Skip to main content

হাতটা ঘামছে। বাজারের ব্যাগের জন্যেই ঘামছে। সারাটা শরীরও অল্প অল্প ঘেমে। মাঝে মাঝে মনে হয় জাহাজের মাস্তুল ধরে একাই দাঁড়িয়ে আছি আমি। জাহাজ পাড়ে ভিড়বার অপেক্ষায়, নইলে ডুবে যাওয়ার। জাহাজ যে কোনো পাড়েই ভিড়ুক না কেন আমার কিছুতেই কিছু এসে যায় না। সব পাড়ই সমান এখন আমার কাছে, কোনো পাড়েই কেউ নেই।

     আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না। যারা ছেড়ে গেছে, মারা গেছে তাদের কারোর জন্যে আমার মন খারাপ হয় না। এটাই তো নিয়ম। দুঃখ আছে - বুদ্ধের আর্যসত্য। এই সত্যটা জানার জন্য এত তপস্যা? নাকি অষ্টাঙ্গিক মার্গ খুঁজে পাওয়ার জন্য? মানুষ অত সৎ নির্ভুল হতে পারে? তবে সেকি আর মানুষ থাকে? নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে জীবনটার আর বাকি কি আছে?

আমাদের মেয়েদের জন্য ধর্মের খোসা। তত্ত্ব সব পুরুষদের জন্য। আমাদের ব্রত, উপোস, হাজার একটা বিধি। আমার বিয়ে হয়নি। মানে আমায় কেউ বিয়ে করেনি। পুরুষরা তো বিয়ে করে। আমাদের বিয়ে হয়। আমার হয়নি। কারণ অবশ্যই একটা আমার রূপ। আমি পঙ্গু তার উপরে। মিষ্টভাষী নই। যখন তখন শরীর এলিয়ে দিই না। আমার জীবনে ভালোবাসা বলো, পুরুষ বলো, তার চাইতে অনেক বেশি দরকার - টাকা।

আমার এখন টাকা আছে। একটা ল্যাব আর একটা জার্মান শেফার্ড আছে। নিজের ফ্ল্যাট আছে। কিন্তু সংসার নেই। আমি কোনো পুরুষের নই। কোনো মানব শিশুর নই। কোনো পরিবারের নই। আসলে আমার এখন কোনো পরিবার নেই। আমি কারোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না। আমি পছন্দ করি না। এই যে বললাম, আমি পছন্দ করি না, এই কথাটা বলতে আমি ছোটোবেলা থেকে ভীষণ পছন্দ করি। মা বলতেন, মেয়েদের পছন্দ অপছন্দের অত ধার ধারতে নেই। আমি ধারি। আর এখন ধারতে ধারতে সেটা বেশ সূঁচালো।

কিন্তু আমি সুখী নই। আমি অনেকের মতই অসুখী। অনেক সংসারওয়ালা মানুষের মতই অসুখী। আমার নিজের অসুখী হওয়া নিয়ে কোনো কমপ্লেক্সিটি নেই। আসলে আমার নিজের কিছু নিয়েই কোনো কমপ্লেক্সিটি নেই। আমাকে নিয়ে অন্যের আছে। আমি জানি আছে।

