আজ কিছু কথা মায়ের ব্যাপারে বলতে ইচ্ছা করছে। খুব অদ্ভুত মানুষ। উড়িষ্যার কালাহান্ডির খড়িয়ার নামের এক গ্রামে মায়ের জন্ম। দাদু ছিলেন সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। খুব নামডাক ছিল তাঁর। দাদুরা ছিলেন প্রবাসী বাঙালী। খুব রোগীবৎসল চিকিৎসক। গ্রামের অচ্ছুত, অশিক্ষিত, সব স্তরের মানুষের খুব কাছের লোক ডাক্তার শিবপদ চ্যাটার্জী।
মা পেলেন সেই গুণটি। যা তাঁর চরিত্রের মুল সুর হয়ে সারাজীবন বেজেছিল। সেই কথা বলব বলেই এই লেখা।
ছোটবেলা থেকে মা একটা খুব অদ্ভুত কথা শেখাতেন, "পর বলে কোনো কথা হয় না। ওটা তোমার মনের ক্ষুদ্রতার লক্ষণ।" জানি না এত বড় সাহস উনি কি করে পেয়েছিলেন, এই সত্যকে সারাজীবন অনুসরণ করার। ফলস্বরূপ দু:খ, বিশ্বাসঘাতকতাও পেয়েছিলেন জীবনভর। একজন এসে বলেছিলেন, "আপনি যে অমুককে এভাবে সাহায্য করেন, জানেন না সে ওগুলোর অসদ্ব্যবহার করে"।
মা বললেন, "তাতে কি। সেটা ওর রুচি। তবে ও আবার আসলে আমি ওকে আবার সাহায্য করব, এ আমার স্বভাব। তুমি ভেবো না।"
সে চলে যাওয়ার পর মা'কে দেখেছি কষ্ট পেতে। আবার সব ভুলে তাকেই আবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে শুধু না, তার দু:খে চোখের জলও ফেলতেও দেখেছি। অবাক হয়েছি।
দূর্গাপূজো। আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার বেশ অনেকগুলো জামা-প্যান্ট হয়েছে। একদিন দুপুরে মা আমাকে ওঁনার পাশে শুতে বললেন। তারপর বললেন, "তুমি ক-এর বাড়ি গিয়েছিলে কাল?"
"হ্যাঁ", বললাম। ক-ছিল প্রাইমারী স্কুলে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
"তুমি জান, ক-এর বাবার মিল বন্ধ?"
"হ্যাঁ", মা খুব দরকারি কথা বলবার সময় 'তুমি' করে বলতেন।
"ক-আর ওর বোনের এবারে পূজোয় একটা করে জামা হয়েছে, তুমি জান?"
আমি জানতাম না। মা আমার দিক ফিরে আমাকে জড়িয়ে আমার মুখের কাছে এসে বললেন, "আমার একটা কথা রাখবি?"
আমার মনে আছে মায়ের চোখের কোল জলে ভরছে দেখে আমি ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলাম, চুপ করে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
বললেন, "তুইও একটা জামা-ই ভাঙিস এবার। নাহলে ওর খুব কষ্ট হবে।"
মায়ের চোখের কোল বেয়ে জল বালিশে এসে পড়েছিল। আমি বলেছিলাম, "আচ্ছা" কিছুটা ভয়ে কিছুটা দু:খে। তবে কেমন একটা ভাললাগাও ছিল তার সাথে।
আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে মায়ের সাথে পরিচয় আরো গভীর হতে লাগল। বুঝতে শুরু করলাম তিনি একটু আলাদা, স্বতন্ত্র।
তিনি তাঁর এ স্বভাব থেকে চ্যুত হননি সারাজীবন। আরো সুবিধা হয়েছিল বাবার সাথে মায়ের আদর্শগত মিল। তাঁদের দু'জনের বোঝাপড়া ছিল অসাধারণ সুরে। কাজের লোকের স্বামীর সাইকেল, মেয়ের বিয়ের টাকা, জমি কেনার সাহায্য ইত্যাদির জন্য বাবার কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি সারাজীবন। তবে তিনি হাসতেন। বড়মামা, মাকে বলতেন 'মাদার টেরেসা'।
মায়ের জীবনের শেষ কয়েকদিনের ঘটনা বলে শেষ করি।
খুব অসুস্থ। শয্যাশায়ী। একদিন দেখি খুব কাঁদছেন। ভাবলাম শারীরিক কষ্ট বাড়ল বুঝি। কারণ শুনে আমি নির্বাক। আমাদের বাড়ির কাজের লোকের ঘর ভেঙে গেছে ঝড়ে (আয়লাতে)। কিন্ত মায়ের এত সামর্থ্য নেই যে তাঁর বাড়িটাকে আবার দাঁড় করিয়ে দেন। আমি ভাবছিলাম এই শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও কি করে পারছেন ভাবতে!
তাঁকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করা গেল সে যাত্রায়।
শেষের দিকে যখন প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি করতে হত তখনকার একটা ঘটনা বলি।
আমি সকালের খাবার নিয়ে গেছি। মা বললেন- "বাবু একটা 'উইমেন হরলিক্স' নিয়ে আসিস তো ওবেলা।"
ভাবলাম ডাক্তার মায়ের জন্য হয়তো বলেছেন।
না, মায়ের যিনি আয়া, তিনি সদ্য জ্বর থেকে উঠেছেন, তাঁর জন্য।
আমি যখন তাঁকে দিতে গেলাম তিনি হরলিক্সটা হাতে নিয়েই কেঁদে ফেললেন, বললেন, "বলেন তো কি মায়া বাড়ানো! আমরা তো জানি উনি আর কয়েকদিন আছেন। কি করে মানুষটার সেবা করি বলেন তো এমন ব্যবহার করলে, আমাদেরও তো মায়া মমতা বলে কিছু আছে। উনি এমন ব্যবহার করেন যে কি বলব...."
আমি সরে এসেছিলাম।
যেদিন চলে যাবেন তার আগের দিন থেকে মাঝে মাঝেই জ্ঞান হারাচ্ছেন আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে।
তাঁর মধ্যেও আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন হেসে, সে উল্টোদিকে চুলের সিঁতে করেছে কি না।
দুর থেকে যেই দেখা করতে গেছেন, বলছেন, "ভালো থাকিস"।
শুধু আমায় একবারই জানতে চেয়েছিলেন, "বাবু আমি কি মারা যাচ্ছি? আমার গলা শুকিয়ে আসছে কেন বারাবার?"
আমি ICU থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, কোনরকমে "না" বলে। উনি অবশ্য আর এ প্রশ্ন করার সুযোগও পাননি।
সব শেষ হল। এত মানুষকে কাঁদালেন আর অভিভাবকহীন করে গেলেন যে আমার মাতৃশোক আর ব্যক্তিগত শোক রইল না।
আজ শুধু একটা কথাই মনে হয় মাঝেমাঝে, কি করে পারতেন?
(জানতাম না আজ মাতৃদিবস। মায়ের কিছু কথা কালই Sukanya দির সাথে হচ্ছিল। ভাবলাম সবার সাথে শেয়ার করি। তাই দিলাম)