Skip to main content

কুকুরটাকে কি জোর লাথি মেরে গেল। কুকুরটা কেঁউ কেঁউ করে কয়েকবার চীৎকার করল, কাঁদল। চুপ করে গেল একটু পর। ঘুমিয়ে পড়ল।

পরেরদিন আবার সকালে তার কি ফুরফুরে মেজাজ। একটা বিস্কুটেই কি বেজায় খুশী। লেজ নাড়ালো। পা’টা চেটে দিল। আমি বললাম, হ্যাঁ রে, এই যে কাল এত্ত জোর লাথি খেলি, কষ্ট হল না? অপমান লাগল না?

সে লেজ নেড়ে জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন বলছে, এত কিছু মনে রাখো কেন?

চলে গেল। রাস্তায় আসি যাই, ওর সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। বেজায় ভাব আমাদের। তো হল কি, তার বাচ্চা হল চারটে। কি সুন্দর কি যে বলি। সিঁড়ির তলায় বস্তা পেতে দিলাম। মাঝে মাঝেই যাই, আদর করি, বাচ্চাগুলোকে কোলে নিই। সে কিচ্ছু বলে না। কিন্তু অচেনা কেউ এলেই বেজায় সতর্ক হয়ে যায়। কামড়াবার ভয় দেখায়। দেখাবেই তো, বাচ্চাগুলোকে রাখতে হবে না?

রাখতে আর পারল কই? তিনটে বাচ্চা একে একে মরে গেল, একটু বড় হতে না হতেই। আমি জানি ওর মন খারাপ হল। কদিন কম কম খেল, কি খেলই না। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত। ডাকলে সাড়া দিত, কিন্তু লেজটা নাড়ানোর তেমন উৎসাহ ছিল না। ওর কষ্ট হত। আমারও হত।

আবার সব ঠিক হয়ে গেল। সবই ঠিক চলছিল। এর মধ্যে হল এক দুর্ঘটনা। একটা পা বাইকে চাপা পড়ল। পা’টা আর সোজা হল না। পাঁচিলে যে উঠত এক লাফে, সে আজকাল অপেক্ষা করে থাকে গেট খোলার। যার সঙ্গে দৌড়ে পারা মুশকিল ছিল, সে আজকাল দৌড়ায় টাল খেয়ে খেয়ে। তবু সে হাঁটে। ডাকলে আসে। লেজ নাড়ে। নিজের মনে আগের মেজাজেই ঘুরে বেড়ায়।

কয়েক বছর গেল। এই তো কদিন আগে। সারাদিন রঙ খেলা হয়েছে। ওর গায়েও অল্প অল্প রঙ। আমি আর ও পাশাপাশি বসে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। দোলের পূর্ণিমার চাঁদের রঙ যেন বেশি জ্বলজ্বলে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছিস? এই যে এত মার, এত অপমান, এত মৃত্যু, এত আঘাত, এত যন্ত্রণা - এ সব সহ্য হয় কি করে? মরে যেতে ইচ্ছা করে না? এই তো এত কাছেই রেললাইন, শুয়ে পড়িসনি তো?

সে আরো কাছে এগিয়ে এসে বসল। বলল, মরে যাওয়াই কি একটাই সমাধান গো!

বললাম, তবু…

সে বলল, তবু তো বাঁচতে হবে। আমি এইটুকুই জানি, তবেই তো বাঁচতে বাঁচতেই অনেক কিছু বোঝা হয়ে যাবে। ফস করে নিজেকে শেষ করে দিলে হবে?

আমার অনেক মানুষের মুখ মনে পড়ল। যাদের মান নেই, কিন্তু জান আছে। সমাজ তাদের দুচ্ছাই করে রাখলেও তারা আছে। দুরকমের মান আছে। একটা পোশাকি, যা কেড়ে নেওয়া যায়, যাতে কালি ঢেলে দেওয়া যায়। আরেকটা মান আছে, অনেক গভীরের। সে অবিনশ্বর, যাকে পোড়ানো যায় না, ভেজানো যায় না, রাঙানো যায় না। সে নিরঞ্জন। নিরাকার। নির্দ্বন্দ্ব। নির্ভয়। নির্বৈর। তার জৌলুস নেই, জ্যোতি আছে। আর আছে খুব গভীর একটা বাক্য - তবু আমি আছি, আমি থাকব।

তার উপরেই এই গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জেগে আছে।