Skip to main content

পুজোর মন্ত্র কি?

কান্না।

কান্নার উৎস কি?

ভালোবাসা।

ভালোবাসার উৎস কি?

ভালোবাসাহীনতার বোধ।

শুষ্ক হয়ে আছি। ভালোবাসাহীন হয়ে আছি। কান্না নেই। আনন্দ নেই। বড় ভার গোঁসাই। বড় ভার।

গোঁসাই বলল, ভালোবাসা মানে কি বোঝো?

বললাম, বুঝি না গোঁসাই, তবে মনে হয় হঠাৎ আসা শীতল হাওয়া। হঠাৎ আসে। হঠাৎ যায়।

গোঁসাই বলল, হাওয়া না গো। জল। দরদ বোঝো? ভালোবাসা মানে শীতল জল। দরদ। যত ডুববে তত শান্তি। এ জলে ডুবলে মানুষ মরে না। অমর হয়।

বললাম, আজ জন্মাষ্টমী, তুমি আশ্রমে ফিরবে না?

গোঁসাই বলল, অনুষ্ঠান? ও আমার জন্য আটকাবে না রে। কিন্তু আমাদের রান্না করে যে মালতী, ওর জ্বর, ওর ছেলেটার জ্বর, ডাক্তারকে নিয়ে ওদের বাড়ি যাব। রাতে ওখানেই গোপালের জন্য রাঁধব, ভোগ দেব, কাল ঠিক থাকলে ফিরে আসব।

তোমার জায়গায় আর কাউকে পাঠালেও তো হত গোঁসাই।

গোঁসাই হাসল। বলল, সে হত, কিন্তু কি জানিস অত ভিড়ের মধ্যে মন বসবে না। সবাই আসবে অথচ আমার মন পড়ে থাকবে এখানে, সে কেমন মিথ্যাচার হবে না….. চল…. ওই সামনের বাড়ি।

গোঁসাই আমায় ওদের বাড়ির দরজায় ছেড়ে নিজে ডাক্তার আনতে চলে গেল।

=====

মা-ছেলে দু’জনেই বিছানায়। ছেলেটার বয়েস সাত-আট বছর হবে। মালতী জলপট্টি দিচ্ছে শুয়ে শুয়েই। আমাকে দেখেই উঠতে গেল। আমি বললাম, আপনি বিশ্রাম নিন, আমি দেখছি।

মালতী আশ্রমে রান্না করে। আমায় চেনে। আমিই চিনি না ঠিক করে। আমায় না চিনলে আমায় দেখে এই জ্বর শরীরেও উঠতে যায়? জানে আমার স্বভাবে শহুরে শিক্ষাদীক্ষার অহংকার আছে। না মান দিলে মুখে না বললেও, মনে মনে ক্ষুণ্ণ হতাম।

আমি জলপট্টি দিচ্ছি, মিনিট দশেক পর ডাক্তারকে নিয়ে গোঁসাই ঢুকল। ডাক্তার দুজনকে বেশ কিছুক্ষণ দেখল। বলল, গোঁসাই কাল একটা রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে মনে হচ্ছে, যা ডেঙ্গু হচ্ছে এ বছর।

গোঁসাই বলল, বেশ, তুমি লোক পাঠিয়ে দিও।

ডাক্তার ওষুধ লিখে বসল আমাদের সামনে এসে। আমি আর গোঁসাই মাটিতে মাদুরে বসে। মা আর ছেলে চৌকিতে শুয়ে। ঘরে একটা সিএফএল বাল্ব জ্বলছে।

গোঁসাই আমায় বলল, চা করো দেখি। ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা একটু চা মুড়ি খা…. কি ডাক্তার, খেতে পারবে তো?

ডাক্তার বলল, রুগী ডাক্তার সবাই পারবে……

======

চা হল। মালতী উঠে বসে, ছেলেটাকে কোলে ঠেস দিয়ে বসিয়ে চা আর মুড়ি খাওয়াচ্ছে। নিজেও খাচ্ছে।

গোঁসাই বলল, জোর করে খা রে…. রাতে কি খাবি?

মালতী বলল, ডালেচালে বসাবে গোঁসাই?

ডাক্তার বলল, ডাক্তারও সেবা পায় তবে…. হবে নাকি?

গোঁসাই বলল, বড় নোলা হে তোমার….

মালতী বলল, ইস, কি যে বলো না গোঁসাই…. না না আপনি গরীবের বাড়ি….

ডাক্তার বলল, ওসব মন্ত্র পড়লে চলে যাব কিন্তু… আর আমি থাকছি এ পাগলের সঙ্গ করব বলে… নইলে এমন গোঁসাই কোথায় পাব বলো… জন্মাষ্টমীর দিন রাতে আশ্রম ছেড়ে রাঁধুনির কাজ করে….

মালতীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বলল, ছি ছি গোঁসাই…. একি পাপ করালে আমায় দিয়ে গো…. দোহাই ঠাকুর, তুমি আশ্রমে যাও.. আজ জন্মাষ্টমী… আমার একদম মনে ছিল না… তাই তো দিদির বাড়িতেও তো পুজো… আমি আজকের রাতটা কাটিয়ে নেব।

কারেন্ট গেল। বাইরে বৃষ্টি নামল।

আমি মোবাইলের টর্চ জ্বাললাম। গোঁসাই হ্যারিকেন ধরাতে ধরাতে বলল, বাজে বকিসনি তো…. আজ জন্মাষ্টমী বলেই তো সে বলল, আজ আমি বড় ব্যস্ত থাকব গোঁসাই, তুমি আজ বরং ছুটি নাও… যেখানে দরকার সেখানে যাও….. তাই তো এলাম…..

মালতী দেওয়ালে হেলান দিয়ে, ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, কথায় তোমার সঙ্গে কি আর পারি গোঁসাই!….

মালতীর গলা বুজে এলো। ডাক্তার বলল, না গো এই ভালো…. তোমার গোপালেই পুজো দিক….

মালতী দেওয়ালের ঠেস থেকে সরে এসে বলল, আমার তো গোপাল নেই ডাক্তারবাবু…

ডাক্তার বলল, তবে?

মালতী কিছু বলার আগেই ছেলেটা বলল, মা হিসি পাচ্ছে…..

গোঁসাই আমায় বলল, ছাতাটা নিয়ে বাইরে ওকে হিসি করিয়ে নিয়ে এসো….

======

খিচুড়ি রাঁধা হল। গোঁসাই একটা ছোটো প্লেটে একটু খিচুড়ি আর দুটো আলুভাজা সাজিয়ে ছেলেটার মাথার কাছে গিয়ে বসল। বলল, ওঠ বাবা… খেয়ে নে… তারপর ওষুধ আছে না ডাক্তার?

ডাক্তার বলল, হ্যাঁ গোঁসাই। আমার ব্যাগে আছে।

গোঁসাই বলল, তুই মা খেয়ে নে….

মালতী বলল, তা হয় না গোঁসাই… আগে তোমরা খাও….

ডাক্তার বলল, সেই ভালো… আমরা একসঙ্গে বসে যাব গোঁসাই…. ওকি আমাদের আগে খেতে পারে নাকি…. ও তুমি বুঝবে না।

======

মালতী অল্প একটু খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল। বৃষ্টি থেমেছে। আমি আর গোঁসাই ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আবার মালতীর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।

গোঁসাই বলল, এসো, এদিকটায় বসি….

চণ্ডীমণ্ডপ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয় হল, যদি সাপটাপ থাকে।

গোঁসাই পা ছড়িয়ে বসল। আমিও বসলাম পাশে। দু’জনেই চুপ। অথচ মনে হচ্ছে বুকটা কত কথায় ভরে আছে। গোছানো কথায় ভরে। তাই এত আনন্দ। বিরোধী কথায় ভরে থাকলেই অশান্তি… রাজ্যের অশান্তি।

কি শান্তি চারদিকে। মেঘ কেটে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। তারা উঠেছে।

গোঁসাই গাইছে। বিদ্যাপতি পদ। ভরা বাদর। মাহ ভাদর। সুর রবীন্দ্রনাথের না। অন্য সুর। গোঁসাই চারবার গাইল, শূন্য মন্দির মোর…. তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই তো বলছিলে না? সব শূন্য… শুষ্ক? দেখো বিদ্যাপতিও গাইছে… শূন্যতাকে ভয় কিসের গো…. শূন্যতার এক অহংকার আছে…. সে নেশা না ধরলেই হল….

বুঝলাম না গোঁসাই…..

শূন্যতার অভিমান…. সে ভালো না। শূন্য হবে যখন গোটাগুটি হবে। দরদ আসবে আবার। কিন্তু শূন্যতাকে নিয়ে অভিমান কোরো না। সহ্য করবে, কিন্তু অভিমানী সিদ্ধান্ত নেবে না। দেখবে আবার সব ঠিক হবে।

এভাবে ভাবিনি গোঁসাই আগে… ঠিক… প্রাণ শূন্য হলে অভিমান জন্মায়….

ওইতেই ক্ষতি হয়….

========

গোঁসাই পরেরদিন বিকেলে চলে এসেছে আশ্রমে। মালতীর এক দিদি যে বাড়ির গোপাল পুজোর জন্য আসতে পারছিল না সে চলে এসেছে।

আশ্রমে অনেকে অভিমান করে বলল, এমন উৎসবের দিন আপনার না থাকা ঠিক হয়নি…. কত দূর দূর থেকে ভক্তেরা এলো….

গোঁসাই হাসল। বলল, আমায় দেখতে, না গোপালকে দেখতে এসেছিল রে?

তারা বলল, ছল কোরো না গোঁসাই…. উত্তরটা তুমিও জানো…..

গোঁসাই বলল, শূন্যতার অভিমান ভালো না রে…. বরং বিনম্র অপেক্ষা ভালো…. তারা অপেক্ষা করেনি….

তাদের কাজ ছিল…..

গোঁসাই বলল, আমারও তো তাই ছিল রে….. কাজ…. গোপালের সেবা।