রাতের বুকের কোটরে একরকমের স্নিগ্ধতা আছে। শান্ত মসৃণ স্নিগ্ধতা। বাতাসের ভাষায় ভর করে আসে। যদি হাত পাতি, কিছু এসে জমে হাতে। যদি হাত উপুড় করি, হাতের থেকে কিছু নিয়ে যায়। কি নিয়ে যায় জানি না। যেন এই রাতের অন্ধকারের আড়ালে কেউ আছে। সে আমার খুব পরিচিত, খুব আপন। এতটাই পরিচিত যেন পরিচয় দেবার ভাষারাই অপরিচিত সে পরিচিতির কাছে। শিশু যেমন মায়ের পরিচয় দিতে পারে না, প্রেমিক যেমন প্রেমের পরিচয় দিতে পারে না, তথ্য দেয় শুধু, তেমন। আর সে এতটাই আপন, কোনোদিন যে বিচ্ছেদ হয়েছিল মনেই হয় না।
খুব ছোটবেলায় যখন ছাদে হাঁটতাম রাতের অন্ধকারে, সামনের অশ্বত্থ গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে হত, ওর ডালপালা, পাতারা সবাই আমায় চেনে। আমি একা হলেই যেন কিছু একটা বলতে চায়। আচমকা হাওয়া এসে যখন ওর পাতাগুলোতে কাঁপন ধরিয়ে যেত, আমার মনটাও চঞ্চল হয়ে উঠত। মনে হত, এই তো ও বলতে পারল ওর খুশীর কথাটা।
আজও তারাভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে, অন্ধকারের চাদর জড়ানো আমার চারদিকের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, সে আছে। সেই আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে থেকে এত অপরিচিতকে পরিচিতির সুতোয় বাঁধছে। সে কি ঈশ্বর? না, কোনো আভিধানিক শব্দ দিয়ে তার রূপকে বাঁধব না। কোনো রূপের কথাই ভাবব না। রূপ মানেই তো বাঁধন। আমি নিজের কোনো রূপ দেখতে পাই না বলেই যে না, নিজেকে ঘিরে এমন স্পষ্ট করে পাওয়ার সীমারেখা টানতে হয় না। যাকে প্রচণ্ড ভালবাসি তাই তারও কোনো রূপের বাঁধন দেখি না। তার বাস্তব রূপকে ছাপিয়ে আমার মনের মাধুর্য তাকে স্বর্গীয় করে তোলে। তাই যখন তাকে আমি বলি, অপূর্ব সুন্দর তুমি, সংসার বলে, "হুম ভাল দেখতে, তবে অতটাও না। এর চাইতেও ঢের ভাল দেখেছি।''
এই 'ঢের' ভালোর মোহ থেকে বাঁচায় আমার প্রেম। যা অরূপ, যা চিরতৃষ্ণার্ত, যা চিরতৃপ্ত। রাতের বুকে সেই স্বজনের স্পর্শ নিবিড়। কারণ সে দেখার সীমা থেকে বাইরে নিয়ে আসে, ছোঁয়ার লোভ থেকে বাঁচায়। সে বলে, না বলে না, গায় -
চিত্ত-আসন দাও মেলে নাই যদি দর্শন পেলে
আঁধারে মিলিবে তাঁর স্পর্শ --
হরষে জাগায়ে দিবে প্রাণ
(ছবি - Debasish Bose)