Skip to main content

এসিটা অন্ কোরো না… থাক… হাওয়াটা ঠাণ্ডাই আছে…

রিচা মাথাটা গাড়ির পিছনের সিটে হেলান দিয়ে, চোখটা বন্ধ। সকালের হাওয়াটা মন শান্ত করে দেয়, সব সময়। বাবার হার্ট অ্যাটাক হল, ভোরের দিকেই তো, তার হাতেই মাথা রেখে প্রাণটা গেল, শরীরটা নেতিয়ে পড়ল, বিছানায়। ওরকম জিম করা টানটান পেশীবহুল শরীরটা, নিষ্প্রাণ, ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল রিচা, বাবা খাটে শুয়ে। মা তখন মামাবাড়ি। অত সকালে খবর দিয়ে কি হবে? নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে, চুমুক দিতে দিতে বাবাকে দেখছিল। অগাস্ট মাস ছিল। এগারোই অগাস্ট। ভোরের হাওয়াটা সেদিনও কি আরাম দিয়ে যাচ্ছিল, গালে, কপালে। ভোরের হাওয়ায় ঈশ্বরের স্পর্শ থাকে, ঠাম্মি বলতেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা ছিল ঠাম্মির। দারুণ গাইতে পারতেন, “বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া”।

প্রকাশ গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, মা তো আসতে চাইছিলেন… রাজী হলে না কেন?

রিচা কোনো উত্তর করল না। প্রকাশ মাঝে মাঝে আয়না দিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে। রিচার কোনো উত্তর নেই। কারোর কাছে কোনো প্রশ্নও নেই।

=======

রিচার এটা নিয়ে তিন নম্বর মিসক্যারেজ। মায়ের বাড়িতে চারদিন ছিল। ফিরছে। শ্যামনগর থেকে গড়িয়াহাট।

রিচার তিনটে মেয়ে তার পাশে বসে। ওদের আধারকার্ড নাম্বার রিচা বানিয়েছে। তাদের পাশের ফ্ল্যাটের বৌদি যখন তাদের বাচ্চাটার আধারকার্ড বানিয়ে এনে দেখালো, রিচার মনে হয়েছিল, তারও তো দুটো বাচ্চা হওয়ার ছিল, হয়েছিলও তো… সরকার জানেনি… তাই নাম্বার দেয়নি… সে তো জেনেছিল… স্পর্শ পেয়েছিল… অনুভবের মধ্যে কুঁড়ি থেকে পাপড়িও ধরেছিল… তার রঙও ছিল… গন্ধ ছিল…

রিচা তাকালো। গাছ কমে যাচ্ছে কত। আগে এই এক্সপ্রেসওয়েতে আরো বেশি গাছ ছিল। প্রকাশ ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। রাস্তা ভীষণ খারাপ। এই গাড়িটার উপর সন্তানের মত মায়া প্রকাশের। যখন মোছে, মনে হয় নিজের বাচ্চাকে স্নান করাচ্ছে। ভুলও হতে পারে। হয় তো রিচার একারই মনে হয় এসব। প্রকাশের কাছে এ গাড়িটা পোষ্যও হতে পারে, তাদের ল্যাবটার মত।

রিচা ডানহাতটা সিটের উপর চিৎ করে রাখল। তার তিনটে মেয়ে পাশাপাশি বসে। তার হাতের উপর হাত রাখবে। চোখটা বন্ধ করে রিচা। কোমল হাতগুলো অনুভব করছে। যেমন গর্ভের মধ্যে ওদের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ অনুভব করত। চেতনার মধ্যে ওদের ডাক শুনতে পেতো। ওরা ছুঁচ্ছে। গলার কাছে দলা পাকানো কান্না।

“চা খাবে?”

মানে বারাকপুর এসেছে। প্রকাশ গাড়ি থামিয়ে, পিছনে তাকিয়ে তার দিকে। রিচার নীচের ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। কাঁদতেও ক্লান্ত লাগে। তবু কান্না এলো। দুর্বল পাঁজরগুলোকে চুরমার করে কান্না এলো। চোখ উপচে জল। প্রকাশ হাতটা বাড়িয়ে। রিচা ধরল না। সিটে শুয়ে পড়ল মুখটা গুঁজে। সারাটা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভোরের হাওয়া কই? চড়া গরম হাওয়া ঢুকছে। প্রকাশ কাঁচ তুলে দিচ্ছে। এসি অন করছে।

