Skip to main content

সনাতন বৈরাগীকে দেখলে মনে হবে এরকম মানুষ তো প্রায়ই রাস্তায় চলতে ফিরতে চোখে পড়ে। বিশেষত্ব বলতে তো কিছু নেই!

কথাটা ঠিক। কিছু মানুষকে চোখে পড়ে, যারা বারান্দায়, মন্দিরের চাতালে, স্টেশানের এক কোণায়, ফুটপাথের এক পাশে, চায়ের দোকানের বেঞ্চের শেষে - এমনভাবে বসে থাকে, যেন সমস্ত চলমান জগতটার সাক্ষী থাকা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। ভাবলেশহীন মুখ, স্থির, শূন্যদৃষ্টি।

সনাতন বৈরাগী ঠিক এমনই মানুষ। এত এত মৃত্যু তার পরিবারের উপর দিয়ে বয়ে গেছে, সনাতন মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না, সে জগতের কোনদিকে? পুরো সংসারটা যেন কফের মত গলার কাছে আটকে, দম আটকে। ফেলে দিলেও হয়, আবার গিলে নিলেও হয়। কিন্তু কিছু একটা কারণে না যাচ্ছে গেলা, না ফেলা। সনাতন মৃতের মত বেঁচে আছে।

মন্দিরে যেখানে জুতো রাখা হয়, তার একপাশে বসে আছে সনাতন। সকাল থেকে জ্বর। একবার ভেবেছিল বেরোবে না আজ, কিন্তু এই বিকেলটা মন্দিরে না এলে মনটা সরতে চায় না। বিল্ব চা দিয়ে গেল। এই পাশেই দোকান। কোন ছোটো বয়সে দোকান খুলেছিল, তখন সনাতন জুটমিলে কাজ করত। বিল্বই একমাত্র মানুষ, যে সনাতনকে জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছ জেঠু?

মন্দিরের থেকে কুড়ি পা এগোলেই গঙ্গা। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। মাফলারটা গলায় চেপে বসিয়ে নিল সনাতন। এখানে বসেই মহাদেবকে দেখা যায়। আলো জ্বলে গেছে মন্দিরে। শীতের বেলা না? অল্পতেই অন্ধকার। সনাতন তাকিয়ে আছে। অতীতের কথা ভাবছে। জ্যোৎস্নার কথা ভাবছে। তার অতীত মানেই জ্যোৎস্না। তার স্ত্রী না, তার ভালোবাসা।

সনাতনের বিয়ে হয়েছিল অনেক অল্প বয়সে। মঞ্জু, চাকদার মেয়ে। দাদাদের কাছে মানুষ, মা-বাবা ছিল না। মঞ্জুর সঙ্গে সংসার করেছে, দুটো ছেলেকে বড় করেছে, কিন্তু ভালোবাসা কি সনাতন অনুভব করেনি। মঞ্জুকে ছাড়া তার চলত না। কিন্তু প্রথম জ্যোৎস্নাকে দেখে তার মনে হয়েছিল, একে ছাড়া সে বাঁচবে না। কিন্তু জ্যোৎস্নার বয়েস? তার থেকে ঠিক অর্ধেক, মানে সে যখন মিলে কাজে এলো তখন তার বয়েস কুড়ি, সনাতনের একচল্লিশ। কিন্তু সনাতন পাগল হল। ভিতরে ভিতরে পুড়তে লাগল। সব সুখ জ্বলে পুড়ে খাক হতে শুরু করল। জ্যোৎস্না ফাইল নিয়ে এলে তার বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ত, জ্যোৎস্না হেসে কথা বলত যখন সনাতনের শ্বাসকষ্ট হত, জ্যোৎস্না অফিসে না এলে কোনোদিন, কিছু না কিছু ছুতো করে সনাতন তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে যেত। বাড়ি যেত না। গঙ্গার ধারে বসে থাকত। লজ্জায়, গ্লানিতে নিজেকে নানা ভাবে তিরস্কার করত। নিজেকে আটকাতে না পেরে জ্যোৎস্নার বাড়ি যেত খোঁজ নিতে। জ্যোৎস্না তাকে ডাকত বৈরাগীকাকু বলে। সনাতনের বিঁধত। তবু মেনে নিত। এই তার ভবিতব্য।

