অ্যানাটমি অব আ ফল। ফরাসি সিনেমা। কোথায় দেখা যাবে? আমাজন প্রাইমে। পরিচালিকা, জাস্টিন ত্রিয়েত। পুরস্কারের সংখ্যা অসংখ্য। কান ফিল্ম ফেস্টিভালে সর্বোচ্চ পুরস্কার গোল্ডেন পাম। গোল্ডেন গ্লোবের শ্রেষ্ঠ সিনেমা ও চিত্রনাট্য। অস্কারে শ্রেষ্ঠ বিদেশী অরিজিনাল চিত্রনাট্য। এবং ইনিই নাকি প্রথম ফ্রেঞ্চ মহিলা পরিচালক যিনি অস্কারে নমিনেটেড।
এ কথাগুলো আগে বলে রাখলাম সিনেমাটা দেখার আগে গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। কিন্তু দেখার পর মনে হল সিনেমাটা যেন এ সবের অনেক ঊর্ধ্বে।
গল্পটা শুরু হচ্ছে বরফে ঢাকা পরিবেশে একটা বড় বাড়ি দিয়ে, যে বাড়িতে একজন মহিলা, যিনি লেখিকা, একটা এগারো বছরের ছেলে, যে অন্ধ, আর একজন পুরুষ, বলাবাহুল্য যে বাচ্চাটার বাবা ও মহিলার স্বামী। এবং একটা কুকুর।
কয়েক মুহূর্ত বাদেই দেখা যাচ্ছে পুরুষ চরিত্রটি বাড়ির সামনে পড়ে আছে। মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে বরফ।
শুরু হল ট্রায়াল। মহিলার দিকে সন্দেহের তীর। সে-ই কি খুনী?
ট্রায়ালে প্রতিদিন বাচ্চা ছেলেটা আসে। শোনে। বিচারক যিনি, ঘটনাক্রমে যিনিও একজন মহিলা, তিনি বাচ্চাটাকে বারণ করেন আসতে, কারণ বাবা-মা'র ব্যক্তিগত জীবনের এমন সব দিক উঠে আসবে যা তার ওই বয়সে শোনা উচিত নয়।
ছেলেটি আপত্তি জানায় এ প্রস্তাবে। তার যুক্তি হল, কোর্টরুমে এলে যদিও বা সে সরাসরি সবটা শোনার সুযোগ পাবে, কিন্তু বাইরে থেকে গেলে তো ইন্টারনেট, মিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমে অনেকভাবে রঙ চড়িয়ে শুনবে, সেটা আরো ক্ষতিকারক নয় কি? বিচারক কি সেটা শোনা আটকাতে পারবেন?
শুরু হল ট্রায়াল। সান্দ্রা আর স্যামুয়েলের ব্যক্তিগত জীবন কোর্টরুমে এসে দাঁড়ালো।
একজন মহিলা যদি সফল, বিখ্যাত হন। যেখানে স্বামী সফল নন। কী ঘটে?
এর কোনো জেনারেল উত্তর তো হয় না। কিন্তু ‘ঊনিশে এপ্রিল' সিনেমায় সারারাত ধরে মা-মেয়ের মধ্যে যা ঘটেছিল সেও বা একটা ট্রায়াল ছাড়া কী?
এখানে সান্দ্রা একা। তার ছেলে গভীর দ্বন্দ্বে। কে ঠিক সে জানে না। রোজ একটা একটা করে সত্য উঠে আসছে। কী সেই সত্য?
তিক্ত সত্য। একজন মহিলা যদি বলেন, “তুমি যৌনতা ছাড়া থাকতে পারো, আমি পারি না।” তখন সেটা কেমন শোনায়? সে মহিলা যদি বলে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয় বলে আমার সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক হয়েছে, এবং সে সম্পর্ক যদি সমকামী সম্পর্ক হয়? স্যামুয়েল তাদের কথাবার্তা লুকিয়ে রেকর্ড করত। সেই রেকর্ডিং কোর্টরুমে সবার সামনে চলছে। সান্দ্রাকে যখন প্রশ্ন করা হচ্ছে সান্দ্রা কিছু আড়াল করতে চাইছেন না, নিজেকে ডিফেন্ড করতে সত্যকেই সামনে রাখছেন শুধু। সত্য ছাড়া মানুষের আর কী ডিফেন্স আছে সত্য অর্থে?
কিন্তু কী সেই সত্য? মহানতা? একদম না। সে সত্য তো সমাজ বানিয়েছে। ‘পতিব্রতা’ শব্দ মানুষের প্রকৃতির না, সমাজের বানানো একটা মাপকাঠি। সমাজে পুরুষ আর নারীর চরিত্রের মাপকাঠি আলাদা। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ফরাসী দেশেও আলাদা। পরিচালক জাস্টিন একটা সাক্ষাৎকারে বলছেন, সমাজে আসলে একটা কাস্টম আছে, কালচার আছে, যে মেয়ে মাত্রেই ঘরে থাকবে, আর পুরুষ মাত্রেই বাইরের জগতে থাকবে। যত আইডিয়া, গভীর চিন্তা পুরুষ করবে। নারীর সে সময় কোথায়? তার তো রাতদিন ঘরের চিন্তা করতেই কেটে যায়।
কিন্তু এখানে সান্দ্রা সে কথা বলে না। সান্দ্রা তার বরকে বলে তুমি কেন নিজেকে রাতদিন ছেলের কাজে ব্যস্ত রাখছ? তোমার নিজের কাজ কবে করবে? নিজের কাজ বলতে নিজের লক্ষ্যে কবে পৌঁছাবে? তুমি তোমার কাজে মন দাও!
