Skip to main content


        আমি এখন বার্ন ওয়ার্ডে বসে আছি। সকাল থেকে বসে আছি। বাচ্চাটা বাজিতে পুড়ে গেছে। সারা গা দগদগে পোড়া দাগ। শুকাচ্ছে। টান লাগছে। বাচ্চাটা এবার মারা যাবে। হয়ত আজকে রাতেই, কিম্বা কাল।
        আমি প্রায় সাত মাস হল কোমায় শুয়ে আছি। ICU তে দশ নম্বর বেডে। সারাদিন শুয়ে থাকা যায়? তাই শরীরটা ছেড়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। বেশিদূর যেতে পারি না অবশ্য, কারণ এখনও আমি মৃত নই। আজ সকাল থেকে অনেকক্ষণ বেডে শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনছিলাম। ভালোই লাগছিল। বরাবরই বৃষ্টি আমার খুব প্রিয়। একটা কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বেডের বুড়ো মানুষটা মারা গেল। COPD রুগী ছিল। 
        আগে আমার হাসপাতালে আসলেই মাথা ঘুরত, বমি পেত। এখন হয় না। সয়ে গেছে। আমাকে আনল এ বছর জানুয়ারিতে। একটা ষাঁড়ে গুঁতিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল, তারপর একটা ম্যাটাডোর এসে বাকি কাজটা সেরে দেয়। আমার শরীরে একটা হাড়ও গোটা নেই ডাক্তারেরা বলছিল। শরীরের ভিতরে আরো কি সব নষ্ট হয়েছে না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেন। আমার বয়েস এখন ঊনচল্লিশ। আমি অবশ্য এখন ব্যথা কিছু বুঝতে পারি না। সয়ে গেছে না স্নায়ুগুলো শুকিয়ে গেছে জানি না। দেহের থেকে বাইরে বেরোনো অভ্যাস করতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রথম প্রথম। আমার পাশের বেডে একটা ছেলে ভরতি হয়েছিল, হার্ট অ্যাটাক। ও মারা গেল যেদিন সেদিন আমার সাথে অনেকক্ষণ বসে গল্প করেছিল, মারা যাওয়ার পর। ছেলেটার বয়েস বেশি না। তিরিশের কাছাকাছি হবে। ও আমায় বলল, পাঁজরগুলোতে ভর দিয়ে, মাথার কাছে নিজেকে একাগ্র করে, শ্বাসটাকে আটকে ক্রমশঃ গলা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করতে। ও প্রথমে আমায় সাহায্য করেছিল, আমি একা কিছুতেই পারছিলাম না। ও আমার ভিতরে ঢুকে আমার পাঁজরগুলোকে ফাঁক করে ধরল, তারপর আমার গলার নলির কাছে আঙুল ধরে রাখল যতক্ষণ না আমি বেরোই। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। দিনে চার পাঁচবার বেরোই। 
        এটা একটা সরকারি হাসপাতাল। না কোনো রাজনৈতিক জালিয়াতির কথা বলব না। সে কোথায় না নেই। খাওয়াখায়ি, রেষারেষি সব জায়গায় আছে। আমি পাঁউরুটি সাপ্লায়ার ছিলাম। মানে এখনও আছি। সেখানেও এই নোংরামি ছিল। এই কোম্পানীর মালের সাথে অন্য কোম্পানীর মালের। ওসব সয়ে গিয়েছিল। বাড়ি এসে গঙ্গায় ডুব, ব্যস। কোনো বড় দর্শন নীতি নিয়ে সারা জীবন মাথা ঘামাইনি। যে পার্টি, যে ভগবান হাতের কাছে পেয়েছি, দলে নাম লিখিয়েছি। অশান্তি বাড়িয়ে কি লাভ, শান্তিটুকুই চেয়েছিলাম খালি। 
        আমার দাদা একজন খুব বড় রাজনৈতিক নেতা, সেই এই হাসপাতালের ব্যবস্থা করে দিল। নইলে এই সরকারি হাস্পাতালে অ্যাদ্দিন রাখত আমায়? ইদানীং একটা অসুবিধা কিন্তু হচ্ছে, আমি আগের কথা কিছু মনে করতে গেলেই মাথাটা খুব টাটাচ্ছে। সেদিন জানলার বাইরে একটা বড় রাজনৈতিক দলের মিছিল দেখলাম, শালা মনেই করতে পারলাম না কোন দল! আমার স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে ধীরে ধীরে। একদিন তো আমি নিজের শরীর কোন ফ্লোরে রাখা তাই ভুলে গিয়েছিলাম। এ বিল্ডিং সে বিল্ডিং ঘুরে কতক্ষণ পরে যে পেলাম তা মনে নেই। 
        আমার স্মৃতিভ্রংশের কারণ আমি বুঝছি, আসলে আমি মৃত্যুর কাছাকাছি যাচ্ছি। অনেকটা চলেই এসেছি প্রায়। ওই যে কাঁচের বাইরে থেকে যারা দেখে, আমার বউ, মা আর বৌদি। আমাদের কোনো বাচ্চা নেই। মৌমিতা কোনোদিন মা হতে পারবে না। আমরা ঠিক করেছিলাম একটা অনাথ বাচ্চাকে মানুষ করব, হল না। দেখি মৌমিতা কি করে, আমার মনে হয় না আমি ফিরতে পারব, ওকি আমার মৃত্যুর পর বাচ্চা নেবে একটা দত্তক হিসাবে?
