দোলের উৎসব চলছে। মন্দিরে আজ প্রসাদ বিতরণ হবে। গোঁসাইও এসেছে মন্দিরে। মন্দির প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। গোঁসাইয়ের চো পড়ল জবার উপর। ভিড়ের বাইরে কুসুমকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে।
গোঁসাই জবাদের পাড়াতেও ভিক্ষার জন্য যায়। কৃষ্ণ-চৈতন্যের নাম শুনিয়ে আসে। সে পাড়া নিষিদ্ধ। সমাজ বলে। গোঁসাই সমাজ বোঝে না। মানুষ বোঝে। মানুষের খোলে গোবিন্দের পুর। গোঁসাই জানে গোবিন্দের সৃষ্টিতে গোবিন্দ স্বয়ং-ই সার। ভালোমন্দ সব গোবিন্দ নিজেই। এ লীলা। কেন লীলা? এ প্রশ্নের উত্তর হয় না। লীলা মানেই যার কোনো কেন নেই।
সমাজ বলে কুসুম জবার অবৈধ সন্তান। সমাজ বলে। গোবিন্দ বলে না। তাই গোঁসাইও বলে না। গোঁসাই প্রসাদের লাইন ছেড়ে এগিয়ে গেল জবার দিকে। জবা এতক্ষণ খেয়াল করেনি গোঁসাইকে। হঠাৎ যেন ভিড়ের মধ্যে থেকে উদয় হল গোঁসাই। জবা দু-পা পিছিয়ে বলল, আপনি?
গোঁসাই কুসুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দে, কোলে দে…. গোবিন্দের পায়ে ঠেকিয়ে নিয়ে আসি…
জবা সঙ্কুচিত হয়ে আরো পিছিয়ে গেল। তার পিঠ ঠেকে গেল বটগাছের গুঁড়িটায়, যার ছাওয়ায় সে দাঁড়িয়েছিল। জবা বলল, আপনি সমাজ বোঝেন না গোঁসাই... একে আপনি নিলে অনর্থ হবে এখানে এখন।
গোঁসাই বলল, বেশ নিলাম না কোলে, তুই প্রসাদ নিবি তো?
জবার চোখটা আচমকা ছলছল করে উঠল। বলল, গোঁসাই, কুসুমের জ্বর তিনদিন হল, আসছে যাচ্ছে। ঠাকুর স্বপ্ন দিলেন, বললেন, মন্দিরে এসে প্রসাদ পেতে…. গোঁসাই তুমি জানো, সবাই বলেছিল ওকে নষ্ট করে দিতে... আমি করিনি... তাই বলে কি গোবিন্দ ওকে এইভাবে নিয়ে নেবে?... আমাদের পাশের গ্রামে চারটে বাচ্চা মারা গেল গোঁসাই দু'দিনের জ্বরে…
গোঁসাই বলল, শুনেছি…. আয় আমার সঙ্গে…
মন্দিরের সামনে ভিড় ভীষণ। গোঁসাই জবাকে নিয়ে এগোচ্ছে। বলতে বলতে যাচ্ছে, একটু রাস্তা দিন বাবারা মায়েরা... ওর খুব জ্বর..
হঠাৎ রাস্তা আটকালো ছোটো মোহান্ত। বলল, কি আবর্জনা নিয়ে যাচ্ছ গোঁসাই মন্দিরে? মঠে তো থাকলে না... ভিখারি হলে... এখন কি ভাগাড় পরিষ্কার করার দায়িত্বও নিয়েছ?
জবা কুসুমকে বুকে আঁকড়ে বলল, আমি যাই গোঁসাই... ওর জ্বরটা বাড়ছে…
গোঁসাই শক্ত গলায় বলল, না। এখানে দাঁড়াবি। আমি প্রসাদ আনছি। ছোটো মোহান্তকে বলল, তোমার কথার উত্তর গোবিন্দ দেবে মোহান্ত। আমার সময় নেই।
গোঁসাই প্রসাদ এনে জবার হাতে দিয়ে বলল, বাইরে চল।
জবার চোখের জল আর থামছে না। এমন নিঃশব্দ কান্না গোঁসাই নিতে পারে না। জবা কোনো কথা না বলে গোঁসাইকে প্রণাম করে ফিরতে যাবে, গোঁসাই তার হাতটা ধরে বলল, কই যাস?
জবা বলল, বাড়ি যাই গোঁসাই, মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে দেখো, পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
গোঁসাই বলল, আমি জানি। তুই বাড়ি যাবি কোন আক্কেলে এখন?
জবা বুঝতে না পেরে বলল, তবে?
গোঁসাই বলল, হাসপাতালে চল।
জবা কিছু বলার আগেই গোঁসাই হাঁটা লাগালো। গোঁসাই কিছুর অপেক্ষা করে না। অপেক্ষা করা গোবিন্দ পছন্দ করে না। হয় কাজ করো, নয় নাম করো। আর নয় দুই করো। অপেক্ষা আবার কি!
হাসপাতালের বেঞ্চে বসে জবা আর গোঁসাই পাশাপাশি। টিকিট গোঁসাই গিয়ে নিয়ে এসেছে।
গোঁসাই জবাকে বলল, দেখ মা, একটা কথা বলি, এইসব স্বপ্নটপ্ন বিশ্বাস করিস না। এসব মনের ছল। গোবিন্দ কথা কওয়ার জন্য ঘুমের অপেক্ষা কেন করবে? গোবিন্দ অপেক্ষা করে না। মন শুদ্ধ হলে সে শুদ্ধমনের কথাই হল গোবিন্দের কথা।
জবা বলল, তবে যে প্রসাদ আনলে!
সে তোর মান রাখতে, মন রাখতে নয় রে। গোবিন্দ যা আছে, এই যা দেখছিস শুনছিস এই সব। এর বাইরে যা আছে তা আমাদের ভেবে কি হবে? তোর যুক্তি-বুদ্ধি ভাব-অনুভব শুদ্ধ হলে সব গোবিন্দ।
মন শুদ্ধ মানে কি গোঁসাই?
গোঁসাই হেসে বলল, ভেদবুদ্ধি যাওয়া।
***** ******** *****
গোঁসাই ফিরছে ভিক্ষা করে। রাস্তায় ছোটো মোহান্ত প্রণাম করে দাঁড়ালো। গোঁসাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছোটো মোহান্ত। মুখ অভিমানে কান্নায় ভরা। একটু টোকা দিলেই ফেটে পড়বে।
গোঁসাই বলল, যা এখনই একটা ফল আর ফুল গোবিন্দের পায়ে দিয়ে জবার কাছে যা, বলবি কুসুমের জন্য এনেছি। আর ক্ষমা চাইবি ওর কাছে মনে মনে। বাইরে কিছু বললে ও লজ্জা পাবে। আর প্রাণের অনুতাপ প্রাণ আপনি বোঝে, মাঝখান থেকে জিভে এনে ওসব কথা বলে মানুষকে বিব্রত করা শুধু।
ছোটো মোহান্ত গোঁসাইকে প্রণাম করে এসে মন্দিরে ঢুকল। কই আজ তো পাথর দেখছে না? এই তো গোবিন্দ... এই তো সেই মদনমোহন রূপ... এই তো সেই ভুবনজোড়া হাসি। ছোটো মোহান্ত কেঁদে গোবিন্দের পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি এখনই যাই প্রভু, এখনই যাই।
মোহান্ত ছুটল জবার পাড়ার দিকে। ছুটতে ছুটতেই শুনল তার সামনে সামনে ছুটছে নূপুরের ধ্বনি। সে ডাকছে, আয়... আয়... আয়…