সনাতনের মনে হতে শুরু করল, তার গোটা জীবন যেন নিলামে উঠেছে। একে একে সব দূরে চলে যাচ্ছে। মঞ্জু কিছু একটা আন্দাজ করেছে। আগে যেটুকু সম্পর্ক অন্তত শরীরের তাগিদে জন্মাত, মন সেটুকুও খেয়েছে। ছেলে দুটো বখে যাচ্ছে। পাড়াটা ভালো নয়। মঞ্জু বারবার সাবধান করছে। কিন্তু কাকে সাবধান করছে? সনাতন কি আগের মত আছে? তার মন, প্রাণ, বুদ্ধি, সুখ, শান্তি - সব নিলামে উঠে গেছে। সব দিয়ে সে পেতে চাইছে এক অসম্ভবকে - জ্যোৎস্নাকে।

ক্রমশ ব্যাপারটা চাপা থাকল না। কি করে কি করে অনেকে টের পেল। অল্প অল্প হাসাহাসি, ফিসফিস শুরু হল। সনাতন বুঝল। কিন্তু উপায় ভেবে পেলো না কিছু। এখনও জ্যোৎস্না ফাইল নিয়ে এলে তার এক অবস্থা হয়। জ্যোৎস্নার গায়ের গন্ধ নাকে গেলেই নেশা লাগে। মাথা বুক ধরে ঝিম লাগে। এ অভিশাপ। নিজেকে বোঝায়। কিন্তু কে বোঝায় আর কে বোঝে - সব গুলিয়ে যায়। যে বোঝায় আর যে বোঝে জ্যোৎস্না সামনে এসে দাঁড়ালে দু'জনেই এক হয়ে যায়। তখন সনাতনের সারা মাথা বুক জুড়ে নামে বিষ। ভালোবাসার বিষ।

সনাতন চুলে রঙ করা শুরু করল। আগে যে মানুষ এক সপ্তাহে এক সেট জামা-প্যান্টেই কাটিয়ে দিত, এখন তার একদিন অন্তর কাচা জামাপ্যান্ট লাগে। মঞ্জু বোঝে। কিছু কথা কানেও এসেছে এবারের বিশ্বকর্মা পুজোর সময়। মেয়েটাকে দেখেওছে। কপাল! এর বেশি কোনো ব্যাখ্যা বা যুক্তি তার বুদ্ধি খুঁজে পায়নি।

জ্যোৎস্নার জ্বর। দু'দিন এলো না। তৃতীয় দিনের দিন আর থাকা গেল না। সনাতন গেল। সকাল থেকে বৃষ্টি সেদিন। জ্যোৎস্না খাটে শুয়ে। ওর মা মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। বাবা নেই, অন্য মেয়ে নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে অনেকদিন। সনাতন ঢুকতেই ওর মা সসম্ভ্রমে উঠে গিয়ে, একটা চেয়ার কাছে দিয়ে বলল, আপনি বসুন ম্যানেজারবাবু, আমি চা বসাই।

সনাতন কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চেয়ারে বসল। ঘরময় জ্যোৎস্নার গায়ের গন্ধ। এইটুকু তো সুখ। শুধু এইটুকু। কি হয়, যদি সে সব ছেড়ে জ্যোৎস্নাকে নিয়ে থাকে? কর্তব্য তো করল এতদিন? কি পেল? সে যে বেঁচে আছে, তার বুকের মধ্যে যে এতখানি ভালোবাসার খাই জমে আছে, জ্যোৎস্না না এলে জানতে পারত?

জ্যোৎস্নার নাক, চোখ, ঠোঁট খুঁটিয়ে দেখছে সনাতন। হঠাৎ জ্যোৎস্নার মায়ের গলা শুনে সম্বিত ফিরল, কিন্তু লজ্জা পেলো না। বুঝল মনে মনে অনেকটা গেঁথে গেছে জ্যোৎস্না। সমাজ, সংসার, ধর্ম - সব অর্থহীন সেখানে।

জ্যোৎস্নার মা বলল, ম্যানেজারবাবু আপনি একটু বসুন, আমি একটু বাজারে যাব, দুধটা কেটে গেছে…

আগের সনাতন হলে বলত, না না, দরকার নেই, আপনি লাল চা-ই করুন।

তাই তো করে এসেছে সনাতন আজীবন - সব কিছুতেই মানিয়ে নেওয়া।

সনাতন হেসে বলল, আসুন আপনি, আমি আছি।

জ্যোৎস্নার মা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে বলল, একটু জ্বরটা দেখুন না, নেমেছে?