        ডাক্তার আসছেন। রোজ আসেন। আমার থেকে দশ বছরের বড়। একটা কি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে আছে ডাক্তারের। ওরা অবাঙালী। কি দেখে আমায় রোজ বুঝি না। ওরা যা বলে আমি শুনতে পাই, কিন্তু ওরা আমার কথা শুনতে পায় না। মৌমিতাও পায় না, মাও না। ওরা এলে আমি মুখ ফিরিয়ে থাকি তাই। কি দিলাম ওদের বেঁচে থাকতে। এখনও মরিনি যদিও, তবু আর কত দেরিই বা তার। ওদের সুখী করতে পারলাম না। আমার বউ কতবড় বাড়ির মেয়ে। ওর মা বাবাও রোজ আসেন হাসপাতালে। আগে আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতে পারেননি, এখন মেনে নিয়েছেন। আমার অ্যাক্সিডেন্টের আগের বছরই আমি প্রথম ওদের বাড়ি যাই জামাইষষ্ঠীতে। বিয়ের পনেরো বছর পরে।

        আজ সকাল থেকে আমার কিছু মনে পড়ছে না। হাসপাতালের সব ওয়ার্ডগুলো আমি চিনি। আজ সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এরকম কেন হচ্ছে বুঝছি না। হাসপাতালটা দেখলে আগে একটা বিরাট কর্মকাণ্ড যজ্ঞশালা মনে হত। কত রুগীর পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। সব আত্মীয়ের মত হয়ে গিয়েছিল। মানুষের কত ভোগ এই শরীরটা নিয়ে দেখতাম। এত রকম রোগ আছে সত্যিই মাইরি জানতাম না। কে কবে মারা যাবে আমি মুখ দেখলে বুঝতে পারতাম। তাদের গা দিয়ে একটা গন্ধ বেরোতো, তাতে টের পেতাম। কয়েকদিন হল ওই গন্ধটা আমার গা থেকে বেরোচ্ছে। চারদিকে মানুষগুলো কালো কালো বিন্দু বিন্দু হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আমি তাদের মুখ আলাদা করে চিনতে পারছি না। কত কান্নার আওয়াজ, দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ রাতদিন পেতাম, তাও পাচ্ছি না। আমায় ঘিরে একটা বলয় মত তৈরি হয়েছে। সাদা আলো। তার বাইরে ক্রমশ কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার সাথে শুধু হাসপাতালের স্মৃতি এখন। চারদিকে মৃত্যু, যন্ত্রণা, অসহায়তা। কালো কালো ছোপ ছোপ চারদিক। হাসপাতালের বাইরের মানুষদের দেখে মনে হত, তারাও কোনোদিন শোবে এসে। হাসিমুখ দেখলে মনে হত – কদ্দিন আর? হাসপাতালই যেন মানুষের শেষ পরিণতি। মৃত্যু না। মৃত্যু তো একটা ঘটনা। ঘটনাটার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছি আমি একেবারে। আমায় ঘিরে মৃত্যু সাজছে। বুঝতে পারছি। 
        আমার কি কিছু স্বীকারোক্তি আছে? জানি না। কোনো পাপ? কিচ্ছু মনে পড়ছে না। ওই গন্ধটা আমায় ঘিরে ধরছে। আমার দেখা প্রথম মৃত্যু কার? বাবার। বাবার মুখটা কেমন ছিল? সব ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। এই তো আমি হাসপাতালের গণ্ডী ছাড়িয়ে উড়ছি। আমি কোন দিকে যাব? আমার খুব গঙ্গা দেখার ইচ্ছা। আমার বাড়ি ছিল আহেরিটোলায়। রোজ গঙ্গা স্নানে যেতাম যত রাতই হোক। এখন একবার গঙ্গার হাওয়াটা চাই। বাড়ি যেতে চাই না। কিচ্ছু দিতে পারিনি জীবনে ওদের। মরে আর কি দেব? আমার চারদিক এখনও সাদা কুয়াশা। গঙ্গা কোন দিকে বুঝতে পারছি না। আমি উড়ে যাচ্ছি। ক্রমশ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে আমার ভিতরে কোথায় একটা। একটা ঘন অন্ধকারের মত মেঘ চারদিক ঘিরে ধরছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। আমি বৃষ্টির ছোঁয়া পাচ্ছি, কি হচ্ছে...আমি কি ফিরছি আবার? কাদের আওয়াজ পাচ্ছি শুনতে কানে...একটা ফুটফুটে বাচ্চা...কে ডাক্তারের মেয়ে...শুনছ আমাদের এরকম একটা মেয়ে হবে... বাজের আওয়াজ পাচ্ছি। খুব অন্ধকার চারিদিক।
        আমার ঠাণ্ডা লাগছে খুব। জমে যাচ্ছি... আর কথা...... হারাচ্ছে... আ... মৌ... কালো...