Skip to main content


       (আজ সুমনের জন্মদিন। এই লেখাটা ওর জন্যেই, আমার ছোটোবেলার একটা টুকরো। এর থেকে বেশি নিজের আর কি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব তাকে, আমার এই লেখালেখি যাবতীয় কিছুর মূলেই যার প্রেরণা-উৎপাত।)


        তখন আমি অনেক ছোটো। সালকিয়ায় আমাদের বাড়ির সামনে একটা বিশাল বড় অশ্বত্থ গাছ ছিল। আমার জন্মের আগে থেকেই ছিল। আমার জন্ম সালকিয়ায়। মানে হাওড়ায়। সেখানে আমি ক্লাস ফোর অবধি ছিলাম, তারপর কাঁচরাপাড়ায় চলে আসি। সালকিয়ায় অমন ঘিঞ্জি চারদিক। তবু ওই অশ্বত্থ গাছটার সাথে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক দুটো প্রাণ আমার গভীর প্রাণের সাথে যোগ বেঁধেছিল। এক ওই অশ্বত্থ গাছটা আর দুই আমাদের সিঁড়ির ঘরের টালির ছাদের নীচে থাকা কাঠবেড়ালিটা। কিন্তু সে কাঠবিড়ালিটার দেখা তো সব সময় মিলত না। তাই আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড বলতে বুঝেছিলাম ওই অশ্বত্থ গাছটাকে। 
        স্কুল থেকে ফিরে ছাদে। ছুটির দিন সকাল-বিকাল ছাদে। খুব গরমে ছাদে সবাই মিলে বিছানা করে শোয়া। ছাদ আমার জীবনের একটা বিরাট অবকাশ ছিল। আমার মাথাটা যেন বিশাল একটা মাঠ হয়ে যেত ছাদে গেলেই। যত রাজ্যের কল্পনা সব পাখির মত উড়ে এসে আমার মাথার ডালপালাটায় বসে থাকত। আমিও যেন তখন ওই অশ্বত্থ গাছটার মত, একা বিশাল। মাঝে মাঝে গাছটাকে আমার একচালা দূর্গা ঠাকুরের মত মনে হত। অমন বিশাল একটা চালা করে যেন মা দূর্গা তার লক্ষী-গণেশ-সরস্বতী-কার্তিক অসুর সবশুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। মা যখন কোনো কারণে বাড়িতে অনুপস্থিত থাকতেন তখন ওই গাছটাকে আমার মায়ের মত মনে হত। ওর ডালপালা সব নাড়িয়ে যেন আমার সাথে কত কথা বলত সে রাতদিন। আমায় জিজ্ঞাসা করত আমি কেমন আছি। আমায় ওর ডালে বসা পাখিদের কথা বলত। ওর নতুন পাতা হলে আমায় দেখতে বলত। সেকি আনন্দ তখন তার। কচি সবুজ পাতাটা সূর্যের আলোয় নাচিয়ে নাচিয়ে বলত, কি দারণ দেখাচ্ছে না? আমি বলতাম, হ্যাঁ তো। ওর আনন্দের শিহরণ আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হত। আমিও নতুন জামা হলে ওকে দেখাতে যেতাম। ভীষণ খুশী হত ও। 
        সন্ধ্যেবেলা যখন প্রচুর পাখি কিচিরমিচির করে ওর মাথা পাগল করে দিত, সেই সময়টা ও আমার দিকে তাকাবার অবকাশ পেত না। তখন ওকে দেখে আমার স্কুলের নাম ডাকার সময়ের কথা মনে হত। যেন ও রোল কল করছে আর সব পাখিরা ডানা তুলে তুলে “উপস্থিত” বলছে। কত পাখি ওকে আদর করত, জড়াতো, ওর সাথে গল্প করত, দেখে আমার দারুণ লাগত। আমি নীচে নেমে আসতাম। তখন তো আমাদের এখনকার মত টিভি ছিল না। পড়া হয়ে গেলে আবার ছাদে উঠতাম। তখন গাছটা সব পাখিদের বাসাগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখের ইয়াশারায় বলত, “ঘুমিয়েছে সব”। কি প্রশান্তি ওর চোখেমুখে। তারপর আমি আর ও ফিসফিস করে কত কথা বলতাম। আমি বলতাম আমার স্কুলের গল্প, ঠাকুমার বলা গল্প, ভিখারির গল্প, জামাছেঁড়া বন্ধুর গল্প, ফুটপাথে ল্যাংটো বাচ্চার গল্প। ও চুপ করে শুনত। দুঃখের গল্পগুলো শুনলে ও উদাস হয়ে যেত, আমি স্পষ্ট বুঝতাম। আবার মজার গল্প শুনলে সারা শরীরটা কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠত। সেই হাসিতে কোনো কাক উঠে পড়ে দুবার কা কা করে ডেকে বিরক্তি জানিয়ে শুয়ে পড়ত। ও মুচকি হেসে বলত, খেতে যাবে না? 
        একদিন হল কি, দেখি অনেকগুলো লোক গাছটার তলায়। জিজ্ঞাসা করলাম ওরা কেন এসেছে? ঠাকুমা ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। বললেন, ওর একটা ডাল কাটা হবে, ওইদিকটায় ওরা একটা ঘর বানাবে। আমি শুনে চমকে উঠলাম। একটা যন্ত্রণায় কুঁকড়িয়ে বললাম, বারণ করা যাবে না? ঠাকুমা হেসে বললেন, ওটা তো ওদের জমি, ওই গাছটাও ওদের। ওরা চাইলে কাটতেই পারে। আমি বললাম, না তো, ওই জমিটা তো ওই গাছটার! ঠাকুমা বললেন, “গাছেদের জমি হয় না।“ সেদিন একটা নতুন কথা শিখলাম - গাছেদের জমি হয় না, পাখিদের জমি হয় না, কাঠবিড়ালির জমি হয় না, গরু-শুয়োরের জমি হয় না... জমি হয় শুধু মানুষের। আমার কান্না পেল। আমি গাছটার দিকে না তাকিয়ে নীচে নেমে গেলাম। নামতে নামতে শুনতে পেলাম গাছটা ডাকছে আমার নাম ধরে। আমি সাড়া দিলাম না। 
        কয়েকদিন ছাদে গেলাম না। মা ভাবলেন শরীর খারাপ। ঠাকুমা বুঝলেন। বললেন, উপরে যা, ওরা ডালটার একটা ছোট্টো দিক ছেঁটেছে খালি, তার নীচেই করেছে ঘরটা। খুব সম্ভবত খাটাল ছিল। আমি এক দৌড়ে ছাদে গেলাম। সত্যিই তাই তো! আমার কি আনন্দ। সাথে অল্প দুঃখ হল। গাছটা বলল, লাগেনি তেমন। 
        আমি সালকিয়ায় থাকতে একবারই বেড়াতে গিয়েছিলাম কালিংপঙ আর দার্জিলিং। গরমকাল। আমরা ছাদে শুয়েছি। পরেরদিন ট্রেন। আমার সারারাত ঘুম আসছে না। আমি বারবার ছাদে উঠে পায়চারি করছি। আর গাছটার দিকে তাকাচ্ছি। গাছটার মন খারাপ। ও কথা বলতে চাইছে না আমি বুঝতে পারছি। হাওয়া দিলে যে মর্মর আওয়াজ হয় আমি তাতেই টের পাই ও কিরকম আছে। সেদিন সারারাত আমি আর গাছটা চুপ করে কাটালাম। বাড়ির সবাই বলল, বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে নাকি আমার ঘুম হয়নি। বড়রা এত বিশ্বাসের সাথে ভুল কথা বলে, সে তখনও কি, এখনও কি। বাইরে রিকশা এসে গেছে আমি ধাঁ করে একবার ছাদে এসে দাঁড়ালাম। কি আশ্চর্য একটা অশ্বত্থ পাতা এসে উড়ে পড়েছিল ছাদে। ও বলল, ওটা নিয়ে যাও। আমার তখন নিজের ব্যাগ কোথায়? প্যান্টের পকেটেই রাখলাম। কিন্তু কালিংপঙে গিয়ে আর খুঁজে পেলাম না।
        ফিরে এসে দেখি কি কাণ্ড! তুমুল ঝড় হয়েছিল নাকি আগের দিন রাতে –কালবৈশাখী। গাছটার একটা ডাল ভেঙে সেই নীচের টালির বাড়ি তছনছ করে দিয়েছে। গাছটা খুব বিমর্ষ মুখে একটা দিকে ইঙ্গিত করল। দেখলাম একটা পাখির বাসা ভেঙে পড়ে। কয়েকটা পাখির বাচ্চা নাকি মারা গেছে। একটা মরা বাচ্চা বেড়াল মুখে করে আমাদের বাড়ির ছাদের কার্ণিশেই খেতে এসেছিল। লাঠি নিয়ে ভাগিয়েছিলাম। মরা বাচ্চাটা মুখে করেই দৌড় দিল।


