Skip to main content

ওর কি হয়েছে বলুন তো? ঘুমাচ্ছে না ক'দিন হল। সারারাত এপাশ ওপাশ করে। মশারি তুলে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করে আমায়, দাদা, এখন রাত না দিন? আমি বলি, রাত তো! সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথার চুলগুলো টানতে টানতে বলে, আমারও তো তাই মনে হচ্ছে, এখন তো রাত, তবে!?

    সকালে উঠে চুপ করে বিছানায় বসে থাকে। আমি কাছে গেলে জিজ্ঞাসা করে, আমি পা দেব? এটা কি মাটি না নদী?

    আমি বলি, মাটি। 

    সে আবার নিজের গালে দুটো চড় মেরে বলে, আমারও তাই মনে হচ্ছে দাদা এটা মাটি... তবে যে....

    স্নান করতে করতে হঠাৎ বাইরে চলে আসে। উলঙ্গ অবস্থাতেই। আমায় এসে বলে, দাদা এটা কি জল? আমার শরীর কিসে ভিজে গেল, জলে না রক্তে? না ধুলায়?

    আমি বলি, জল। 

    সে নিজের কাঁধ চাটতে চাটতে বলে, আমারও তো তাই মনে হচ্ছিল দাদা এটা জল, আমি ভিজছি। তবে যে ওরা....

    দুপুর হয়। কাঠফাটা রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি গেলে জিজ্ঞাসা করে, দাদা, আমি পুড়ে যাচ্ছি না ভিজে যাচ্ছি? এটা রোদ না বৃষ্টি?

    আমি বলি রোদ। 

    সে বিশ্বাস করে না। যখন বৃষ্টিতে ভেজে, আমি বলি জল। সে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমায় বলে, তুমি কিচ্ছু জানো না। কেউ কিচ্ছু জানে না। সবাই ঠকিয়েছে। 

    তারপর সে সন্ধ্যে নামলে দেওয়ালে টাঙানো সদ্য বানানো ছবিটার দিকে যায়। চন্দন দেয়। মাটিতে বসে। আলুথালু হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। তারপর আবার সেই একই গল্প বলে। 

    দাদা, ছেলেটা আমার কাজ থেকে এসে বলে, "মা, আমার জ্বর।" আমার ভয় হল। আমি বললাম, ঠিক হয়ে যাবে। পরেরদিন সকালে উঠে বলল, "মা, আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে"। আমার ভয় লাগল আরো। ছাব্বিশ বছরের ছেলে কুঁকড়ে যাচ্ছে শ্বাস নিতে না পেরে। আমি হাস্পাতালে নিয়ে গেলাম। ওরা করোনা টেস্ট করে বলল, পজিটিভ। আমার আর ভয় লাগল না। আমার আর কিচ্ছু লাগল না। আমি পাথরের মত হলাম। ওর মুখে অক্সিজেন লাগানো। আমি বাইরে এসে গাছতলায় বসলাম। হঠাৎ দেখি সবাই খুব দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আরে ভাই, তোমরা এরকম দৌড়াদৌড়ি কেন করছ? কি হল?

    তারা আমায় ভয় পাইয়ে দিয়ে বলল, আরে মাইঝি হাস্পাতালে আর একঘন্টা চালানোর মত অক্সিজেন আছে। কেউ থাকলে তাড়াতাড়ি অন্য হাস্পাতালে নিয়ে যান। 

    আমি দৌড়ালাম দাদা। যেন আমায় ষাঁড়ে তাড়া করেছে। যেন আমায় পাগল কুকুরে তাড়া করেছে দাদা। একে ওকে ঠেলেঠুলে, ধাক্কা দিয়ে আমার ছেলের কাছে গেলাম দাদা। মাছকে যেমন ডাঙায় তুললে ছটফটায় দাদা, প্রদীপের শিখা যেমন ছটফট করে ঝড়ে, তেমন ও ছটফট করছে। অক্সিজেনের মাস্ক খুলে নীচে পড়ে। আমার আশেপাশে অনেকেই শান্ত হয়ে গেছে দাদা। হাস্পাতালে অক্সিজেন নেই। ছেলেটা চোখের সামনে শান্ত হয়ে গেল। চোখ দুটো কপালে উঠে গেল দাদা। আমার আর মনে নেই। বাবুর এই ছবিটা ওর একজন বন্ধু দিল, ওর মোবাইলে ছিল। ছ'মাসের নাতি আমার, চেনাতে হবে তো দাদা!

    আবার উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ির নীচে রাখা খবরের কাগজের স্তূপ তুলে নিয়ে স্ট্রিট লাইটের আলোর নীচে গিয়ে বসল। ভালো করে পড়ে বলল, কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে কেউ যে মারা যায়নি সরকার বলছে?.... এই ভাই তুমি একটু পড়ো তো... এই দাদা... এই বোন.... এই তুমি... এই আপনি... এই.... একটু পড়ুন তো... আমি ঘরের আলোয় পড়েছি... এখন বাইরে এসে পড়ছি... রাস্তায় বসে পড়ছি.. আমি কেন কিছু বুঝতে পারছি না.... আমার খুব চাপা চাপা লাগছে বুকটা.... আমারও জ্বর.... নাকি আমার জ্বর নেই..., নাকি আমার বুকটা জন্ম থেকেই এমন চাপা চাপা.... হাওয়া ঢোকে না.... আমার কি হল দাদা?

    আমি দেখছি উনি খবরের কাগজগুলো বগলে নিয়ে হাঁটছেন। ক্রমে একটা একটা স্ট্রিট লাইট পেরিয়ে যাচ্ছেন। অন্ধকারে মিশে যাচ্ছেন। শুধু ক্ষীণ গলার আওয়াজটা পাচ্ছি, আমি কি ভুল বুঝছি দাদা... আমি কি ভুল?....