Skip to main content

অঞ্জু চায়ের কাপদুটো টেবিলে রাখতে রাখতে ঘরের পরিবেশটা বুঝে নিল। প্লাবনের চোখের কোল ফোলা। জুঁই যে সারারাত ঘুমায়নি অঞ্জু জানে। চোখ এতটা না ফুললে এত সকালে কেউ আসে? অঞ্জু কারোর মুখের দিকে না তাকিয়েই বলল, প্লাবন আজ দুপুরে খেয়ে যেও এখানেই….

    জুঁই বলে উঠল, না মা, তুমি ওকে নিয়ে ভেবো না, ও একটু পরেই বেরিয়ে যাবে…

    প্লাবন বলল, ঠিক আছে কাকিমা আমি খেয়েই যাব... মাকে জানিয়ে দিচ্ছি…

    অঞ্জু রান্নাঘরে এসে বুল্টিকে বলল, তুই আগে জলখাবারটা বানা...রান্নাটা আমি দেখছি….

    বুল্টি এ বাড়ি রান্না করছে প্রায় এগারো বছর হল। দাদাবাবু মারা যাওয়ার চারমাস পর থেকেই। বুল্টি জানে রবিবার মানেই লুচি আর ছোলার ডাল সকালের জল খাবার। 

    অঞ্জু ছাদে এসে দাঁড়ালো। কোন্নগরেই তার জন্ম, এখানেই বিয়ে। সনাতনদের আদি বাড়ি রায়গঞ্জে। চাকরিসূত্রে এখানে আসা। ওর নিজের বাড়ির লোক বলতে কেউ ছিল না। তাই এখানেই জমি কিনে এই বাড়িটা করা। অঞ্জুর বাবার বাড়ি কয়েকটা পাড়া পরেই। এখন কেউ থাকে না সেখানে। কেউ নেই। 

    মেঘলা আকাশ। গরম আছে, তবে অসহ্য নয়। ছাদে কয়েকটা টব আছে। গাছের খুব শখ ছিল তা নয়, তবে হঠাৎ করে যখন চারদিকটা ফাঁকা হয়ে গেল তখন মনে হল কিছু নিয়ে বাঁচতে হবে! জুঁইটা ছোটো, সম্বল বলতে স্কুলের চাকরিটা। বাড়ি ফেরার পর থেকে সব আরো বেশি ফাঁকা লাগতে শুরু করত। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যেই এই কয়েকটা গাছ লাগানো। ওদের পরিচর্যায় লাগা। 

    অঞ্জু ছাদ থেকে দেখল প্লাবন সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর সিঁড়ি দিয়ে জুঁইয়ের আসার পায়ের শব্দ পেল। সবার পায়ের শব্দ চেনে অঞ্জু। 

    জুঁই এসে বলল, ওকে চলে যেতে বললাম। 

    দেখলাম, অঞ্জু মাথা না ঘুরিয়েই একটা লেবু গাছের পাতায় লেগে থাকা সুতোর মত কিছু ছাড়াতে ছাড়াতে বলল। 

    ও আরেকটা মেয়ে…

    জুঁইয়ের গলা বুজে এলো…

    অঞ্জু ছাদে বসে পড়ে লেবু গাছের কয়েকটা শুকনো পাতা তুলে ফেলতে ফেলতে বলল…

    তুই চিনিস?

    হ্যাঁ…

    আগে জানতিস?

    হ্যাঁ 

    নিজে থেকে পিছিয়ে আসিসনি কেন?

    কোনো উত্তর নেই। হাঁটুতে হাতের চাপ দিয়ে অঞ্জু উঠে বটগাছটার দিকে এগিয়ে গেল। অঞ্জুর বনসাইয়ের নেশা অল্প অল্প করে বেড়েছে কয়েক বছর হল। এ ঠিক ভালোবাসা না, নেশা। অনেক বড়কে নিজের মত করে ছোটো করে নেওয়াটা যেন চ্যালেঞ্জ। এমনকি লেবুও হয়েছে গতবছর লেবু গাছটায়। প্লাবনের মা এসে নিয়েও গেছে। মহিলাকে ভালো লাগেনি অঞ্জুর, বড় লাউড। 

    জুঁই কার্নিশের কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। যে রাস্তা দিয়ে একটু আগে মিলিয়ে গেছে প্লাবন। 

    তুই আমায় বলিসনি কিছু আগে….

    কি বলতাম?