সনাতনের কানের পাশ দিয়ে হল্কা বেরিয়ে গেল। বুকটা চাপা পাথরের মত। শ্বাস দ্রুত হচ্ছে, বুঝতে পারছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে, কাঁপা হাতটা নিয়ে ঠেকালো জ্যোৎস্নার কপালে। শরীরের গর্জন শুনল। কি অসভ্য সে। ছিঃ! এই প্রথম ছুঁলো সে তাকে।

বলল, একটু গরম আছে।

আসলে সনাতন জানে না, সে বোঝেইনি গরম না ঠাণ্ডা জ্যোৎস্নার শরীর। সে তাকে আবার ছুঁতে চায়। বারবার ছুঁতে চায়। মন হিসাব করে ফেলেছে এরই মধ্যে। জলপট্টি দিলে বারবার ছোঁয়া যাবে। তাই সে ভাবার আগেই বলে দিল, গরম আছে।

আপনি একটু জলপট্টিটা দিয়ে দেবেন?… আমি ঘুরে আসি তবে…  একটু আটাও আনতে হবে…

সনাতন জলপট্টি দিচ্ছে। তার মাথার মধ্যে কুয়াশা জমছে। কান থেকে গরম ভাপ বেরোচ্ছে। এখনই যদি সে না চলে যায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। কিন্তু তাকে পাপে পেয়েছে। না পাপে না, সত্যিতে পেয়েছে। খাঁটি অনুভব, খাঁটি সাচ্চা তাগিদ এই তো প্রথম জন্মাচ্ছে তার। সে জ্যোৎস্নাকে ছাড়া বাঁচবে না। সে শুধু তার। হোক বয়সের পার্থক্য, ওরকম আজকাল বেশি না হলেও একেবারে হয় না তা তো না…

সনাতন হঠাৎ উঠে গিয়ে জ্যোৎস্নাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরল। জ্যোৎস্না চোখ মেলে তাকালো। যে মেয়ে এতক্ষণ জ্বরের ঘোরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল… তার চাহনি এত স্পষ্ট হয় কি করে!… কিন্তু এসব ভাবার সময় তো নয় এখন… জ্যোৎস্নার ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁটদুটো শক্ত করে চেপে ধরে কামড়ে ধরল। জ্যোৎস্না ধীরে বলল, আস্তে… রক্ত বেরিয়ে যাবে তো…

সনাতন মুখটা তুলে নিয়ে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি চাও?... চাও আমায়?...

জ্যোৎস্না পিঠটা উঁচু করে ব্লাউজের হুকগুলো খুলে ফেলল।

সনাতন হারিয়ে গেল।

 

====== ========= =======

 

সনাতন বোঝে কোথাও একটা মস্ত ফাঁকি আছে। কিন্তু কোথায় ফাঁকি সেটা ধরতে পারে না। জ্যোৎস্না কখনও ধরা দেয়, কখনও দেয় না। জ্যোৎস্নার মায়েরও সম্মতি আছে বোঝে, কিন্তু কেন সেটা বোঝে না। ইতিমধ্যে সনাতনের চাকরিতে উন্নতি হয়েছে। জ্যোৎস্নাকেও এখানে সেখানে বলে ডেস্কের কাজে কাছাকাছি আনিয়ে নিয়েছে সনাতন। বাইরের নিন্দা-তামাশায় লজ্জা লাগে না সনাতনের। কিন্তু কোথাও যেন একটা ফাঁকি আছে কিছু। সেটা ভিতরের। তার আর জ্যোৎস্নার সম্পর্কের ভিতরে। জ্যোৎস্না সবটুকু দেয় না তাকে। তাদের মিলনের পর নিজেকে ভীষণ শুষ্ক লাগে সনাতনের। মিলনের পর মনে হয় জ্যোৎস্নাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু যেতে পারে না। মঞ্জুকে নিয়ে দুই ছেলে চলে গেছে রাণাঘাটে। সেখানে হাস্পাতালে বড় ছেলে কাজ পেয়েছে কিছু। বড় শালাই করে দিয়েছে। তারা কেউ সম্পর্ক রাখে না এখন। রাখার কথাও নয়। সনাতন তাদের দোষ দেয় না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে জ্যোৎস্না তার কাছে ধোঁয়াশার মত হয়ে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার মোহে জ্যোৎস্নাকে মানুষ হিসাবে দেখার সুযোগই পায়নি সনাতন সে সেটা বোঝে। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

