সৌরভ ভট্টাচার্য
12 February 2019
সাদা চাদরে মোড়ানো দেহটা একটা ট্রলির উপর রাখা। বসন্তকাল। হাসপাতালের সরু করিডোরের একদিকে দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা। নার্স, আয়া, রুগীদের বাড়ির লোক, কখনও কখনও রুগী, ডাক্তার যাতায়াত করছে। কেউ তাকাচ্ছে না। আমার দিকেও না, চাদরে ঢাকা মৃতদেহটার দিকেও না।
বসন্তকাল। যিনি মারা গেছেন তিনি আমার কেউ নন, মানে পারিবারিক কেউ নন। পাড়ার পরিচিত। ছেলে আসতে দেরী। স্ত্রী বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে। সকাল দশটা।
আমার রুটির ঢেকুর উঠল, টকটক। রুটি সহ্য হয় না। হাফ সোয়েটারটা খুলতে হবে, গরম লাগছে। কিন্তু রাখব কোথায়? কাকুর পাশে? হ্যাঁ, এই মৃত মানুষটাকে কাকু বলে ডাকতাম। বাবার সাথে রেলে কাজ করতেন। রিটায়ার করেছেন চার বছর হল। ক্যানসার হয়েছিল। ধরা পড়ল লাস্ট স্টেজে। লিভার ক্যানসার। বসন্তকাল। সামনের মাঠে পলাশ ফুটেছে। সোয়েটারটা গায়েই। অল্প ঘাম হচ্ছে, হোক। রাখব কোথায়?
চা খেতে হবে। কিন্তু মৃত শরীর ছেড়ে যেতে নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা’টা টাটাচ্ছে। অল্প অল্প চাপ আসছে। টয়লেট যেতে হবে। ট্রলিটা পুরোনো। রেলের হাস্পাতাল। আমি মেডিসিন ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে। দেওয়ালের ওপারে সার সার রুগী শুয়ে। পুরোনো পাখা ঘোরার আওয়াজ আসছে। ট্রলিটা পুরোনো। জং ধরে গেছে ধারে ধারে। চাকাগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। একটা চাকার উপরের কভারটা ভাঙা। হাতলের উপর প্লাস্টিকের মোড়কটা ফাটা। কত মৃত শরীর আর সুস্থ শরীর নিয়ে যেতে যেতেও ক্লান্ত হয়নি। লোহা ক্লান্ত হয় না। গাছ ক্লান্ত হয় না। মানুষ হয়। একটা বেড়াল বহুবার ওয়ার্ডের ভিতর গেল এল। বেড়াল ক্লান্ত হয়, শরীরে, বেড়ালের মন নেই। একটা মৃতদেহ, একটা জ্যান্ত মানুষ আর দূরে একটা পলাশগাছ – এসবে বেড়ালের কিছু আসে যায় না। অথচ প্রাণের বিজ্ঞানটা এক। প্রাণ ধারণ, প্রজননের কৌশলটা এক। মস্তিষ্কে আলাদা। আমার পাশে এখন একটা মৃত মস্তিষ্ক। রেলের কর্মচারীর মৃত মস্তিষ্ক। এক ছেলে, এক মেয়ে বড় করা, LIC, পেনশান, গ্র্যাচুইটি, রাজনীতি, পারিবারিক সুখ-দুঃখ, অর্থ-কাম-ধর্ম – একটা মস্তিষ্ক। মৃত মস্তিষ্ক। মোক্ষ। একটা ফুলের গন্ধ আসছে। খিদে পাচ্ছে। হিসি পাচ্ছে। নার্সদের জামার উপর শক্ত হয়ে আসা বুক। রুগীর খাবার দিতে আসা অবাঙালী সরু ছিপছিপে কোমর – মহিলা। মেয়ে। স্তন, একটা বিশেষ গন্ধ, একটা মাথা ঝিমঝিম অনুভব, কাম। প্রেম। বসন্ত। আর চেপে রাখা যাচ্ছে না, পাবলিক টয়লেট, নার্স আমি একটু আসছি, টয়লেট থেকে। মৃত শরীরটা থাকল।
খেয়ে এলাম একবারে, বাটার টোস্ট। আজ কলেজ যাইনি। কয়েকদিন যাইনি। ভালোবেসে না। এটা একটা স্যাক্রিফাইস। ভালো লাগছে, নতুনরকম। মহৎ লাগছে। সবার থেকে। যারা নিজের জন্যে, নিজের পরিবারের জন্য হাস্পাতালে আসছে তাদের থেকে নিজেকে অন্যরকম লাগছে। মহৎ। শ্মশানে যাব। রাত হবে। হোক। শ্মশান মানে আগুন। এই শরীরটা পুড়বে। আমার নিজের হাতের দিকে চোখ গেল। খড়িফোটা গা। আমি তেল দিই না। আমার হাতের উপর মাংস। হাড়। পুড়বে। পুরো শরীরটা পুড়বে। মেয়ে মানে নারী। নারী