যদি দই পাততে চাও, তবে দুধে অল্প একটু দই ফেলে তাকে শান্তিতে থাকতে দাও। তাকে ধরে নাড়াচাড়া কোরো না। এ কথা শুনেছি আমরা। উপদেশ।
বেশ কথা। কিন্তু দই জমে কই? মন অন্যমনস্ক। সে হল ভাবার কল। ভেবেই চলেছে। আমি নিজে থেকে ভাবি, সে ভাবনায় আনন্দ। কিন্তু ভাবনারা আমার মাথাটা ভাড়া খাটিয়ে ভাবায়, তাতে আর আনন্দ কই? ইংরেজিতে বলে রেসিং থটস। সাটসাট ভাবনারা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে যাচ্ছে। যেন মাথার মধ্যে হাজারটা লোক কোর্ট কেটে ব্যাডমিণ্টন খেলছে। হাজারটা শাটলকক্ মাথার এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে সাঁ সাঁ করে। কোনটা গোত্তা খাচ্ছে, কোনটা ওই উপরে হুস্ করে উড়ে যাচ্ছে। আমি খাবি খাচ্ছি। আমারই মাথা। আমার জেগে থাকা। ভাবনাগুলো কার দাদা? এরা কোত্থেকে জন্মায়? কোথায় যায়? এ তো উইয়ের ঢিবির মত মাথাখানা খোকলা করে দিল দাদা। যাই কই?
এলোপাথাড়ি ভাবনা। অন্যমনস্ক ভাবনা। এলোমেলো ভাবনা। সব এক কথা। লাগাম নেই। কে পরাবে লাগাম? বলি হাত-পা-মুখ কিছু আছে প্রাণীটার, যে তাকে লাগাম পরাই? সে যাঁতাকলে পিষছে আমার মাথাটা। এক-এক সময় মনে হয় মাথা তো না, যেন গ্রাইণ্ডার মেশিন। সব গুঁড়ো করে ঘোঁট পাকিয়ে দিচ্ছে।
তো এখন কথা হল এই মাথা নিয়ে তো আর দই জমানো যায় না। তবে শান্ত মাথা মানে কি? লকডাউনের এসপ্ল্যানেড? উঁহু, সেটি হচ্ছে না। তবে? শান্ত মাথা মানে লকডাউনের এসপ্ল্যানেড নয়, ট্রাফিক পুলিশ যুক্ত চৌরাস্তা। সে কি করবে? ভাবনা থামাবে?
পাগল হয়েছেন? ভাবনা থামাতে গেলে আরেক চিত্তির... আগে যদিও বা মিনিটে দুটো শাটলকক্ আসত, থামাতে গেলে মিনিটে দশটা আসবে।
তবে?
উপায় আছে। নইলে মানুষটা বলবেনই বা কেন? একটা গোটা সুখ খুঁজতে হবে।
সেটা কি?
মানে যেটাকে ধরাছোঁয়া যায়। যেমন দুটো গাছ লাগালে, কি আলপনা দিলে, কি একটা নতুন পদ কিছু রান্না করলে, কি একটু সাজলে, কি একটু গান গাইলে, কবিতা বললে। আসলে অন্যমনস্ক মন হল ইঁদুরের মত। তাকে ফাঁদে ফেলতে হবে। সুখের ফাঁদ। মন সুখ চায়। আর দুঃখ চায় না। তাকে যদি এর একটা দাও হয়ে যাবে। এই দেখো না কেন, এত মানুষ যে হাতে লালফিতে বাঁধে, সে ফিতে বেঁধে সুখ কি? না, দুঃখ হবে না, এই বিশ্বাসের সুখ। অন্ধবিশ্বাস? আলবাত তাই। কিন্তু মন হয় সুখের খোঁজ করে, নয় দুঃখ এড়াবার ফিকির খোঁজে। এই যে এত মানুষ মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, মানত করে, এ সব কেন? যাতে দুঃখ না হয়। এই বিশ্বাসে। তাও দুঃখ হয়। মানুষ বলে আহা, এত এত মানত করলুম, উপোস করলুম তাও দুঃখ হল! কত্ত অভিযোগ তখন। বলি কমোন সেন্সের কি গোড়া অবধি উপড়ে ফেলেছ? জগতজোড়া দুঃখের আগার, উনি এলেন আর সব দুঃখ এড়িয়ে নাকি এমনি এমনিই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলে যাবেন। তাও কিভাবে? না, হাতে সুতো বেঁধে কি ঘুষ দিয়ে। যত্তোসব! তেনারাই ধরাধামে এসে নাজেহাল হয়ে মরছেন, আর উনি নাকি সব কাটিয়ে যাবেন। তেনাদের জীবনীটা ভালো করে পড়লেই বুঝে যাবে মার্কেটে অত সুখ নেই। এটা প্যাকেজ। সুখ এলেই দুঃখ বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি-তে এসেই যাবে।
তো অন্যমনস্কতা এমনই এক কঠিন ব্যামো। এমনিতে দেখতে নিরীহ টাইপের। কিন্তু মহা ছুপা রুস্তম। অল্প অল্প করে সময়ের সময় নষ্ট করবে। যা নয় তাই বানাবে। কোনো আইনকানুন মানার বালাই নেই, সম্ভব-অসম্ভবের ধার ধারে না। সে শুধু হয়েই চলে, হয়েই চলে। দই জমবে কি করে? এত নাড়ানাড়ি সহ্য হয়? ভাবনাদের উৎস মুখ কি তবে? এই অন্যমনস্কতা। সে ব্যাটাকে চেপে ধরলেই বাকি সব ঠিকঠাক। তাকে নিরীহ মনে করে ঠকে যেও না মন। তাকে মারো ডাণ্ডা, তো মন ঠাণ্ডা।