ব্ল্যাক কফি বানাতে গেলে অ্যারোমা আর স্বাদের ব্যালেন্সটা খুব জটিল সমীকরণ। কার কতটা কড়া হলে তিতা লাগে, কি ভালো লাগে, এর কোনো প্রামাণ্য মাত্রা পাওয়া সম্ভব নয়। 'অ্যানিমাল’ সিনেমাতেও এই সমীকরণে কিছু গোলমাল আছে।
সিনেমাটা নিয়ে এত এত আলোচনা হয়েছে যে আরো আলোচনা বাহুল্য শুধু না, তিতা হওয়ারও সম্ভবনা। সেটা মাথায় রেখেই কয়েকটা বিষয়ে কথা বলার ইচ্ছাতেই লেখা।
প্রথম কথা, সিনেমাটা বক্স অফিসে ভীষণভাবে সফল। প্রায় নাকি ৯০০ কোটির উপর লাভ। যা নাকি ‘পাঠান’, ‘বাহুবলি ২’ ইত্যাদিকেও ছাপিয়ে গেছে। অর্থাৎ, দেশের একটা বড় অংশের মানুষের ভালো লেগেছে, কিম্বা পজিটিভ বা নেগেটিভভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
শুরু থেকেই শুরু করা যাক। ভারত ভক্তির দেশ। অথবা হিরো ওরশিপের দেশ। তার প্রধান কয়েকটা ক্ষেত্র, ধর্ম, যেখানে তার থাকাটার পক্ষে অনেক পজিটিভ যুক্তি আছে; তারপর রাজনীতি, যেখানে তার থাকাটা ভয়ংকর, আম্বেদকর সাবধান করেছিলেন; খেলা আর সিনেমা - যেখানে থাকাটা ভালো-খারাপের সঙ্গে সম্পর্কহীন, তবু আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকারক নয়। মোট কথা যেভাবেই হোক, একজন মানুষকে দিবানিশি বন্দনা করে চললে আমার চিত্তের একটা দিক তৃপ্তি পায়। যেন আমি যে কোনোভাবে হোক একজন খাঁটি, নিখুঁত মানুষকে আমার বোধে পেয়েছি। সে-ই আমার গর্ব। সার্থকতা। তার বিরুদ্ধে শোনা আমার পাপ। আবারও মনে করিয়ে দিই, ধর্মের ক্ষেত্রে এ প্রাচীনতম পথ। সেখানে নিত্য বন্দনা সাধনার অংশ। তাতেই মানুষের মুক্তির পথ।
আমাদের দেশে এই ভক্তিকে বাবা-মায়ের মধ্যে দেখার উপদেশ আছে। বাবা-মা ঈশ্বরের রূপ। পূজ্য। কনফুসিয়াসের দর্শনেও পরিবার, গুরুজনের উপর শ্রদ্ধা ইত্যাদি নিয়ে ভারী ভারী দর্শন আছে। কিন্তু পার্থক্য হল, কনফুসিয়াস অনেক অংশেই 'রিজন'নির্ভর, ভারতীয় দর্শন তা নয়। এখানে নিঃশর্ত আনুগত্যই বন্দনীয়, আকাঙ্ক্ষার। আমিও প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েও অনেকবার শুনেছি গুরুজনের কাছ থেকে, “আমার সামনে নিজেকে ডিফেন্ড করছ কেন? আমি পার্ফেক্ট, তুমি নও। সেটা স্বীকার করছ না বলেই তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না।” ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখনও শুনি, “এত বড় হয়ে গেছে, তবু বাবা-মা, কি গুরুজনের সামনে মুখ খোলে না, এমন ভালো ছেলে / মেয়ে”।
'রিজিনবল' হওয়ার শিক্ষাটা আমাদের সমাজে এমনভাবে গলা টিপে সেই ভ্রুণাবস্থা থেকে মারার সব প্রথা প্রচলিত আছে যে, বহু বহু মানুষকে নিজের যুক্তি-বুদ্ধিতে স্বনির্ভর হতে হতে জীবনের সায়াহ্ন এসে উপস্থিত হয় এমনও দেখেছি। সাবালক হওয়াটা আমাদের সমাজে কাস্টমাইজড্। মায়ের আঁচল ধরে ঘোরা, মায়ের আঁচলের আড়ালে বাঁচা, সে যত বয়েসই হোক না কেন, আমাদের সমাজে প্রশংসিত। ডাক্তারি পরীক্ষা চলছে, কি ইঞ্জিনিয়ারিং, কি মাস্টার ডিগ্রি - বাইরে বাবা-মা অপেক্ষা করছে, এ দৃশ্যে আমরা অবাক হই না। ওটাই তো বাবা-মায়ের কাজ! এর বিপরীত সিদ্ধান্তই হল, ওর দিক থেকে নিঃশর্ত আনুগত্যেই তো আমার দাবী। “আমি ওকে পুরো স্বাধীনতা দিয়েছি তাই” .... এই কথাটাই যে কত স্ববিরোধী, সেটাও আমাদের সমাজে বোঝানো যায় না। স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না, ওটা অর্জনের বস্তু। প্রাপ্ত বস্তু নয়।
