Skip to main content

পুরীর সমুদ্রতট। বর্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা এতদিনে, কিন্তু বর্ষা যেন এই সবুজ মায়াময় সংসারটা ছেড়ে এক বছরের জন্য চলে যেতে কোথাও দ্বিধান্বিত। এদিকে শরতের মেঘও এসে হাজির। আকাশে মাঝে মাঝেই কালো মেঘ আর সাদা মেঘের যুগপৎ বিচরণ।
      দু'জন নারী আজ অনেক সকালে তটে এসে বসেছে। সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসা। চুলগুলো শেষ বর্ষার সজল মেঘে উড়ে উড়ে যাচ্ছে, বাতাস যেন কালো মেঘ বলে ভুল করছে বারবার সে ঘন চুলের রাশিকে। কোথাও বিয়ের বা কোনো পুজোর সানাই বাজছে ভৈরবীতে। কুমুদ আর মৃণাল তাদের অতীত জীবনের স্মৃতির একটার পর একটা ঢেউ দেখছে, সামনের এ বিশাল সমুদ্র যেন অন্তর্হিত তাদের চোখের সামনে থেকে।

      কুমুদ বলল, "এত জোর পেলে কি করে তুমি?"

      মৃণাল বলল, "তুই জোরটা খুঁজেছিস শাস্ত্রের বাণীতে, আমি খুঁজেছি আমার নিজের মধ্যে, মেয়েটা কিভাবে মারা গেল জানিস তো?"
      কুমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর কিছুটা আত্মগত হয়েই বলল, "সংসারে মানুষের অসংবেদনশীল হওয়ার উদাহরণটা নতুন কিছু নয় বলো?"
      মৃণাল বলল, "অসংবেদনশীল মানুষ অস্বচ্ছ হয়। মানুষ নিজেকে যা অনুভব করে তাইতে সে নিজের চারপাশকে গড়ে তোলে। যদি সে অনুভব তার না থাকে তবে সে নিজেকে বাইরের হাজারটা তাড়নায় ব্যস্ত রাখে। তার তখন কর্তব্য, গুরু, ধর্ম, দায়িত্ব, সফলতা, প্রতিযোগিতা এরকম নানা ফিকিরের অভাব হয় না। সমাজ জুগিয়েই যায়। ব্যস্ততাই তখন তার অনুভবহীনতার ঢাল, নইলে মুখরক্ষা হয় কি করে?"
      কুমুদ বলল, "এরা যে কখন নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে এরা নিজেরাও বোঝে না, বলো?"
      মৃণাল হাসল, বলল, "তোর আর আমার ক্ষেত্রে ঘটনাটা কিন্তু আলাদা কুমুদ। তোর সংসারে সে নিষ্ঠুর ছিল স্বভাবে, আমার বেলায় সে নিষ্ঠুর ছিল এমনটা হয়ত বলতে পারি না, সে নিজের অহংকারের শিকার হয়েছিল, ওই লিখেছিলাম না, আমার রূপটা তারা ভুলতে বেশি সময় নেয়নি, কিন্তু আমার যে বুদ্ধি আছে এইতে তারা প্রতিপদে ঠেকেছিল। ওতেই অত রুক্ষ নির্মম হয়ে উঠেছিল ওরা।"
      কুমুদ বলল, "বুঝি। সে যখন বুঝেছিল যে সে আমার শরীর অবধি আসতে পারছে কিন্তু আমি তবু তার কাছে অধরাই রয়ে গেলাম তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল, আরো নির্মম, সাথে দাদার উপর যে ঈর্ষা তার ছিল সেও তো জানো।"
    মৃণাল বলল, "কি জানিস আমাদের আবেগ, অনুভব সব কিছুকে তারা তাদের সমাজের শৃঙ্খল পরিয়ে বাঁচাতে চায়। আমাদের নাল পরানো পায়ে লাগামের শাসন থাকবে, যে লাগাম তাদের হাতে তুলে দিয়েছে সমাজ। ওই যে বললাম, সমাজ অনুভব বোঝে না, তার রীতিনীতির ধাঁচাটা বোঝে, অনুভব তার কাছে বাড়তি উৎপাত। পুরুষের সমাজে বুদ্ধি তার অহমিকার পোষ্য, মেয়েদের তো তা নয়, মেয়েদের বুদ্ধিটাকে ঈশ্বর তার হৃদয়ের অনুপাতে গড়েছে, তাই বুদ্ধি আমাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না। আমাদের অস্তিত্বের অনুপাতে সে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে। পুরুষের বুদ্ধি তার অহমিকার মদে মাঝে মাঝেই লাগাম ছাড়িয়ে ছোটে, পাছে সে দুর্বলতাটুকু আমাদের চোখে পড়ে বলে নানা ফিকিরে আমাদের বুদ্ধিটাকে তাদের বাড়তি ঘোষণা না করলেই নয়।"
      কুমুদ হাসল, কিছু বলল না।
      সকালের রোদ চড়া হচ্ছে, কিন্তু একটা ঘন কালো মেঘ অসীম জলরাশির গর্ভ থেকে যেন জেগে উঠছে। বোঝাই যাচ্ছে আশু একটা ঝড়ের সম্ভাবনা। ইতিউতি ছড়ানো মানুষদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে, অনেকেই শশব্যস্ত হয়ে একটা নিরাপদ আস্তানার দিকে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের গল্পের দুটো মানুষ স্থির বসে সেই মেঘের সঞ্চার দেখছে। তাদের মুখ-চোখ উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে কিসের এক উত্তেজনায়। বিধাতা সংসারে এত ঝড়ের পর তাদের এখানে মিলিয়েছে যে বোধকরি এই বাহ্যিক ঝড় তাদের উদ্বেল করার ক্ষমতা হারিয়েছে।