ভালোবাসা অ্যাকোরিয়ামের মাছ। প্রকাশ আর সে অনেক রঙবেরঙের মাছ এনেছিল। একটা একটা মাছ মরে গেল। শূন্য অ্যাকোরিয়ামে এখন যেন কিছু প্লাস্টিকের মাছ। প্রকাশ আর সে দু'জনেই জানে, প্রাণ নেই, শুধু ভেসে থাকে ওরা। দূরত্ব বাড়ছে, নিঃশব্দে। তৃতীয় একজন তাদের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে জায়গা করে নিচ্ছে। মানুষ নয়, তবু তো অভিমান করা যেত তবে, জায়গা করছে শীতলতা। মর্গের মত ঠাণ্ডা। একবার ঢুকেছিল, কলেজে পড়ার সময়ে। এমনিই।

======

সে নাকি দিন দিন খুকী হচ্ছে। তার সাজপোশাক চালচলন তার বয়সের সঙ্গে যায় না। তার গলার আওয়াজ নাকি দিন দিন ন্যাকা হচ্ছে। তার বয়েস পঁয়ত্রিশ হল। আর কেন চেষ্টা করা? অ্যাডপ্ট করে নিলেই পারে! তবে তো আর খুকী সেজে বেড়াতে হয় না।

রিচা সব শোনে। হাওয়ায় আসে। দেওয়ালের যেমন কান আছে, হাওয়ার তেমন মুখ আছে, জিভ আছে। কথা বলে। আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে এখন। সেকি ভয় পায় প্রকাশকে হারাতে? তার অজান্তে কি তার মন খুকীর মত ব্যবহার করে? ডিফেন্স মেকানিজম? তার নিজের চোখে পড়ে না? তাই কি? ফোনে কথা বলার পর নিজের ভয়েস রেকর্ডিংটা শোনে। মনে হয় না তো, নাকি নিজের ব্যাপার বলে বায়াসড হয়ে যায়?

এমনিতেই বন্ধুবান্ধব কম। প্রকাশ আর সে দু'জনেই আইটিতে কাজ করে, একই কোম্পানিতে। দু'জনেরই ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ব্যস্ততাতেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর। কেটেই তো যাচ্ছিল। তবে?

ফোন বাজছে… তৃষা'র… তাদের পাশের কমপ্লেক্সে থাকে…

ফিরছিস

হুম্

শোন আমি রান্না করছি… দুপুরে আমি তোর ওখানে আসছি… তুই রেস্ট নিবি…

জানি

কি

তুই আসবি

ন্যাকা… রাখ…

তৃষা। ডাক্তার, স্কিন স্পেশালিস্ট। মাঝে একটা মেডিটেশান ক্লাসে জয়েন করেছিল, বিপাসনা শিখতে। শুনেছিল ওতে নাকি স্ট্রেস কমে, মিসক্যারেজ হওয়ার চান্স কমে। সেখানেই আলাপ হয়েছিল তৃষার সঙ্গে। দু'জনের ওয়েভ ভালো মিলেছিল। তৃষার তখন ব্রেক-আপ চলছিল ওর গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে। মেডিটেশান ক্লাস খুব একটা কাজে লাগেনি, কিন্তু দু'জনের বন্ধুত্বে একটা উইন্ডো খুলে গিয়েছিল।

রিচা আর তৃষা একদিন সিটি সেন্টারে বসে। ভীষণ বৃষ্টি। রিচা জিজ্ঞাসা করেছিল, বাচ্চা অ্যাডপ্ট করবি? আমি আর তুই…করবি?

তৃষা বলেছিল, প্রকাশ?

টিকবে না রে… আই ক্যান সেন্স…

এ সব কথা এগিয়ে নিয়ে যায় না তৃষা। তৃষার অস্বস্তি হয়। মনে হয় অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছে। দখল চাইছে। ভালোবাসার। রিচাকে ভালো লাগে। ঠিক ভালোবাসার মত করে না যদিও। ভালো লাগে। এতটাই।

তৃষা বলল, ওয়াশিংটনে একটা অফার পেয়েছি… যেতে বলছে…

যাবি?