'অ্যানিমাল' সিনেমার গল্প অবশ্য সে সব ছাড়িয়ে গেছে। এখানে বাবার প্রতি ছেলের ভালোবাসাটা অবসেসান। সিকনেস। যা একবার সিনেমায় উচ্চারিতও হয়েছে। লরেন্সের উপন্যাস 'সনস্ এন্ড লাভার্স'-এও মা আর সন্তানের এমন টক্সিক ভালোবাসার গল্প আছে। যা নিয়ে সেদিন ভীষণ আলোড়ন, নিন্দা হয়েছিল। ঈডিপাস কমপ্লেক্সের কথা আজকে অনেকেই জানেন। কিন্তু বাবা আর সন্তানের? দক্ষিণে এক সমকামী পুরুষের আত্মজীবনীতে পড়েছি বাবার প্রতি তার এরকম একটা অদ্ভুত আকর্ষণ। কয়েকজন সমকামী মানুষের সাক্ষাৎকারেও পড়েছি বাবার থেকে কোনো কাজে সমর্থন না পেলে নিজেকে কোনোভাবেই সার্থক মনে না হওয়ার বেদনা। বাবার সামান্য ভালোবাসায়, স্বীকৃতিতে চোখের জলে ভেসে যেতে অনেক 'বুড়ো খোকা'কেও দেখেছি। ফ্রয়েড বলতে পারবেন এর গভীরের মনস্তত্ত্বকে। কিন্তু এর মধ্যে যে কোথাও যৌনসত্তার জটিলতা থাকার সম্ভাবনা আছে সে সম্পূর্ণ উড়িয়েও দেওয়া যায় কি? ভারতে সুধীর কক্কর এই ধরণের গবেষণায় পথিকৃৎ। অনেকের বিষনজরে পড়েছেন। বই নিষিদ্ধ হয়েছে। কারণ উনি 'পবিত্র' বোধে হাত দিয়েছেন। সন্দেহ করেছেন।
যে কোনো সম্পর্কে অবসেসানটা অসুস্থতা। অবসেসান মানেই অসুস্থতা। যা কিছু আমার রিজনবল সত্তার বিরোধী, সে-ই আমার পক্ষে ক্ষতিকর। ডগম্যাটিক অ্যাপ্রোচ। অর্থোডক্সিক অ্যাপ্রোচ তাই এতটা ক্ষতিকর। যে কোনো সীমানার দিকে ঝুঁকে কাণ্ডজ্ঞান হারানোটাই ক্ষতিকারক।
'অ্যানিমাল' সিনেমার নায়কের বাবার উপর অবসেসান, এই একদিকের গল্প। উল্টোদিকের অবসেসান নিয়েও অনেক গল্প আছে। নিজের সন্তানের প্রতি অবসেসান কিভাবে তার গোটা জীবন নষ্ট করে, ব্যর্থ করে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, সেও পড়েছি, সিনেমায় দেখেছি শুধু নয়, বাস্তবেও দেখেছি। লিখেওছি আগে এ নিয়ে। অনেক বাবা-মা গোঁসা করে আনফ্রেন্ড করেছেন। মেসেঞ্জারে শুদ্ধ মন্দকথা বলেছেন, এ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবে এই সিনেমায় বাবা বহুবার ছেলেকে তার প্রতি এই অবসেসান থেকে বার করার চেষ্টা করেছেন। সেটা বেশ নতুনত্ব। অনেকেই একে এক্সপ্লয়েট করার লোভ সামলাতে পারেন না। সে নির্বাসনে পাঠিয়েই হোক, কি চামচে করে রাখার সুখেই হোক।
নায়ক স্ত্রী-র কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নারীকে কিভাবে কামে-প্রেমে তুষ্ট করতে হয় নায়কের জানা। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে কৃত্তিবাসদাদা লিখছেন,
“স্বভাবে পুরুষ হতে কামে মত্তা নারী”…… ”হৃদয়ে আনন্দ মুখে করয়ে তর্জন” .... ”পুরুষ অধিক নারী কামেতে পাগল / তথাচ পুরুষ মন্দ স্বভাবে পাগল” ....... ”কেহ না বুঝিতে পারে স্ত্রীলোকের ছল / পুরুষ ভুলাতে নারী ফাঁদে নানা কল” ...... ”শৃঙ্গারেতে রমণী বাড়ায় অভিলাষ / জনম অবধি তার নাহি পুরে আশ”।