      দেখতে দেখতে তুমুল ঝড় শুরু হল। বালি উড়ল চারদিক অন্ধকার করে। ঢেউ উঠল মত্তহস্তীর মত উত্তাল হয়ে। মৃণাল সহসা উঠে কুমুদের হাতদুটো ধরে বলল, "চল নামি, অনেকদিন এমন উত্তাল সমুদ্রের বুকে ঝাঁপাই না।"

      দুই নারী ছুটল। খালি পা, ঝড়ে ওড়া শ্রাবণের মেঘের মত কেশভার, আঁচল উড়ে যেন দিগন্তকে ছুঁয়ে আসার স্পর্ধা নিয়েছে, তারা ঝাঁপ দিল জলে। শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি।

      মৃণাল বলল, "এ সংসারে মানুষের সব চাইতে বড় কর্তব্য কি বলতে পারিস কুমুদ?"

      কুমুদ ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের মুখের উপরের জল সরিয়ে মৃণালের মুখের দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।
      মৃণাল বলল, "নিজেকে জানা, নিজেকে আবিষ্কার করা। তুই ইতিহাস পড়ে দেখ, মানুষ সমস্ত অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তখনই যখন সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে, নিজেকে বুঝতে পেরেছে, নিজেকে চিনতে পেরেছে। অনেক সময় বড় আঘাত নিজেকে চিনতে সাহায্য করে; এই দুর্যোগের মত, সব মোহের দেওয়াল খসে পড়ে, সে নগ্ন হয়ে নিজের সামনে দাঁড়ায়, সে সেই নিজেকে চেনার জোরে যা কিছু কৃত্রিম, মেকি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার মোহভঙ্গ ঘটিয়েছিল বিন্দু।"
      মৃণালের গলা বুজে এলো। তার চোখের জল বৃষ্টি আর সমুদ্রের নোনা জলে মিশে একাকার হয়ে গেল। সমস্ত উত্তাল সমুদ্রটা যেন বিন্দু হয়ে তার সামনে প্রতিভাত হতে লাগল। মৃণাল তার নিজের ছোটোবেলায় যেন ফিরে গেছে, সে আর বিন্দু যেন আদিগন্ত মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছে। এত উত্তাল পাগলপারা ঢেউ, এত মেঘ, এত গর্জন, এত তীব্র বাতাস --- এই তো নিজেকে আবিষ্কারের সময়। মৃণাল দু'হাতে কুমুদকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আমাদের বাঁচতেই হবে কুমুদ, অনেক বিন্দু শেষ হয়ে যাচ্ছে চারদিকে, এখানে বসে থাকলে চলবে না, কিছু একটা করতে হবে কুমুদ।"
      কুমুদ বলল, "শুধু বিন্দু না দিদি, অনেক কুমুদ, অনেক মৃণালকেও খুঁজে বার করা দরকার আজ।"
      মৃণাল গাইছে, "আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান..."

      সে সুর মেঘ, বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে মহাকালের ঘূর্ণীতে গিয়ে মিশছে, বলছে, দিক বদলাও... দিক বদলাও...