কী স্পর্ধা না! লিখতে লিখতে বহু বছর আগে আমার এক সাহিত্যপ্রেমী কবি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। আমি একবার কোনো এক লেখায় এই প্রথাগত ধারণার বাইরে লিখেছিলাম বলে, সে আমাকে মেসেজ করেছিল, “আগে নিজে বিয়ে করে একটা মেয়েমানুষ ঘরে রেখে দেখা, তারপর বড় বড় কথা লিখবি।”
“ঘরে রেখে” সে লেখেনি, আরো বাজে শব্দ লিখেছিল, আমি দেখছি আমি আজও সে শব্দটা লিখতে পারছি না। আমি ভালো আর সে খারাপ প্রমাণ করতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি এ ধারণার মূলটা কত গভীরে।
সান্দ্রা তবে কোন সত্যিটা বলে? সান্দ্রা বলে একজন মানুষের নিজের প্রকৃতির মধ্যে যে নানা সীমাবদ্ধতা থাকে সেই সত্যিটার কথা। সমাজ তাকে যেভাবে চায়, সে তো তা নয়। কিন্তু সমাজের পরোয়া আর কবে করল সে? সান্দ্রা শক্তধাতের মানুষ। লড়াই করতে জানে। লড়াই করেও সে। এবং লড়াইয়ের শেষে বলে, হেরে যাওয়ার মধ্যে তবু সুখ আছে। পাওয়ার কোনো প্রত্যাশা নেই। কিন্তু জিতে যাওয়ার মধ্যে এক হতাশা আছে, শূন্যতা আছে, এক পুরস্কারের লোভ আছে। সেটা পাওয়া যায় না।
'অ্যানাটমি অব আ ফল' আসলে কার 'ফল'? কার পড়ে যাওয়া? সিনেমাটা সে জায়গাটা দর্শকের ভাববার জন্য রেখে দেয়।
আমাদের এখানে টাবু'র একটা সিনেমা বহুদিন আগে হয়েছিল ‘অস্তিত্ব’ বলে। টাবু প্রথা ভাঙার কথা বলেছিল। ‘ঊনিশে এপ্রিল’-এ অপর্ণা সেনের চরিত্রটাও তাই ছিল। ‘ভূমিকা’-তে স্মিতা পাতিল ব্যবহৃত হয়েছিল। এম এস সুব্বুলক্সমী-র ব্যক্তিগত জীবন সুখী ছিল না। সুচিত্রা সেনের ছিল না। গাঙ্গুবাই হাঙ্গল টন্সিল অপারেশানের পর ওই পুরুষালি কণ্ঠস্বরকেই নিজের সাংঘাতিক শক্তিশালী গায়কী দিয়ে লড়ে জায়গা করে নিলেন, যাকে রেওয়াজ করার সময় ঘরে ছুঁড়ে দেওয়া গোবরজলের ঝক্কিও সামলাতে হয়েছে। মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার যখন চণ্ডালিকা করছেন, তখন তার দাঁড়ানোর মধ্যে কমনীয়তা নেই কেন নিয়েও আলোচনা শুনতে হয়েছে। এ উদাহরণের শেষ নেই। অ্যানাটমি অব আ ফল-এর সান্দ্রাও শক্ত মানুষ। জানে পায়ের তলায় জমি কেউ করে দেয় না। করে নিতে হয়।
এরা তো বিখ্যাত মানুষ। এদের লড়াই আলোচিত। প্রশংসিত বলব না। কিন্তু আমার চারপাশে আরো তো লড়াই দেখছি। স্মৃতিতেও অনেক অনেক মানুষের ভিড়। যাদের কথা গল্পে বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবার কথা তো বলার সাহসই জোগাতে পারি না আজও। কিসের কথা? মহত্বের কথা না। সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা দেখানোর মত মহত্বের প্রতি কোনোদিন কোনো আকর্ষণ নেই আমার। রোজকারের জীবনে যে অসম লড়াইতে আজও মেয়েদের থ্যাংক্সলেস, গ্র্যাণ্টেড হতে হতেও, হতে না দেওয়ার লড়াইটা লড়তে দেখি তাতেই বিস্মিত হই।
আসলে সান্দ্রা হল সে, যাকে সিনেমার পর্দায় ভালো লাগে, উপন্যাসে ভালো লাগে। কিন্তু নিজের বাড়ির মধ্যে, পরিবারের মধ্যে ভালো লাগে না। কারণ তাকে সহ্য করা যায় না। কী সহ্য করা উচিত আর কী না, সেটা আমাদের বিবেক ততটা ঠিক করে না, যতটা ঠিক করে দেয় সমাজ। বিবেকের ছদ্মবেশে সমাজ কথা বলে। আমরা ভাবি আমরা ঐতিহ্য রক্ষা করছি, ধর্ম রক্ষা করছি। আসলে আমরা একটা অস্পষ্ট ভয়কে আড়াল করছি। সত্যের সামনাসামনি হতে চাইছি না। কারণ আমাকে তৈরি করেছে যে সমাজ, তার বাইরে গেলে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই যে!
এটা মিথ। এটাই জাল। এটাই আসলে ফল। মানে পতন। সিনেমাটা দেখে নেওয়া যেতে পারে। আরেকটা দিক অবশ্যই, অসামান্য অভিনয়। বিশেষ করে বাচ্চাটার অভিনয়, কিছু জায়গায় কয়েক মুহূর্তকে স্তব্ধ করে দিয়েছে আমার।