ধুধু মাঠ। একটা অশ্বত্থ গাছের নীচে হেলান দিয়ে বসে আছি। চারদিকে তাকানো যাচ্ছে না, এত রোদ। এগারোটা বারোটা হবে হয় তো। আজ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন, হ্যাঁ, মানে নববর্ষ, ১৪২৮। বৈশাখ মানে তো, হে নূতন, দেখা দিক আর-বার... আর বুদ্ধ। বুদ্ধের জন্ম ঠিক বৈশাখে না হলেও, এই গরমকাল এলেই মনে হয় সেই বিকালে গোল চাঁদ - বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ।
সারা পৃথিবী জুড়ে শ্মশান জ্বলছে। মানুষ পুড়ছে। একজনের কবর খুঁড়ে কবর দেওয়া হচ্ছে। বড্ড তাপ। এই রোদে বসে থাকা শরীরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে শ্মশানের তাপে। ভয়, আতঙ্ক রাতের ঘুম কেড়েছে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন মরীচিকা। মাথার মধ্যে অনবরত দরজা খোলা বন্ধের শব্দ। কে গেল?
প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে। মাঠে চাষ করছে যারা, ওদের গিয়ে বলা যায় না, শুভ নববর্ষ। ওরা লজ্জা পাবে। আমিও পাব। ওদের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলা রপ্ত হয়নি। মানে অভ্যাস হয়নি। মানুষ অভ্যাসের দাস, ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসাকে অভ্যাস করবে বলে মানুষ পাখি কিনে খাঁচায় পোষে।
সকাল থেকে কাউকে বলা হয়নি শুভ নববর্ষ। দুটো বাংলা আর একটা ইংরেজি কাগজ পাশে, মাটিতে ঢিল চাপা দিয়ে রাখা। ওখানে মৃতের সংখ্যার হিসাব আছে। আক্রান্তের সংখ্যার হিসাব আছে। বিজ্ঞজনের মত আছে। সেলিব্রিটিরা নববর্ষের কি খায়, কি পরে, এসব নিয়ে গবেষণা আছে। আর আছে ভোটের খবর। শীতলকুচি।
এই সব মাথায় নিয়ে শুভ নববর্ষ বলা হল না কাউকে। আমার পাশে এসে শুয়েছে একটা ঘেয়ো কুকুর, আর অনবরত মাটি খুঁটে খাচ্ছে একটা মুরগি। আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু অশ্বত্থ পাতা। কিছু হলুদ, কিছু সবুজ। অশ্বত্থ পাতা দেখলে আমার বুদ্ধের কথা মনে হয়। বুদ্ধ যেন অশ্বত্থের পাতা। ওই যে সরু শিখার মত অংশটা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে, ওই শিখাটা ধরে যেন বুদ্ধ এগিয়ে গিয়েছেন। আমাদের বলেছেন, "এগিয়ে এসো। জগতে দুঃখ আছে। মৃত্যু আছে।"
আমি ঘেয়ো কুকুরটা আর মুরগিটাকে নিয়ে বোধিবৃক্ষের তলায় যেন বসে। এত মৃত্যু! এত ভয়ংকর জীবন হতে পারে!
বুদ্ধ উত্তর দিল না। ঘেয়ো কুকুরটা নিজের ঘাগুলো চাটতে চাটতে বলল, তোমরা জীবন মানে কি বোঝো? মুরগিটা একটা অশ্বত্থ পাতার উপরে পড়া কিছু একটা দানা মুখে নিয়ে বলল, আজ আমার শেষদিন। রাতে কাটা হবে। আমাদেরও মড়ক লাগে। তোমরা মাটিতে পুঁতে দাও, আগুনে জ্বালিয়ে দাও, দাম কমিয়ে বাজারে নিয়ে বসো। এবার তোমাদের পালা….
এতক্ষণ ভাবছিলাম বুদ্ধকে শুভ নববর্ষ বলব। কিন্তু বুদ্ধের মুখটা এতক্ষণে অন্যরকম হয়ে গেছে। একটা ভাঙা চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে একজন বৃদ্ধ। ভিখারি।
"জল আছে?"
জল দাও আমায় জল দাও…. যেই মানব আমি সেই মানব তুমি….. বুদ্ধ না, রবীন্দ্রনাথ না, আমার সামনে এক বৃদ্ধ ভিখারি। আমার কাছে জল নেই।
নেই। ফাঁকা বোতল। ছিল। আমি জানতাম না তুমি আসবে। সম্পদ ভাগ করে নাও। আমার মনে ছিল না। আমার তৃষ্ণার চাইতে বড় সত্য কারোর তৃষ্ণাকে ভাবতে পারিনি। তাই শূন্য জলপাত্র।
বৃদ্ধ ভিখারি অন্যদিকে তাকিয়ে বসে। মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে। ওকে শুভ নববর্ষ বলা যায় না। ও জানেই না হয় তো আজ নববর্ষ। আবার আমার দিকে ফিরল, দুপুরে খাবে না?
আমি বললাম, আপনি খাবেন না?