মোহ'র আদি অন্ত খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছে সনাতন। পায়নি। এই কি ভবিতব্য তার? কিছুতেই কি নিজেকে এর থেকে বাঁচাতে পারত না সে? পারত না। কোনো চেষ্টার ত্রুটি তো করেনি। আসলে যে রোগ ভিতরের, তাকে বাইরের চেষ্টায় চেপে রাখা যায়, নির্মূল করা যায় কি? তাই যদি হত তবে এত উপদেশ, এত দেবালয়, এত প্রার্থনা - এ সবকিছুকে ব্যর্থ করে মানুষ একই ভুল বারবার করে যায় কি করে? কিন্তু সত্যিই কি এটা ভুল? নাকি মানুষ নিজের জীবনকে যেভাবে একটা ছন্দে বাঁধতে চেষ্টা করে ভাবে, সে বেশ আছে, সেটা ভুল? যার জীবনে এমন ঝড় ওঠেনি তার পক্ষে সে নিয়মের মধ্যে বাঁচা সহজ, কিন্তু যে এই ঝড়ের মধ্যে এসে পড়েছে, সে? যে ঈশ্বর অন্তর্যামী, তিনিই যদি জগতের বিধাতা হন, তবে তিনি কি জানেন না যে এই ঘূর্ণী কে উঠিয়েছে আর কার নৌকা সে ঝড়ে ডুবেছে? এক উপায়ে বেঁচে যেত সনাতন, যদি সে ভীতু হত। নিজেকে অস্বীকার করে সমাজের নিয়মকে অন্ধের মত মেনে সুখী হত। কিন্তু সনাতনের ধাত তো সেটা নয়। তবে?

জ্যোৎস্না যত তাকে শুষ্ক করে দেয়, সনাতনের জ্যোৎস্নার উপর ভালোবাসা তত তীব্র হয়ে ওঠে। সনাতন বোঝে জ্যোৎস্না ভালোবাসতে জানে না। জ্যোৎস্না হয় তো নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সে মানেই জানে না, ভালোবাসার। কিন্তু জ্যোৎস্নাকে ছাড়া তার দিনদুনিয়া শূন্য। সে বোঝে যে সে ভিতর থেকে শুকিয়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে, সে খাদের দিকে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু কে কাকে ঠেকাবে?

ঠেকালো জ্যোৎস্নাই। প্রত্যক্ষভাবে না, পরোক্ষভাবে। সনাতনের টের পেলো, জ্যোৎস্নার জীবনে সে এক বিশেষ স্থানে থাকলেও, আরো কেউ কেউ তার জীবনে আছে। আলোয় আঁধারিতে জ্যোৎস্নার জীবনে এমন অনেক গলি ঢেকে আছে যে সে রাস্তায় হাঁটতে সনাতনের রুচিতে বাধল।

সনাতন যেন এরকম একটা কিছুর জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তার রাগ, অভিমান কিচ্ছু হল না। সে যেন কোথাও একটা বড় মিথ্যার হাত থেকে মুক্তি পেলো। হাওড়া স্টেশানে বসে বসে তার মনে হচ্ছিল তার জীবন যেন একটা মিথ্যার জাল থেকে আরেকটা মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়া শুধু। এই যে সব ছেড়ে সে তীর্থে বেরিয়ে পড়েছে, এও মিথ্যা। সনাতন আস্তিক বা নাস্তিক কিছুই না। কারণ ঈশ্বরকে নিয়ে কোনো ভাবনাই সে ভাবেনি কোনোদিন। আজও যে ঈশ্বরের জন্যেই সব ছেড়ে বেরিয়েছে তা নয়। কেন বেরিয়েছে সে ধারণাটা স্পষ্ট নয়, তবে তার মনে হয়েছে গোটা সংসারটাই যখন মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে চলছে, তখন ঈশ্বর মিথ্যা হলেও তার এমন কিছু আঘাত লাগবে না।

