সৌরভ ভট্টাচার্য
15 October 2016
(Anna Karenina নিয়ে রিভিউ লিখব, এমন ক্ষমতা, মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই, আর উন্মত্ত সারমেয় দ্বারা দ্রংষ্টিতও হইনি। তবে কিছু কথা পড়বার পর মনে হল। এ তারই প্রতিফলন। আজও কেন অনেকের মতে প্রথম দশটা উপন্যাসের মধ্যে স্থান পেয়ে আসছে তা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না, বইটা নিজেই তার প্রমাণ।)
'আনা ক্যারেনিনা' – টলস্টয়ের কালজয়ী উপন্যাস। দুটো চরিত্রকে আমার আলোচনার দুটো স্তম্ভ করে নিচ্ছি। এক, আনা। দুই, লেভিন। যারা উপন্যাসটা পড়িনি তাদের জন্য দু-একটা কথায় অতি সংক্ষিপ্তসার করে নেওয়া যেতে পারে।
আনা - অসম্ভব সুন্দরী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও মেধাসম্পন্না, অত্যন্ত Sensitive ও Passionate.
লেভিন – আদর্শবাদী, ধীর, অন্তর্মুখ, জীবন জিজ্ঞাসু, অনুভূতিপ্রবণ, বিচারশীল যুবক।
ঘটনা – ১) আনা – উচ্চপদমর্যাদাসম্পন্ন স্বামীর ঘরণী, এক পুত্রসন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও প্রেমহীন জীবন। তার জীবন শান্ত জলাশয়ের মত স্থির, কারণ তার স্বামী তার ভাষায় একটা নিয়মে চালিত যন্ত্রবিশেষ (চারুলতার স্বামী ভূপতির মত? কিছুটা হয় তো বা)। তার জীবনে এলো উত্তাল কালবৈশাখী ঝড়ের মত ভ্রনস্কি। অসীম প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, বাঁধনহারা, যৌবনমদমত্ত অবিবাহিত যুবক। আনার স্তব্ধ জলাশয়ে হড়কা বান – স্বামী-সন্তান ত্যাগ (প্রথম জনের জন্য কোনো অনুশোচনা নেই, পুত্রের জন্য চূড়ান্ত যন্ত্রণা সারাটা জীবন) – নানান চড়াই উতরাইয়ের পথে তাদের জীবন বইতে বইতে, সমাজের চাপ ঈর্ষা অসন্তোষ ইত্যাদি ডুবোপাহাড়ে লেগে জীবন দুটো তছনছ – আনার আত্মহত্যা।
ঘটনা – ২) লেভিন – সমাজনীতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি – এর কোনোটার সাথেই সে নিজের একাত্মতা পায় না। গ্রামে থাকে। প্রভূত সম্পদের মালিক। চাষবাসে গভীর আগ্রহ, সাথে গ্রাম্যজীবনের সরল জীবনপথে হাঁটতে পছন্দ। কিটি নামে শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকে বিবাহ – নানান সংশয়, বিভ্রান্তি আর আত্মিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে জীবনের একটা অর্থে এসে দাঁড়ানো।
বিশাল উপন্যাস। অনেক চরিত্র। তবে তারা সব জীবনের প্রথাগত পথে হেঁটে চলেছে। কখনো কখনো যে বিচ্যুতি হয়নি তা না। তবে তারা আবার টাল সামলিয়ে চিরাচরিত কোনো একটা পথে গা ভাসিয়ে জীবন কাটানোর সুবিধাজনক সমাধানের পথ খুঁজে নিয়েছে।
আনা পারেনি, লেভিন পারেনি। তারা চেষ্টা করেও সাধারণভাবে সর্বজনস্বীকৃত তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনের সংজ্ঞায় নিজেদের তুষ্ট করতে পারেনি। এইখানেই আমার আশ্চর্য লাগে টলস্টয়ের জীবন ব্যাখান কৌশলের পথকে। মহাত্মা গান্ধী টলস্টয়ের ‘The Kingdom of God is Within You’ বইটা দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। শুধু এই বইটাই নয়, মহাত্মার ‘Passive Resistance’ অথবা ‘অসহযোগ’ পথের দিশাও টলস্টয়ের কাছ থেকে এ কথা তাঁর নিজের বহু লেখায় আছে। এমনকি ‘Letter to a Hindu’ বলে একটা বিখ্যাত চিঠিও টলস্টয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মহাত্মা ভারতে ছাপান, তাঁদের মধ্যে বহু পত্র বিনিময়ও হয়েছে যা চাইলেই পড়তে পাওয়া যায় আজও।
কিন্তু হঠাৎ এসব কথা কেন বলছি? কারণ আছে। টলস্টয়ের অত্যন্ত বিতর্কিত উপন্যাস ‘রেজারেকশান’-এর সপক্ষে একটা চিঠিতে তিনি তার বন্ধুকে লিখছেন, ‘লেখক কি পছন্দ করছেন আর কি অপছন্দ করছেন আমি সেটাই কোনো লেখায় দেখি। আমার এই লেখাটাকেও পাঠক যদি সেভাবে দেখেন তো বুঝতে পারবেন আমি কি বলতে চাইছি।'