শব্দটা অনেক ঘন। মানুষের থেকেও বেশি। একটা ফুলের গন্ধের মত। মৃত্যু, শ্মশানের থেকেও বড় একটা শব্দ। নারী। মহাকাশের মত। শেষ নেই। আশ্চর্য লাগছে। পাশে একটা লাশ। গতকাল রাতেই যাকে হরলিক্স খাইয়ে গেছি। তার পাশে দাঁড়িয়েই শরীর আসে মনে? ইরেকশান হয়? মনের উপর একটা চাদর থাকে। না সরালেও হয়। হরমোনাল ফ্লেভার চিন্তার বিন্দু বিসর্গে। দাগচাপা সঙ্গম। পিট্যুইটারি? এইটাই ড্রাইভিং ফোর্স অব লাইফ? কাকুর শেষ দিন সেক্স এসেছিল থটে? আসে? মৃত্যু আর সেক্স খুব কাছাকাছি। পরিপূরক।
কেউ আসছে না। বিকাল হবে। ওরা খাট, ফুল, গাড়ি নিয়ে একেবারে আসবে। আমার কি শোক হচ্ছে? না। বিস্ময়। এই প্রথম মৃত্যু নয় যদিও আমার অভিজ্ঞতায়। কিন্তু এতক্ষণ একা একটা মৃতদেহের সাথে এই প্রথম। এরকম রোজকার ঘটনার মত বৈশিষ্ট আকর্ষণহীন হয়ে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। একটা মানুষ শেষ হয়ে গেল। একটা গোটা জীবন শেষ হয়ে গেল। অথচ এমন সাদামাটা চারদিক।
দুটো বাজে। ঝিম ধরা চারদিক। বিষণ্ণ লাগছে। হাত-পা ছেড়ে দিচ্ছে। নার্সকে বলে ভিতর থেকে একটা টুল নিয়ে এলাম। এখন নার্সের শরীর মানুষের মত। সেই বেগটা কেটে গেছে। খিদে পেলে কাম বাড়ে। বেড়ালটা ঘুমিয়ে ট্রলির তলায়। একবার মনে হল চাদরটা সরিয়ে মুখটা আরেবার দেখি। থাক, ইচ্ছা করল না। কাকুর সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত মনে করলাম। একসাথে ক্রিকেট দেখা, বাজারে দেখা হলে সাইকেল থেকে নেমে কথা বলা, পরীক্ষার পর উদ্বিগ্নতায় কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করা... কিন্তু মনে কোনো সাড়া নেই। তবে কি মানুষের শোকটা লোক দেখানো। আমার ব্যক্তিগত জীবনে যেহেতু কোনো পরিবর্তন হবে না তাই... কিন্তু আমার মনে হচ্ছে লোকের সামনে এলে আমি কাঁদব। কাঁদতে ভালো লাগবে তখন। মাকে কাল চিকেন আনতে বলব। কাল রবিবার তো। দু'জন রুগী এসে জিজ্ঞাসা করল এতক্ষণে, কি হয়েছিল? কয়েকজন চিনতে পারল। আজ শনিবার। হাফ ছুটি। একজন একজন করে কাকুর বন্ধুরা আসতে লাগল। একজন জিজ্ঞাসা করল, তুই কি বাড়ি যাবি? ইচ্ছা হল যাই, কিন্তু কোথাও মনে হল, এতটার পর হেরে যাব যেন। অন্য কেউ ফোকাসিংটা খাক চাই না। আমি নিজেই থেকে যাব। নিজের জন্য থেকে যাচ্ছি। ঠিক ইমেজ বানানোর জন্য নয়, নিজেকে একটা কেউকেটা মনে হচ্ছে। একটা জেন্যুইন কাজ হচ্ছে মনে হচ্ছে। শোক নেই, দায়িত্ববোধ নেই, ওসব তো লোক দেখানো কথা। আসলে আমি চাইছি লোকে আমায় নিয়ে আলোচনা করুক, আমায় চিনুক। আলাদা করে চিনুক।
লরিটা ঢুকছে। পাড়ার প্রচুর লোক। লরি থেকে নামছে। নিজের বুকের মধ্যে একটা হাপর পেটানো আওয়াজ, উত্তেজনা, বিকাল চারটে বাজে। আমার এইবার কান্না পাচ্ছে। চোখটা চিকচিক করছে। কাকুর ছেলে এসে জড়িয়ে ধরল। কাকুর ছেলে কাঁদছে আমায় জড়িয়ে ধরে। আমার বয়েসীই প্রায়। হেরে গেছে যেন, ভাগ্যের কাছে। আমি জিতের দলে, সুখীদের দলে। আমি আজ সান্ত্বনা দেব। জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেব। নির্ভয়ে, নিরাতঙ্কে কাঁদব। সুখ লাগবে। সবাই কথা বলছে। আমি শুনছি। উত্তর দিচ্ছি। আমি এতক্ষণ একা থাকাটা চেরিশ করছি। নিজেকে দেখছি। বাইরে কোকিল ডাকছে। বসন্তকাল। আমরা শ্মশানে যাচ্ছি।