Skip to main content

সংসারে সুতার্কিক দেখেছি, ধূর্ত মানুষ দেখেছি। তারা বুদ্ধিমান অবশ্যই। তবে মনের পরিধি ছেড়ে গহন গভীরে প্রবেশ করে, আত্মচেতনাকে স্নিগ্ধ করে, সংসারকে শান্তিনিকেতন করে গড়ে তুলতে খুব কম মানুষকে দেখেছি।
     আমার দিদা এই শেষোক্ত শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। তাঁর জন্ম উত্তর কলকাতায়। দাদু ছিলেন প্রবাসী বাঙালী, পেশায় সরকারি ডাক্তার। তাঁরা সংসার পাতলেন উড়িষ্যার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।
     কোনো অভিযোগ নেই। বিলাস ব্যসনের বাহুল্য নেই। থাকার মধ্যে রইল শিক্ষা, ধর্ম, শান্তি। সেই গ্রামে সন্ধ্যেতে তিনি গাইতেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত।  ছেলেমেয়েরা শুনত, শিখত, মর্মস্থ করত। তার সাথে চলত প্রথাগত শিক্ষা।
     শ্রীঅরবিন্দ এবং শ্রীমা হলেন তাঁর আলো, তাঁর ঈষ্ট। আমার জ্ঞানতঃ মামাবাড়ির প্রধান স্মৃতি ছিল সন্ধ্যেবেলা একসাথে প্রার্থনায় দাঁড়ানো। দিদা তাঁর আঁচলটা কাঁধের উপর দিয়ে পিঠ বেড়িয়ে সামনের দিকে নিয়ে, চোখ মুদে গাইতেন, সাথে আমরা... "চির সুন্দর শ্রী অরবিন্দ জয়...." আমাদের সবার পিছনে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে দাদু। আমি দাঁড়াতাম দিদার কোল ঘেঁষে। দিদার মধ্যে একটা অপার্থিব সৌন্দর্য ছিল। প্রার্থনার সময় খেয়াল করতুম তাঁর চোখ মুখ কেমন একটা দিব্য আভায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকত। সেরকম মুখ আজ অবধি আর একটাও চোখে পড়ল না।
     আমাদের নাতি-নাতনিদের সাথে তাঁর সম্পর্কটা ছিল ভারী অদ্ভুত। একদিকে তিনি আমাদের সব চাইতে আস্থাভাজন বন্ধু, আবার তিনিই বিপদে সংশয়ে আমাদের সব চাইতে নিশ্চিত উত্তরণের পথ। যত বড় হচ্ছিলাম তত তিনি দিদা থেকে আরো গভীর নির্ভরশীলতার জায়গা হয়ে উঠেছিলেন আমাদের। চিঠির পর চিঠি লিখতাম। উত্তর আসত গোটা গোটা মুক্তোর মত অক্ষরে।
     তাঁর গাওয়া গান, তাঁর আবৃত্তি, তাঁর চলাফেরা, গল্প বলা সব আমাদের কাছে পরম আশ্চর্যের ছিল। গর্বিত লাগত। কারণ আমার বন্ধুদের দিদাদের কাউকে এমন দেখিনি।
     একবার তিনি আর আমি খেতে বসেছি। তাঁর খাওয়া হয়ে গেছে, উঠে হাত ধুতে যাচ্ছেন, আমায় বললেন, "তুমি খাও দাদুভাই, আমি হস্ত প্রক্ষালন করে আসি।" বলে মুচকি হাসলেন। তিনি জানতেন আমার ওই বয়সে 'প্রক্ষালন' শব্দটা আমার অভিধান বহির্ভূত। আমি বিস্ময়ে বললাম, "মানে?"
      উনি বললেন, "অভিধান দেখে বলো আমায়।"
     সেই শুরু হল আমার অভিধান দেখার সূচনা।
    তখন আমি বারো ক্লাসে পড়ি। দিদা আমাদের বাড়ি এসেছেন, কাঁচরাপাড়ায়। আমি মোহরদির একটা ক্যাসেট চালিয়ে অঙ্ক করছি। উনি বললেন, "একটা কথা বলে রাখি দাদুভাই, জীবনে আর যা ছেড়ো, ছেড়ো, রবীন্দ্রনাথের হাত কখনো ছেড়ো না। অনেক দুর্গম পথ সহজ হয়ে যাবে দেখো।"
     আজ এ কথাটা সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে স্বীকার করি, সজল চোখে, নতমস্তকে।
     তিনি একটা ঘটনা বললেন। "আমি মা মারা যাওয়ার পর আমার বাপের বাড়ি গেছি শ্যামবাজারে। কি জানো দাদুভাই, মা চলে যাওয়ার পর অনেক কিছু বদলে যায় অনেক সময়। সব সম্পর্কগুলো আগের মত বাঁধনে থাকে না। আমার ভাইদের মধ্যেও সেরকম হয়েছিল।
     "একদিন ভোরবেলায় আমি আমাদের বারান্দায় বসে আছি। মনটা ভীষণ অবসন্ন। এমন সময় রবীন্দ্রনাথের একটা গান আমার সব কিছু ঠিক করে দিল জানো দাদুভাই।"
     বললুম, "কোন গানটা মনে আছে?"