    আমি জানতাম। 

    জানি। তুমি জেগে থাকতে। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে। আমায় মধুরিমা আন্টি ফোন করেছিল। তুমি স্কুলে ওনার সঙ্গে শেয়ার করেছিলে। তোমার নাকি স্কুলে একদিন প্রেশার ফল করেছিল……

    বাবা, এতকিছু... আমি জানিই না…

    অঞ্জু সরাসরি জুঁইয়ের দিকে তাকালো। যেন অনেক যুগ পর তাকালো। তাকিয়েই কান্না পেয়ে গেল। বুকটা খামচে ধরল যেন ছোটোবেলার জুঁই। 

    বুল্টি ছাদে এলো, কাকিমা, জলখাবার রেডি। 

    বুল্টি নেমে যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালো। একটু দাঁড়ালো। ফিরে এসে জুঁইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি ঠিক আছ?

    জুঁইয়ের নীচের ঠোঁটটা কেঁপে স্থির হয়ে গেল। মাথা ঘুরিয়ে বলল, হুঁ। 

    বুল্টি বলল, আমি নীচে যাচ্ছি। লুচিগুলো ক্যাসরোলে রাখছি, তোমরা সময় করে এসো। 

    কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। অঞ্জু কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ বলল, তুই ওকে একটা আংটি দিয়েছিলি না?

    জুঁই বলল, মা! 

    ওটা আনতে যাবি বিকেলে? খাঁটি সোনার ছিল রে!

    জুঁই অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মা! তুমি একটা ইমপসিবল….. তাই হয়!

    অঞ্জু নিজের মাথার চুলের ভিতর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, হয় না মানে... আলবাত হয়... সঙ্গে বুল্টিকেও নিয়ে যাব…. মনে আছে ওর বরের পায়ে এমন বেলনের বাড়ি মেরেছিল যে তার এক্স-রে করার টাকা অবধি আমায় দিতে হয়েছিল…. একটা বেলন বুল্টির ওড়নার তলায় লুকিয়ে দিয়ে দেব…... ব্যস..

    জুঁই হেসে ফেলল... উফ মা…..

    অঞ্জু এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। জুঁই নিজের মাথাটা অঞ্জুর বুকে গুঁজে বলল, আমি কি খুব বোকা মা! 

    অঞ্জুর চোখের কোল ছাপিয়ে জল নামছে। গলাটা শক্ত করে বলল, তা একটু আছিস... যাই হোক বাপু তুই ফস করে আংটি দিয়ে দিবি না এখন থেকে….. ও দেওয়াথোয়াটা আমার উপর রাখ... বিয়ের সময় এমন একটা আংটি দেব না তোর বরকে.. দেখে নিস...….

    আমি বিয়ে করব না…..

    কেন রে তোর লিস্ট ফুরিয়ে গেল নাকি? আরে অঞ্জন বলে কে একটা ঝাড়ি মারতে চাইত না….

    ছি... কি ভাষা হয়েছে তোমার... দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছ তুমি…..

    আরে শোনা না… মাথাটা তোল…. ছেলেটা তো ভালোই... চুলে একটু রং টং করে…. আর ক্যারেক্টারটা একটু ঢিলা এই যা…. তবে ফস করে বিনা প্রোটেকশন শুয়ে পড়িস না কিন্তু… তারপর এসে বলবি.. মা ম্যায় মা বননেওয়ালি হুঁ…. এত বড় শোক আমি নিতে পারব না বলে রাখছি বাপু আগে থেকে…. এখন আমার ওসব ঠাকুমা টাকুমা হওয়ার শখ নেই... এমনিতেই আমাদের স্কুলের পলাশদা আমায় যা হোয়াটসঅ্যাপ করে…

    মা... আবার পলাশ আঙ্কেল!

    আরে বুড়ো বিয়ে থা তো করল না... এখন এই বয়সে মনে ধরেছে আমায়….

    তুমি না যা তা একটা…

    অঞ্জু বলল চল নামি এবার... প্রেম ছাড়া জীবন চলে যায়…. লুচি ছাড়া না….

    নীচে নেমে দেখে বুল্টি হাত-পা ছড়িয়ে বসে চিকেন ম্যারিনেট করছে। তারা নামতেই বলল, ওটা বেলন না, সাঁড়াশি….

    মানে তুই আড়ি পেতেছিলি….. অঞ্জু মিছিমিছি রাগ দেখিয়ে বলল….

    না বাবা, তোমাদের মা মেয়ের অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিলাম কফি খাবে কিনা…. যাও প্লাবন দাদাবাবু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে….

    জুঁই বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে তাকালো... তারপর ঘরের দিকে এগোতেই অঞ্জু ডাকল, জুঁই…

    জুঁই ফিরে তাকালো। অঞ্জু নিজের ডান হাতের মধ্যমাটা ইশারায় দেখিয়ে বড় বড় চোখ করে ফিসফিস করে বলল, আংটি….

    জুঁই ছলছল চোখে বলল, উফ মা!