ধুস্

দু'জনেই চুপ করে বসে। বৃষ্টির শব্দ শহরে একরকম, বড্ড ধাতব।

তৃষা বলল, দেখ আমরা যারা এদিকে থাকি তারা ভাবি ওদিকে গেলে কি স্বাধীনতা… কত বিলাসিতা… কত সুযোগ… কম্ফোর্ট… আর ওদিকে যারা থাকে তারা ভাবে আমাদের কি স্পিরিচুয়াল প্রোপার্টি… কি প্রচণ্ড শান্তি… ওরা এদিকে ছুটে মরে… আমরা ওদিকে…

রিচা হেসেছিল। বলেছিল, আসল সত্যিটা শুধু পরিবেশবিদেরাই জানে… আমরা সব কম্ফোর্টের বাবল্‌সে আটকে… কারোর কয়েক ইঞ্চির বাবল্‌স, কারোর কয়েক বিঘার…

রিচার কম্পোর্ফট বাবল্‌সটায় চিড় ধরছে। সে নাকি ন্যাকা হচ্ছে। সে নাকি খুকী হচ্ছে।

“প্রকাশ… ডু উই নিড টু গেট সেপারেটেড?”

“ইউ নিড রেস্ট…”

প্রকাশ করুণা করছে। এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না। আসলে যা অবশ্যম্ভাবী তা নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার মত মানুষ সে নয়। প্রকাশ কখনও তাই ওয়েদার নিয়ে আলোচনা করে না। এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে কমিয়ে নেয়। শুধু জিজ্ঞাসা করে, ঠিক লাগছে কিনা…

এখন যেমন জিজ্ঞাসা করছে।

=======

প্রকাশ ঘুমাচ্ছে বেডরুমে। রিচা আর তৃষা গেস্টরুমে। খাওয়া হয়ে গেছে। তৃষা সোফায় বসে মোবাইল ঘাঁটছে। রিচাকে স্পেস দিচ্ছে। সুযোগ দিচ্ছে কথা বলার। কাঁদার, হয় তো বা।

আমার কি পার্সোনালিটির কোনো চেঞ্জ হচ্ছে তৃষা?

তৃষা হাসল, দুষ্টুমির হাসি… বলল, অবভিয়াসলি… ধীরে ধীরে আমার দিকে অ্যাট্রাক্টেড হচ্ছিস…

ইয়ার্কি না তৃষা… আমি কি অ্যাকসেপ্ট করছি না আমার এজ?... আমার সিচ্যুয়েশান?... আমি কি পালাচ্ছি? আমি কি নিজেকে বেশি শো অফ্ করছি? আমি কি…

তৃষা সোফা থেকে উঠে এলো। পাশে বসল। তৃষা সব সময় দারুণ পারফিউম ব্যবহার করে। ও বলে, মারা গেলে, ওকে না পুড়িয়ে দামী পারফিউম দিয়ে কবর দিতে… মাটিতে মিশতে চায়… মাটি হয়ে যেতে চায়… আগুনের সৌরভ নেই… আগুন সুগন্ধ বোঝে না… মাটি বোঝে…

তৃষা রিচার ঘাড় থেকে চুলের গোছ সরিয়ে চুমু খেলো।

রিচার কি হল, হঠাৎ ঘুরে গিয়ে, নিজের ঠোঁটটা তৃষার ঠোঁটে চেপে ধরল। তৃষাকে জাপটে ধরে আছে। তৃষার হাতের বাঁধন আলগা, কিন্তু উদাস নয়, প্রকাশের মত।

তৃষা মুখ সরালো না। রিচা মুখটা একটু দূরে সরিয়ে তৃষার চোখের দিকে তাকালো।

তৃষা কয়েক সেকেণ্ড রিচার চোখের দিকে তাকিয়ে রিচার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বলল, ইউ ডোন্ট নিড টু ডু দিস বেবি… ইউ অলরেডি হ্যাভ মি… আই অ্যাম নট গোয়িং টু লিভ ইউ …

রিচা কাঁদছে। গলা জড়িয়ে আসছে তৃষার।

রিচা বলছে… মা আর ডায়ালেসিস নিতে পারছে না…. মা আর বেশিদিন নেই… প্রকাশও থাকবে না তৃষা… আমার বাচ্চাগুলো…

তৃষা কান্না জড়ানো গলায় বলল, চুপ কর… চুপ কর… তোর এখনও একটা আধার কার্ড বানানো বাকি না? নাম্বারটা তৈরি করেছিস?

রিচা জড়ানো গলায় বলল, ফাইভ সিক্স সেভেন এইট…

রিচার বানানো আধার কার্ডদুটো প্রিন্ট করিয়ে এনেছে তৃষা। জুঁই, অম্বা। এর নামটা কি রিচা?

রিচা বলল, বৃষ্টি।