     তিনি গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, 'এ পথে আমি যে গেছি বারবার ভুলিনি তো একদিনও / আজ কি ঘুচিল চিহ্ন তাহার উঠিল বনের তৃণ...'
     আমার চোখ ভিজেছিল একই সাথে একটা গভীর সুখে আর দুঃখে। দুঃখটা সাময়িক। কিন্তু সুখটা নিবিড় - এমন একটা আশ্রয় সংসারে আছে তা হলে, যা গোপন পথে এসেই হাত বাড়িয়ে যায়, ছুঁয়ে যায় আশ্বাসে... রবীন্দ্রনাথ।
     সেই রবীন্দ্রচর্চাই রইল এরপর থেকে আমার আর দিদার কথোপথন, চিঠিপত্রের প্রধান অংশ জুড়ে।
     তাঁকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না, একজন মানুষ সংসার আর সাধনাকে এমন পরম সামঞ্জস্যতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে চলতে পারে। আজ যাঁদের মুখে শুনি, সংসারে থেকে ওসব হয় না। শুনলে মনে হয় বলি, চাও না বলেই হয় না।
     একটা কথা মনে আসল এই প্রেক্ষিতে। আমার দাদুর অভ্যাস ছিল মাঝে মাঝে কোনো একটা সুগন্ধী ফুল মাথার বালিশের পাশে নিয়ে রাতে শোয়া। আর দিদা শুতেন চাবির গোছা বালিশের নীচে নিয়ে।
     আমি দিদাকে ঠাট্টা করে একদিন বললুম, "তোমার বরকে দেখো কেমন শৌখিন, কি সুন্দর একগুচ্ছ জুঁই মাথার কাছে নিয়ে শুচ্ছেন। আর তুমি নিলে চাবি, কি বেরসিক গো!"
     দিদা হাসলেন। বললে, "তা দাদুভাই, আমি মাথার কাছে চাবির গোছা রাখছি বলেই যে না তোমার দাদুর মাথার কাছে জুঁই থাকছে।"
     সত্যিই তাই। চিরটাকাল তাই হয়েছে। শুনলে অতিরঞ্জিত লাগলেও এটাই সত্যিই, আমার দাদু সে ভার সম্পূর্ণ দিদার হাতেই সঁপেছিলেন শুধু না, বোধহয় নিজেকেও সম্পূর্ণ সঁপেছিলেন বলেই, দিদা চলে যাওয়ার পর ছ'মাস শুধু ওনার শরীরটাই ছিল।
     এ কথার ইতি টানি একটা কথা দিয়ে। একবার আমার ব্যক্তিগত জীবনে একটা খুব দুঃসময় আসে। অনেকগুলো ব্যর্থতা যেন চক্রবুহ্য রচনা করে আমায় ঘিরে। দিদা চিঠি লেখেন আমায়...
     'দাদুভাই সবার জীবনের ছন্দ সব সময় সমান যায় না। তাতে উত্থান পতন আসেই আসে। ছন্দের গতি দ্রুত হয় কখনো, আবার কখনো মন্থর। তুমি শুধু দেখো যেন তাল না কাটে। আর একটা কথা সারা জীবন মনে রেখো, নিজের জীবনের ছন্দের সাথে অন্যের জীবনের ছন্দের কখনো তুলনা করবে না। তাতে অনর্থক ক্ষুব্ধই হয় মন। ভালো থেকো। পরমেশ্বরে বিশ্বাস রেখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।'

     আমি পরমাত্মারূপী সূর্যের দিকে তাকাইনি যদিও, তবু তাঁর প্রতিবিম্ব চলতে ফিরতে বেশ কিছু শুদ্ধ চেতনার শিশিরবিন্দুতে দেখেছি। ধন্য হয়েছি। পবিত্র হয়েছি।