আমি বই পড়ি। প্রচুর বই পড়ি। যেহেতু পড়াই সেটা একটা কারণ। আর যেহেতু পড়তে ভালোবাসি সেই জন্যে পড়ি। প্রচুর পড়ি। ঠিক বললাম না, এক সময়ে প্রচুর পড়তাম, এখন একটু কমেছে, তবু পড়ি। এখন আমি পড়ছি দেবদূত পট্টনায়েকের ‘মাই গীতা’। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী। কিছুটা সুবিধাবাদী বিশ্বাসী বলতে পারেন। কারণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে আমার কিছু সুবিধা আছে। যেমন একটা প্রবল বৌদ্ধিক শূন্যতার উত্তর আছে। আমার ক্ষোভ, যন্ত্রণা, কষ্টের একটা গতি আছে। গীতায় ভগবান নিজের সম্বন্ধে নিজেকে বলতে গিয়ে ‘গতি’ কথাটা বলেছেন। ‘গতিভর্তা প্রভু সাক্ষী নিবাস শরণম সুহৃৎ’। আমি এই শ্লোকটা খুব ভালোবাসি। কৃষ্ণ, বুদ্ধ আমার চিন্তার কেন্দ্রে জাগে থাকা অতিজাগতিক পুরুষ। আমি সুজাতা, আমি গোপী। এখন যেমন বসন্ত, আমার চিত্তে এখন বৃন্দাবন। আমার চিত্তের পুরুষ এখন কৃষ্ণ। আমার সমস্তটা জুড়ে কৃষ্ণ। গ্রীষ্মের দুপুরে জাগে বুদ্ধ। মে মাসের যে পূর্ণিমায় বুদ্ধের জন্ম, আমি সেই মাসে বুদ্ধের। আসলে বুদ্ধ আর কৃষ্ণ দু’জনেই আমার কাছে এক। আমার অতিজাগতিক প্রেমিক, রক্ষক, সুহৃৎ। আমার মনোবিদ বান্ধবী অনুত্তমা বলেন, এটা নাকি আমার অবদমিত কামের প্রতিফলন। তাই কি? জানি না। যদি আমি লেসবিয়ান হতাম? তবে কি আমি সুজাতা বা রাধাকে আমার চিত্তের কেন্দ্রে অনুভব করতাম?

এইটা আমার ফ্ল্যাট। আমি নিজে রাঁধি, নিজে বাজার করি, নিজে কাচাকাচি করি। লোক আছে, তবে সে শুধু অসময়ে ঠেকনা দেওয়ার জন্য। নইলে আমি আমার অস্তিত্বের কোনো অংশকে নির্ভরতা শেখাই না। আমরা ব্রাহ্মণ। আমি একবার লুকিয়ে কয়েকদিন বাবার পৈতে পরেছিলাম। আমার বিভাজিকার মধ্যে দিয়ে পৈতের সেই ন’টা সুতোকে যেতে দিয়ে বলেছিলাম, কেমন লাগছে তোমার, আমি না শাণ্ডিল্যগোত্রীয় ব্রাহ্মণী? কে কাড়বে আমার অধিকার? মা জানতে পেরে প্রচণ্ড মেরেছিলেন। বাবা পৈতে পরা ছেড়ে দিলেন। আমি নাকি তার পৈতে পরার অধিকার কেড়ে নিয়েছি। অশুচি করেছি বংশকে। আমি কাঁদিনি। মার খেয়েছি নিঃশব্দে। খেতে দেয়নি, খাবার চাইওনি। বাবা মারা গেলেন পরের বছর, মা বললেন আমার জন্যেই নাকি। এতবড় আঘাত! আমি বলেছিলাম বাবার কোলেস্টেরল যতটা হাই ছিল, আর খাওয়াদাওয়ার যা বহর ছিল, বিশেষ করে রেডমিট, তাতে হার্ট অ্যাটাক হওয়াটা অস্বাভাবিক না। মা রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু ততটা না। কারণ মায়ের পাশের পুরুষ মানুষটা আর নেই যে। মা বাবার চাকরিটা পেলেন। আর কয়েক মাস যেতে না যেতেই বাবার যত খারাপ দিক প্রতিদিনের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। চাপা ক্ষোভ। মরে না।

এই যে আমি শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে। আমার নগ্ন শরীর, এ পুরুষ স্পর্শ বিবর্জিতা না। তবে শরীরকে নিয়ে যতটা মানুষ নাড়াঘাঁটা মনে করে, আসলে শরীরে শরীরে অতটা হয় না। শরীর বড় বেশি বাস্তব। বড় লিমিটেশানে মোড়া। মনের মত অবাস্তব সংসারে আর দুটো আছে কি?