এইটাই আমি বলতে চাইছি। লেখকের তথা শিল্পের মধ্যে যদি একটা খোঁজ না থাকে তবে তা খুব তাড়াতাড়ি অতীতের গর্ভে লীন হয়ে যায়। কিসের খোঁজ? একটা অর্থের, একটা সামঞ্জস্যের। পাওয়া যায়? জানি না। তবে সেই খোঁজার পথেই মানুষের মননের অগ্রগতি এতটা বুঝতে পারি। তার মূল গতিশক্তি দুটো – এক কল্যাণ, দুই প্যাশন (আমি দুঃখিত, প্যাশনের ঠিক কি বাংলা হবে বুঝে উঠতে পারলাম না, অভিধানেরাও হতাশ করল)। এক লেভিন, দুই আনা।
মানুষের মধ্যে তীব্র আবেগ আছে, তীব্র বিশ্লেষণী ক্ষমতা আছে। তীব্র আবেগের মধ্যে লোভ, কাম, অহং, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ইত্যাদি সব যেমন আছে; ঠিক তেমন তীব্র বিশ্লেষণী ক্ষমতার মধ্যে ঈর্ষা, অবসাদ, শুষ্ক নিয়মানুবর্তিতা, সুচতুর কপটতা আসার উপাদান আছে। এই দুইয়ের মধ্যের টানাপোড়েনে আমাদের জীবন। কোনো একটাকে বল্গাহীন করে তুললেই বিপদ আসন্ন। জীবনতরী ডোবার আশঙ্কা। তাই মানুষকে শুধু প্রাকৃতিক, শারীরিক ইত্যাদি শত্রুর সাথেই লড়তে হয় না। তার সব চাইতে বড় শত্রু সে নিজে হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাসে এর ব্যক্তিগত আর সমষ্টিগত বহু উদাহরণ আছে।
আনা এই জটিল পরিস্থিতির একটা উজ্জ্বল উদাহরণ। সে যখন শেষ অঙ্কে এসে উপস্থিত, স্টেশানের দিকে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ীতে বসে। তার মনের মধ্যে উঠেছে তীব্র ঝড়। সে বুঝছে, তার বাইরের পরিবেশ সম্পূর্ণ অনুকূল হয়ে গেলেও সে সুস্থ শান্ত জীবনে ফিরতে পারবে না। তার কারণ আর কেউ না, তার নিজের মনের মধ্যের রিপু। চূড়ান্ত অসন্তোষ, ঈর্ষা, নিরাপত্তাহীনতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। সামান্য ইন্ধনই তার জীবনকে শেষ করার জন্য যথেষ্ট। আর সে সেই মৃত্যুকেও বেছে নিতে চায় একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিশোধের স্পৃহাকে রূপ দেওয়ার জন্যে। কার ওপর? যেন তার প্রেমিকের ওপর? তবু যেন কোথাও নিজের ওপরেও।
লেভিন বুঝল তার এতদিনের নানান দার্শনিক আলোচনা, জীবনের অর্থ খোঁজার যে অসীম তাগিদ, প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরোধিতা করা (এখানে খ্রীষ্টধর্মই বলা হয়েছে), নিজের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসের যন্ত্রণা অনুভব করা – এগুলোর কোনোটাতেই সে নিজেকে খুঁজে পেলো না। তবে সে জীবনের ডাকে সাড়া দিয়েছে শুধু নিজের কাছে নিজে সৎ থাকার জন্য। নিজেকে ঠকায়নি। কিটিকে বিয়ে করেছে, বাবা হয়েছে। চূড়ান্ত ভালোবেসেছে স্ত্রীকে। ঈর্ষান্বিত হয়েছে পরপুরুষকে নিজের স্ত্রী'র কাছে দেখলে। সে কোনোটাকেই অস্বীকার করেনি। কিন্তু লজ্জা পেয়েছে। এ সবের ঊর্দ্ধে কোথাও একটা জীবনের মানে খুঁজেই চলেছে। অবশেষে তা পেয়েছে এক অশিক্ষিত কৃষকের মুখে। তার অন্তরাত্মা জেগে উঠেছে। সে এতদিন দেখেছে শুষ্ক জ্ঞানচর্চা মানুষকে কেমন কৃত্রিম ভীরু স্বার্থান্বেষী করে তোলে; আবার এও দেখেছে চূড়ান্ত আবেগ কিভাবে মানুষকে নিজের ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
তবে এর মধ্যে সঠিক পথটা কি? সে বুঝল কল্যাণের পথ। কিসে কল্যাণ প্রতিটা মানুষ তার অন্তরের গভীর বিশ্বাসে জানে। প্রতিটা ধর্ম সেই কল্যাণের পথকেই ন্যায়-অন্যায়ের বিভাজন রেখায় ভেঙে দেখাতে চেষ্টা করে। কেবল স্বার্থের জন্য বাঁচা কোনোদিনই মানুষকে সার্থক করবে না। তাকে কল্যাণের পথে হাঁটতেই হবে। সে কল্যাণ যুক্তির পারে আর আবেগের পারে। তা শান্ত স্নিগ্ধ ধ্রুবতারার মত মানুষের অন্তর্লোকে সদা বিরাজমান। তাকে খুঁজে নিতে হবে। সেই পথকে স্থবির করে তুললে তা শুধুই নিয়মাবলীর ধর্ম। আর সেই কল্যাণকে স্বীকার করে শ্রমের মাধ্যমে জীবন ধারণেই ঈশ্বরের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য, জীবনের সার্থকতা।
সব শেষে বলি, কোনো একটা অর্থহীন মুহুর্তকে অর্থ এনে দিতে পারে একটা উৎকৃষ্ট সাহিত্য। এইখানেই পাঠক ধন্য, লেখক সার্থক আর জয়ী মানুষের ভাবের ধারা, ভাষার নদীতে।
তখনই আরেক পা হাঁটতে ইচ্ছা করে, জীবনের আরেকটা বাঁকে মোড় ফেরাতে সাহস হয়, আশা জাগে।
=============================
(ইবুক - বঙ্গানুবাদ - ননী ভৌমিক)
কৃতজ্ঞতাঃ www.sovietbooksinbengali.blogspot.in