Skip to main content

তুমি কি আনন্দময়ী? আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফেল করেছি। বাবা যখন পুজো দিতে আসবে মন্দিরে, বাবাকে একটু বুঝিয়ে বোলো না, আমায় যেন না মারে!

       সিক্সে পড়ে। নাম বুলবুল। বাবা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তান্ত্রিক, জ্যোতিষীও বটে। গ্রামে নামডাক বেশ। 

    বুলবুল বাড়ি এসে, নাকেমুখে গুঁজে মাসির বাড়ি চলে গেল। একাই। সাইকেল নিয়ে। বলে গেল দুদিন পর ফিরবে। মা নেই। এক লতায়পাতায় পিসি আছে। সে না থাকলেই খুশি হয় বেশি। 

    মেয়েটার বিয়ে হল। শ্বশুরবাড়ি বর্ধমানে। বর কাজ করে দুবাইয়ে। বছরে আসে কি আসে না। মেয়েটার সময় কাটে শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে তীর্থে ঘুরে। বাবা আসে না। পক্ষাঘাতে বিছানায় শুয়ে। মেয়েটা বুঝে পায় না তার জীবনের উদ্দেশ্যটা কি? 

     গ্রামে এলো বাবাকে দেখতে। বাবার বাড়াবাড়ি। একাই এসেছে। শ্বশুর শাশুড়ি নর্মদা পরিক্রমায়। 

    মন্দিরে এলো। জিজ্ঞাসা করল, মা তুমি আনন্দময়ী? বাবাকে নাও। আমার শ্বশুর শাশুড়িকে নাও। আমি আর পারছি না। ও আসবে না। আমি জানি। আমি আর কোনোদিন তোমার মন্দিরে আসব না। সেদিন বাবা মারেনি আমায়। বাবার পা ভেঙেছিল। সাইকেল থেকে পড়ে। তুমি ভেঙে দিয়েছিলে। তুমি কথা রাখো। আমিও রাখব। আর চাইব না কিছু। 

    কথা রাখা হল, না ভাগ্য, কিন্তু এক বছরের মধ্যেই মেয়েটার মাথার উপর কেউ রইল না। ভুল বললাম, পায়ে আর কোনো দায়ের শিকল থাকল না। 

    স্বামী এলো। সে বলল, আমি যাই তোমার সঙ্গে। স্বামী বলল, না। একাই থাকো। ওখানে যাওয়া যায় না। 

    স্বামী ফিরল। গর্ভে এলো সন্তান। মেয়েটার মনে হল দায়। আবার শৃঙ্খল। একে তাকে ধরে নষ্ট করল বাচ্চাটা। কি করবে জন্মে? যদি মেয়ে হয়? 

    চিঠি লিখল। ফোন করল। সাড়া পেল। ঠাণ্ডা। অবজ্ঞার। তাচ্ছিল্যের। 

    মেয়েটা এখন সারাদিন কাজ করে। উদাস থাকে। এতটা স্বাধীনতা যেন অসহ্য। মূর্তি গড়ার কাজ শিখল। হাত পাকালো দারুণ। তার তৈরি মূর্তির চাহিদা বাড়ল। লোক রাখতে হল তাকে দুজন। দূর্গা গড়ে, কালী গড়ে। কোনো পুরুষ দেবতাকে প্রধান করে না। গড়ে না। তার মূর্তি গড়ার ঘরের নাম দিয়েছে আনন্দময়ী। 

    অনেক রাত। তার ঘুম আসছে না। তার মূর্তি গড়ার ঘরে এসে দাঁড়ালো। আলোটা জ্বাললো। সার দিয়ে কালী মূর্তি রাখা। তার হাতে গড়া। বাইরে জ্যোৎস্নার আলো। আলোটা নিভিয়ে দিল ঘরের। শুনতে পেল তার শাশুড়ি, শ্বশুর, বাবা, বাচ্চাটা অন্ধকারে তার দিকে দাঁড়িয়ে। আরো হাজার হাজার চোখ। অক্ষমের বিচারশালা। 

    একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। ছায়ার মত এসে দাঁড়ালো কেউ একজন দরজার কাছে। তার স্বামী। শরীর নেই। কারণ বিশ্বাস নেই, ভালোবাসা নেই। যাতে বিশ্বাস নেই, তার অস্তিত্বই নেই। 

    বুলবুল কালীর হাত থেকে একটা খাঁড়া ছুঁড়ে মারল ছায়াটার দিকে। প্যাঁচাটা আর্তনাদ করে উড়ে গেল। ছায়াটা নেই। বুলবুল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। খাঁড়াটা কুড়িয়ে এনে বলল, আমি কথা রেখেছি মা। তুমি আনন্দময়ী। সেদিন তুমি রেখেছিলে আমায়। আজ আমি গড়ছি তোমায়। তোমার অস্তিত্বকে রাখছি আমার অস্তিত্বের আনন্দে। আমার আনন্দকে নিশ্চিহ্ন করে আমার অস্তিত্বে লাঙল চালিয়ে ফসল তুলতে দিইনি ওদের… দেবোও না…

    ঘরের মধ্যে চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। অনেক মানুষের। বুলবুল বলল, আনন্দময়ী… শান্ত হও… শান্ত হও…