সেখানেও শরীরে শরীরে দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে। আমি আমার কোনো ক্ষণিকের পুরুষসঙ্গীকে সুখী করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তারা চায় যুদ্ধ আর বশ্যতা একসঙ্গে। শরীরের মর্যাদাবোধ বড় বেমানান। আমি চোখে-মুখে তাদের অনভ্যস্ত অসহায়তা, রাগের বিকারের ভাঁজ দেখেছি। সব পুরুষ সমান নয় যদিও। তবে সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ধরা দেয়নি। আর বিশ্বের সব পুরুষের সঙ্গে শোয়াও তো সম্ভব না আমার পক্ষে।

এখন আর শরীর চাইলেও মন চায় না। একবার এক লেসবিয়ান বান্ধবীর সঙ্গে শুয়েছিলাম। সে জোর করেছিল কিছুটা, আমারও কৌতুহল ছিল। সে জেগেছিল, আমি না। তার অপমানিত বোধে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম, কেঁদেছিলাম। পরে আমি স্বাভবিক হতে হাজার চেষ্টা করলেও সে হয়নি। হওয়া যায় না হয় তো। যে কারণে হয় তো আমার সেই ক্যাজুয়াল পুরুষ সঙ্গীরাও পরে আর সম্পর্ক রাখতে চায়নি।

এখন আমি পার্কে। আমার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। আমার ঔদ্ধত্য। আমার চারপাশটা নাকি ক্রমশ ‘আমাদের মত মেয়েদের’ জন্য আর বাসযোগ্য থাকবে না। চারদিকে নাকি শাসকের চোখ ঘুরে বেড়াবে। আমার পোশাক, আমার বিছানার সঙ্গী, আমার ঠোঁটে সিগারেট থাকার অনুমতি সব সব নাকি কোড অব কণ্ডাক্টের আওতায় পড়বে। যা ওরা ঠিক করে দেবে।

আমি এই হুমকিতে ভয় পাই না। হতেই পারে। সংসারে সব শক্তিরই একটা বিপরীত শক্তি জন্মায়। উদারতার বিরুদ্ধে একটা সেকেলেপনা ভাবের শক্তি জন্মাবেই। এতে অবাক হই না। খানিক ভোগান্তি বাড়তে পারে, এই যা। আসলে আমি ভয়টা মাত্রারিক্ত কম পাই। তাই হয় তো আমার শূন্যতাবোধও বেশি। ভয়ের একটা সুখী দোসর হয়। সে নিজেকে বেঁধে গুছিয়ে ঘর গড়ে তোলে। আমি পারি না। আমার বাড়ির ভিত যত শক্ত হয়, পাঁচিল তত পোক্ত হয় না। কেন হয় না জানি না। কিন্তু হয় না।

আমার একবার প্রচণ্ড ইউরিন ইনফেকশান হল। তখন আমি বেশ কয়েক বছর হল চাকরি করছি। তো নার্সিং হোমে ভর্তি। একটু আশ্চর্য হলাম আমার মাসিরা কেউ দেখা করতে এল না দেখে। বেশ ভুগেছিলাম, কারণ আরো কিছু কমপ্লিকেসি হয়েছিল। তো মা ছাড়া বিশেষ কেউ দেখা করতে এল না। এদিকে এমন না যে আমি ধ্যাদ্দেড়ে গোবিন্দপুরে কোথাও ভর্তি হয়েছি, আমি বাইপাসের ধারে এক নাম করা নার্সিং হোমেই ভর্তি। এক মাসি বেহালা আর এক মাসি ভবানীপুরে থাকেন। নিজেদের গাড়ি। আমি নাকি তাদের ঈর্ষার কারণ, গর্বের কারণ, তাও এলো না!