        এরপর আমরা কাঁচরাপাড়ায় এলাম। সময় এগোতে লাগল। মাঝে মাঝে সালকিয়ায় যখন যেতাম গাছটার সাথে দেখা হত। আমি বড় হলাম, কিন্তু ও যেন বড় হল না। ও যেন ধীরে ধীরে আমার নাগালের বাইরে চলে যেতে লাগল। আমরা দুজনেই দুজনকে বুঝতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে যেন কথা সব ফুরিয়ে গেছে। তবু ওর সামনে শেষদিন অবধি দাঁড়িয়ে একটা শান্তি পেতাম। ওই ইট-কাঠ-সিমেন্টের জঙ্গলে ওই ছিল আমার এক মরুদ্যান। আমার প্রাণসখা। শেষদিন পর্যন্ত। কথা ফুরালেও বন্ধুত্ব ফুরায় না। আজ এতদিন পর সেই মুহূর্তগুলোকে ছুঁয়ে দেখলাম ওরা একই রকম রয়ে গেছে। সময় যেন কোথাও একটা দাঁড়িয়ে আমাদের বরাদ্দ অংশটুকুকে বাঁচিয়ে রেখেই দেয়। আমরা অকৃতজ্ঞের মত বিস্মৃতির আড়ালে তাদের একলা ফেলে আসি। সে ফেলে যায় না। ছেড়ে যায় না। 

        শুভ জন্মদিন। ভালো থাকিস। আনন্দে থাকিস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, জীবন যেন বড় দুঃখকে বরণ করার যোগ্য হয়। ছোটোক্ষুদ্রের পায়ে নিজেকে জলাঞ্জলি না দিয়ে।