্ছে। ছেলেটাকে 'আসছি' বলে এমন একটা ভাব নিয়ে উঠলেন যেন নিজের কাছে নিজেই অপরাধী। সমাজে অনেকরকম অপরাধবোধ জন্মায়। নিজের অজান্তেই জন্মায়। গাম্বাটদের জন্মায় না।
অনেকটা রাস্তা আসার পর মনে হল, আচ্ছা ও যদি কিছু একটা অঘটন ঘটায়? আবার যাবেন? হ্যাঁ যেতেই হবে, যতই নাটকীয় শোনাক, কয়েকটা কথা বলতেই হবে। জীবনের উপর বিশ্বাস হারাতে নেই, কিন্তু উদো কাত্তিকের কি হবে? সে তো মাল পুরো ফ্রাস্ট্রেটেড... হোক, মনের জোয়ার-ভাঁটা আছেই, তা বলে মরতে হবে? মরার কথা ভাবা যেতেই পারে। সবাই ভাবে। কিন্তু অমন ধুম্ করে মরে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়, যেটা হওয়ার সেটা হবেই। কিন্তু এসব দার্শনিক কথা ছেলেটা শুনবে? তবু একটা অ্যান্টাসিড কিনে গেলেন পার্কের দিকে।
ছেলেটা নেই পার্কে, একটা বুড়ো বসে আছে। কাছে গেলেন রজনীবাবু, লোকটা পুরো মাল খেয়ে টাল। এ কে রে? হঠাৎ লোকটা রজনীবাবুর হাতটা খামচে ধরে বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে বলল, এই যে শ্যালা, সারাদিন মাল খেয়ে টো টো করে আমার বউকে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াও?
মনে হচ্ছে মানুষটা শ্রমিক। বা রিকশা চালায়। ছি ছি রজনী! নো শ্রেণীবৈষম্য, তুমি না কাস্তেহাতুড়িতে ভোট দিয়ে আসছ চোখ বন্ধ করে এতটা কাল?

- এই যে চাঁদু, আমার বউ তোমায় কি বলে ডাকে? ডার্লিং?
- উফ্..., না না, আমি সে নই দাদা, আমি আপনার বউকে...
- ইয়ার্কি হচ্ছে? মানছি আমি তুমি দু'জনেই সাম্যবাদী... আমরা ধনের সমবন্টনে বিশ্বাসী... তা বলে আমার বউ...! সেকি সম্পদ...?
       ছ্যা ছ্যা... একি কথা রে বাবা... তবে তো শিক্ষিত লোক... তবে কেন...ক্ষমতা হারানোর শোক? কিন্তু সে 'কেন' কি আর জানা যাবে? আর যখন ইনি জানাবার অবস্থায় থাকবেন তখন কি আর লজ্জায় সামনে দাঁড়াতে পারবেন...
- এই তুমি আমার বউকে কি বলে ডাকো বলো না গো... কিভাবে আদর করো?
- নাহ্, আর বসে থাকা নয়, কথার গতিক সুবিধের নয়... এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে প্রায় দৌড় লাগালেন রজনীবাবু... একপাটি চটি পা থেকে খুলে মাঠে থেকে গেল। সে যাক, আগে বাড়ি... একটা টোটো ডেকে উঠে পড়লেন...
পরেরদিন সকালে পেপার খুলে উৎকণ্ঠা নিয়ে পড়তে বসলেন। একটা আত্মহত্যার খবর বেরিয়েছে, তবে পার্ক সার্কাসের। কিশোর, গেম খেলতে না পারার শোকে। পেপার‍টা মুড়ে রাখলেন।
বাইরে বেশ চড়া রোদ। একটা টোটো করে পার্কে গেলেন, পকেটে অ্যান্টাসিডটা। চটিটা নেই। বেঞ্চে একটা কুকুর শুয়ে আছে। ভারতের বহু মানুষ অবসাদে ভুগছে। মাঠের মাঝখানে রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন রজনীবাবু। চারদিকে এত বড় বড় ফ্ল্যাট। কত মানুষ? কত অচেনা মানুষ! মানুষের আসল অসুখটা কোথায়? বিচ্ছিন্নতাই যেন অসুখ। তার যেদিন খাদ্যনালীর ক্যান্সার ধরা পড়ে সেদিন খুব মুষড়ে পড়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে হাস্পাতালে, ডাক্তারের চেম্বারে এত তার মত অসুস্থ মানুষের সাথে পরিচয় হল, কেমো নিতে গিয়ে বুঝলেন তিনি একা নন। তারপর থেকে কষ্টটা আছে, কিন্তু অতটা ভার আর ভয় নিয়ে নয়। মানুষ বড্ড অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে, নিজের কাছে, অন্যের কাছে। পাঁচিল তুলছে যেখানে সেখানে। সেই পাঁচিলে জমছে অবসাদের শ্যাওলা।
রজনীবাবু ঠিক করলেন, আজ থেকে রোজ এই বেঞ্চে অনেকক্ষণ বসবেন। জানেন না সব ক'টা কেমো নেওয়া হবে কিনা, কিম্বা সফল হবে কিনা জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়ে। তবু কয়েকটা পাঁচিল টপকাতেই হবে, শ্যাওলাগুলো খুঁচিয়ে।