বাড়ি এসে জানলাম, আমার দুই মাসিকে আমার এক মাসতুতো ভাই বলেছিল আমার নাকি এইডস হয়েছে। কারণ, আমি আমার ফেসবুকে মদের গ্লাস আর নাইটক্লাবের ছবি দিয়েছিলাম তাই। এরপর থেকে মাসিদের সঙ্গে আমার শুধু সৌজন্যমূলক সম্পর্ক। আর সেই ভাই? করুণা করি। জাস্ট করুণা করি। ওর বিয়েতে ওর বউ-এর জন্য দামি একটা নেকলেস পাঠিয়েছিলাম মায়ের হাত দিয়ে।

তবে মা ভীষণ বদলে গেলেন। আচমকাই। অবসর নেওয়ার পর দীক্ষা নিলেন। নাকি আগে থেকেই নেওয়া ছিল জানি না। হরিদ্বারে গুরুর আশ্রমে পাকাপাকি চলে গেলেন। সেখানে আমার যাওয়ার অনেক অসুবিধা। আমায় শাড়ি পরে যেতে হবে। শাড়ি পরতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু ওই যে আমার বদ স্বভাব, কেউ বাধ্য করলে আমার আর সেটা ভালো লাগে না। আমি যাই না। টাকা পাঠাই নিয়মিত। তবে একা হলেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জন্মায়, মা কেন এরকম করলেন? মা-কি নিজেকে নিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন? বাবার সঙ্গে কাটানো অতগুলো বছর এক রকম, তারপর নিজে চাকরি করে স্বাধীনভাবে বাঁচার দিকটা আরেকরকম। মা নিজের কাছে নিজেকে কি স্পষ্ট চিনতে পারছিলেন না? আইডেন্টিটি ক্রাইসিস শুরু হয়েছিল? আমি জানি আমাদের আইডেন্টিটির একটা বড় অংশ তৈরি করে দেয় সমাজ। নিজের অজ্ঞাতেই তৈরি হয়। বাদবাকি অস্তিত্বটা আমাদের যদি সেই অনুযায়ী হল তো লাইফ ঝিঙ্গালালা, কিন্তু না হয় যদি? এই আমার মত? তবে মাথায় বুকে চিরকালীন দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের সুযোগ নেয় সমাজের কিছু পরাশ্রয়ী পরজীবী মানুষ তখন। তারা বোঝায় আমাদের চিত্তের অশান্তির কারণ আমাদের এই সংস্কারহীন জীবনযাত্রা। আমরা আমাদের পাপের শাস্তি ভুগছি। মন শরীর যতদিন সতেজ থাকে ততদিন লড়ে যাওয়া যায়, কিন্তু কালের নিয়মে শরীর মন দুর্বল হয়, তখন ভাঙাটা সোজা হয়। যেভাবে মা ভেঙে গেলেন। আমি জানি মা অভিনয় করছেন, নিজের কাছে অভিনয় করছেন। কারণ নিজের মত করে নিজে হয়ে বেঁচে থাকা আর সমাজের সঙ্গে একই সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা আর সম্ভব হচ্ছে না মায়ের পক্ষে। মা আত্মসমর্পণ করে শান্তির রাস্তা খুঁজছেন।

এখন অনেক রাত। আমার শোয়ার ঘরে আমি একা। পড়ার টেবিলে বুদ্ধের মূর্তি, অল্প আলোয় জ্বলছে। দেওয়ালে কৃষ্ণের মূর্তি। আমার নিঃসঙ্গ চেতনার দুই পুরুষ। আমার ভালোবাসা। আসলে আমার মনে হয় মা কাউকে ভালোবাসতে পারেননি আজীবন। নিজেকেও না। আমি পেরেছি। আমি নিজেকে ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি এই দুই পুরুষকে, জ্ঞানে আর প্রেমে। মানুষের ভালোবাসা শুদ্ধ হলে তার সমস্ত শুদ্ধ হয়ে যায়। আমার ভালোবাসা আজ আবিলতাহীন। ভয়হীন। অপরিণত মনের আশঙ্কাহীন। আমার ভালোবাসা পরিণত এখন। শুদ্ধ। ধর্মের শুদ্ধতায় নয়, তার নিজস্বতায়, স্বাবলম্বীতায়। মা যে কেন ভালোবাসায় সাবলম্বী হলেন না?