এ এক ভীষণ অদ্ভুত তত্ত্ব। আমরা জানি মেয়েরা অধীন হতে, শাসিত হতে, একটা সীমা অবধি পৌরুষের কুশন হতে গর্ব বোধ করে। এ বিশ্বাস আমাদের রন্ধ্রে। সারা গায়ে লাভ বাইটে ভরিয়ে দিলে সে নারী হিসাবে নিজেকে সার্থক মনে করে। মা হওয়ার সার্থকতা নারী হিসাবে এর পরের ধাপ। কিন্তু প্রথম দায়িত্ব স্বামীকে তুষ্ট করা। একটা রিলে দেখছিলাম, স্ত্রী বাপের বাড়ি যাচ্ছে, স্বামী কাকুতি মিনতি করছে। তাও স্ত্রী হেঁটে যাচ্ছে সগর্বে। যেই না স্বামীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, আর যেমনি স্ত্রী-র মায়ের সঙ্গে যৌনমিলন ঘটিয়ে ফেলার থ্রেট দিল, অবশ্যই অশালীন ভাষায়, অমনি সে স্ত্রী ঘরে চলে গেল। সেই রিলে হাজার হাজার লাইক। এবং আশ্চর্যের, বহু বহু মেয়েদের সমর্থন! তারা খুব ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছে, দুর্ভাগ্যবশত বহু মেয়েকে এইভাবে না শাসালে সংসারে শান্তি থাকে না।
আসলে এই ‘শান্তি’ শব্দটা বড় বিটকেলে। অরুন্ধতী রায়ের একটা বইতে পড়ছিলাম, সেখানে প্রকাশ্যে আইনরক্ষক বলছে, সমাজে শান্তি রাখতে গেলে, ‘সন্তুলন’ বজায় রাখতে গেলে কাস্টিজ্মকে বজায় রাখতেই হবে। দলিতকে তার সীমা অতিক্রম করতে দিলেই অশান্তি হবে। তাই দমিয়ে রাখাই আমাদের শান্তি কায়েমি রাখার পথ।
আমাদের বাড়িতে বাড়িতে, পাড়ায় পাড়ায় এরকম শান্তি বজায় রাখার অভ্যাস মজ্জাগত। যেটা আমার শৃঙ্খল, তাতেই গর্বিত বোধ করাটা আমার সংস্কারের সার্থকতা। আশ্চর্য হই কত কত যুগের অধ্যবসায়ে এটা আমাদের রক্তে এইভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমাজরক্ষায় নানা ধর্মের নানা স্ট্যাণ্ড, যার বেশিরভাগই মেয়েদের নিয়ে, ভাবলে, দেখলে আজও আশ্চর্য হতে হয়। এবং মেয়েদের মধ্যেও সমাজরক্ষা আর পরিবারের শান্তিরক্ষার জন্য সেইসবে আত্মত্যাগের মাধ্যমে মহিমান্বিত হওয়ার লোভ দেখলে বাকরহিত হতে হয়। তবু এর ব্যতিক্রম আছে, তৈরি হচ্ছে, এ আশার আলো।
আসলে যে কোনো ধরণের আনরিজনেবল আনুগত্যই যে কারুর না কারুর প্রতি ভায়োলেন্স, সেটা আমরা ভুলে যাই।
শেষে দুটো কথা বলে শেষ করি। সিনেমাটাতে ভায়োলেন্স, মানে মারামারির দৃশ্যগুলো আহামরি কিছু নয়। কিছু অত্যন্ত হাস্যকর। আর কিছু অকারণে 'বিভীষিকা' তৈরির চেষ্টা। আর রইল রণবীর স্যারের অভিনয়। আমার রণবীর স্যারের অভিনয় খুউউউব ভালো লাগে। উনি নিজেকে ক্যানভাস করে তোলেন। একটা একটা করে এক্সপ্রেশানকে সোজাসাপ্টা ফুটিয়ে তোলেন। রাগ মানে রাগ। রোম্যান্স মানে রোম্যান্স। স্ক্রিনসেভারের মত পর পর আসে। চলে যায়। এটা যদি অভিনয় হয় তো অভিনয়। বেশি চাপ নিতে হয় না। রাজকুমার রাও, কি ইরফান খানের মত অভিনয়ের জটিলতায় উনি ওনার দর্শকদের নিয়ে যান না। এটাই এই সিনেমার স্বস্তির দিক।
তবে সিনেমাটাকে আমি উড়িয়ে দেব না। যে সত্যিটাকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে, সে সত্যিটা এখনও সমাজে ভীষণ বাস্তব।