বৃদ্ধ হাসল। পাশে রাখা ঝোলা থেকে একটা কৌটো বার করল। কৌটোর ঢাকা খুলে সামনে রাখল। ডাল। প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া কয়েকটা লুচি বার করল। আর ছোট্টো একটা কৌটে ভরা দু চামচ পায়েস।
এক গাল হেসে বলল, নাও, দুটো মুখে দাও। একবাড়ি থেকে সকালে দিল। ও বাড়ি গোবিন্দের সেবা। আমি মাসে একবার যাই। নাম করি। আজ আসতে বলেছিল। একটা কাপড়ও দিল।
ঝোলা থেকে বেরোলো একটা সাদা ধবধবে ধুতি। কি নতুন। কি বেমানান। কিন্তু ওটার লজ্জা ঘুচে যাবে। ধুলোয় ধুলোয় ও মলিন হবে। তখন বেমানান লাগবে না। লোকে আবার ভিক্ষা দেবে। ভিখারির কোনো জামা নতুন হয় না। হতে নেই। পাগলের হয়, আর ধনীর হয়।
কুকুরটা লেজ নাড়ছে। বৃদ্ধ ভিখারি একটা লুচির টুকরো ডালে চুবিয়ে ছুঁড়ে দিল। কুকুরটা চিবাতে চিবাতে আবার বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকিয়ে। পরের গ্রাস পাবে কি? অনিশ্চিত। খিদে মেটার আগেই গ্রাস ফুরিয়ে যাওয়া, ভিখারি জানে কেমন। ভিখারি ওকে আরেক টুকরো দিল।
বললাম, তোমার গোবিন্দ তো রাখাল ছিল, এই মাঠে এসে গরু চরিয়েছে?
বৃদ্ধ বলল, গোবিন্দ না, আমার নিমাই। এখন নিমাইয়ের যুগ। গোবিন্দ বলরাম, আমার নিমাই আর নিতাই। ... আমি জল নিয়ে আসি…
পুকুর থেকে জল ভরে আনতে গেল বৃদ্ধ, সাথে একটা বোতল। আমি খাবার পাহারা দিচ্ছি। কুকুরটা বসে। মুরগিটা নেই, কখন চলে গেছে। হল্কা বাতাসে সব পুড়ে যাবে মনে হচ্ছে।
বৃদ্ধ এসে বসল। বলল, খেয়ে নাও...
এক টুকরো লুচি নিলাম। ব্যস। আমার ভদ্রতার শিক্ষা। আন্তরিকতার অভাব মানুষ ভদ্রতার শিক্ষায় পুরিয়ে নিতে চায়। মানুষের ভীষণ জেদ। ঈশ্বর আর বিবেকের মধ্যে চিড় ধরিয়ে, সেই চিড়ে গুহা বানিয়ে, মানুষ ধর্মের অন্ধ চামচিকের বাসা মানায়। বিজ্ঞান আর বিবেকে বিরোধ নেই। চামচিকে আর আলোরই খালি বিরোধ। তাই এ বছরও কুম্ভস্নান থামল না। পরীক্ষা থেমে গেল।
বললাম, কুম্ভে যাওনি?
বৃদ্ধ বলল, পাপ ধুতে? আমার নেতাই আর পাপ একসাথে থাকে? ও ভ্রম। সবাই ভ্রমে ফিরছে।
বৃদ্ধ চলে গেল। এখন সে ভিখারি না। এখন সে মানুষ। যাকে শুভ নববর্ষ বলা যায় না। কিন্তু যার স্পর্শে সব শুভ হয়। কুকুরটা এখনও বসে। এবার আমার উঠতে হবে।
উঠতে যাব, হঠাৎ দেখি গাছের ফোকড় থেকে একটা লম্বা দাড়ি বুড়ো নেমে এলো। ছোট্টো মত তার সাইজ। নেমেই কয়েক পাক ঘুরে হাতের হুঁকোটার ফুঁকো দিয়ে আমায় দেখে বলল, চিনতে পারছ না?
কে বলল আমি চিনি না, বিলক্ষণ চিনি... এ তো উধো না বুধো... আরে কে যেন... মনে পড়ছে না... আরে সুকুমার রায়... হ য ব র ল…
হঠাৎ সে আমার পাশে এসে বলল, গল্প শুনবে? বলেই সে গল্প জুড়ে দিল…
এদিকে তো ভ্যাক্সিন নেই, ওদিকে ভ্যাক্সিন উৎসব শুরু হয়ে গেছে, ওদিকে আমেরিকার বিজ্ঞানী হাউমাউ করে বলে উঠেছে, ভ্যাক্সিন যদি করোনা মারবে তো রক্তে জট পাকায় কেন? তাই শুনে সবাই বলেছে তাই তো, জট পাকায় কেন? ওদিকে গুলির আওয়াজ শুনে সবাই জিজ্ঞাসা করল, কে চালালো, কেন চালালো? কেউ উত্তর দেয় না। সবাই বলল পরে বলব। তাই শুনে কেউ ছবি আঁকল। কেউ বলল, আবার গুলি চালাবে দুষ্টুমি করলেই। তারপর সবাই মিলে বলল, করোনা যদি হবে আরটি-পিসিআর এ ধরা পড়ে না কেন?
আমি গল্পের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে। বাড়ির দিকে হাঁটতে লেগেছি। দেখি আমার পিছনে গোটা অশ্বত্থ গাছের নীচ জুড়ে কত মানুষ। মায় রামমোহন থেকে মহাশ্বেতা, রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল, নিধুবাবু থেকে সলিল, দেবকী বসু থেকে মৃণাল, প্রমথেশ বড়ুয়া থেকে সৌমিত্র, কত কত মানুষ। সবাই হই-হট্টোগোলে কি মজায় মেতে। আমায় হাত নাড়িয়ে বলল, শুভ নববর্ষ। আবার আসিস। আমরা এখানেই থাকি।