সনাতনের দশ-বারো বছরের তীর্থযাত্রার বিবরণ দিয়ে লেখা বড় করার কোনো মানে হয় না। সনাতন এতগুলো বছর তীর্থে তীর্থে কাটিয়ে উপলব্ধি করেছে, তার জীবনে যা যা ঘটেছে তার একরত্তিও এদিক ওদিক হওয়ার ছিল না। এই যে লোকে বলে, এটা হলে ওটা হত, এ সব ক্ষোভ আসলে বিলাসিতা। মানুষের বুদ্ধি, বিবেক, মোহ আর সময় তাকে এমন এমন দিকে নিয়ে যায়, সে আসলে অসহায়ের মত ভাবে আমি নিজে যাচ্ছি, আমি নিজে যাচ্ছি। এ ফাঁকি, কিন্তু সংসারে ওটুকু ফাঁকিতেই তার সুখ। সে বোঝে না যে আসলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষ এক মোহ থেকে আরেক মোহে গিয়ে পড়ে। তার শরীর, মন, বুদ্ধি - সব মোহের বাসা। বিন্দু বিন্দু মোহ জন্মাচ্ছে। সেই নেশাতেই সংসার গড়িয়ে চলছে। কিচ্ছু চলছে না। সব ঘুরছে, এক মহাকালকে ঘিরে ঘিরে। কিন্তু কেন্দ্রে কে? কেউ জানে না।

সনাতন আবার তার পুরোনো বাড়িতে ফিরে এসেছে। মঞ্জু মারা গেছে। দুই ছেলে কোথায় সে জানে না। তার যে ক'জন এদিক ওদিক আত্মীয় ছিল, তারা সবাই মারা গেছে। সে ফিরে আসার পর নিজে থেকে জ্যোৎস্নার খোঁজ না নিলেও, লোকে দিয়ে গেছে। তার মা-ও মারা গেছে। সে কোথায় গেছে কেউ জানে না। কেউ বলে বিহারে, কেউ বলে উত্তর প্রদেশে। একজন হিন্দীভাষী কারোর সঙ্গে নাকি চলে গেছে।

হায় রে, তবু সনাতনের বুক টাটিয়েছে। ভালোবাসা যেন বটের বীজ। একটা ফেঁকড়ি থেকেই যাবে। তবে সে যন্ত্রণা থেমে গেছে, বা তার বুকের কোনো খাঁজে মিলিয়ে আছে হয় তো। তবে মাথা চাড়া দেয় না। আর দিলেই বা কি? সয়ে যাবে। এখন সব সয়।

অনেক রাত হল। সনাতন ফিরছে। কাশির দমকটা থেকে থেকেই হয়। শ্বাস আটকে যায় প্রায়। একটু দাঁড়ালো। শ্বাস নিল। আবার হাঁটতে শুরু করল। জ্বরটা বাড়ছে। শীত করছে। মাথাটা ভার লাগছে।

ভাড়াবাড়িতে থাকে সনাতন। ঘরের তালাটা খুলছে, এমন সময় বাড়িওয়ালার ছোটো ছেলে এসে বলল, ওহ্, আপনি এসে গেছেন, একজন মহিলা এসেছিলেন খানিক আগে, আপনাকে খুঁজছিলেন। এই নাম্বারটা রেখে গেছেন, উনি ক'দিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন বললেন, জ্যোৎস্না শর্মা…

শর্মা? আগের টাইটেল কি ছিল?

জ্বরের ঘোরে মাথাটা ভার হয়ে যাচ্ছে। কোনোরকমে ঘরে ঢুকে খাটে শুয়ে পড়ল সনাতন। মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনটা আবার বিষিয়ে যাচ্ছে। বিষের মধ্যে দবদব করছে একটা উত্তেজনা। এ উত্তেজনা চেনে সনাতন। হাতের মুঠোয় ধরা ফোন নাম্বারের চিরকুটটা। গলার কাছে কফ দলা পাকিয়ে আসছে। দরজার কাছে কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়ালো। কারোকে একটা ফোন করা দরকার। দু'দিন আগে শ্বশুরবাড়ির একজন একটা নাম্বার দিয়ে বলেছে, সেটা নাকি তার বড়ছেলের, সে নাকি কাঁচরাপাড়ায় আছে। কাকে ফোন করবে? মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। চোখের সামনে গোল গোল অন্ধকার। কার যেন গায়ের গন্ধ, কোন বাচ্চার হাসির শব্দ, কার যেন রুটি বেলার সময়ের চুড়ির আওয়াজ, কার যেন হাত কপালের উপর, কে যেন ডাকছে খেয়ে যেতে…

সনাতন সাড়া দিতে চাইছে… কিন্তু জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে… জিভের উপর বসে মহাকালের ঘট… চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে…অমৃত… বিষের স্রোতে…