Skip to main content

আমি যখন মাসির বাড়ি পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার আশেপাশে হবে। মিনতিদি, মাসির মেয়েটার যিনি দেখাশোনা করেন, তিনি জানতেন আমি আসব, আগেই ফোন করে বলা ছিল। আমি ঢুকতেই বললেন, তুমি স্নান করে এসো, আমি ম্যাগী বানিয়ে রেখেছি, আজ দিদির ফিরতে দেরি হবে, অফিসে একটা কাজে আটকে গেছে।

       মাসির বাড়ি ডানলপে। বাড়িটা মেশোদের, অনেক পুরোনোই বলা চলে। মেশো পুণেতে আছেন, ব্যবসার কাজে। সামনের সপ্তাহে ফিরবেন। আমার রবিবার একটা চাকরির পরীক্ষা আছে, মাসির বাড়ির কাছেই সিট পড়েছে, তাই দুদিন আগেই চলে এলাম। মাসির কাছে ইংরাজিটা ঝালিয়েও নিলে হবে। মাসি ফুড করপোরেশানে বেশ বড় চাকরি করে। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, মায়ের মুখে শোনা। আমার কলেজ পাশের পর এই প্রথম সরকারি চাকরির পরীক্ষা।

       আমি স্নান করে বেরিয়ে দেখি মিনতিদি খাবার টেবিলে খাবার দিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, তাই মুন্নার ঘরে না গিয়ে আগেই খেতে বসে গেলাম। খেতে খেতেই টুকটাক মিনতিদির সাথে কথা শুরু হল। মাসি মিনতিদিকে বলেছে পরোটা করে রাখতে, মাসি চিকেন নিয়ে ঢুকবে একেবারে বাইরে থেকে। মিনতিদি পরোটা করতে করতে কথা বলছে।

       মুন্নার শরীরটা ভালো নেই জানো তো...

       আমি হোয়াটস অ্যাপে আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে একটা জোক্স পড়ছিলাম, মুন্নার কথাটা শুনে মোবাইল থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে?

       মিনতিদি যা বলল তা হল মুন্না নাকি মাস তিনেক হল কথা বলছে না ঠিকঠাক। স্কুল থেকেও মাসিকে ডেকে বলেছে। মুন্নার বয়েস পাঁচ বছর হল গত নভেম্বরে, এটা আগস্ট। একজন ডাক্তার দেখছেন, উনি কিছু টেস্ট করিয়েছেন, কিছু ধরা পড়েনি। মাসি নাকি একজন চাইল্ড সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবে ঠিক করেছে। সোমবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আজ শুক্রবার।

       আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ও কি করছে এখন?

       মিনতিদি বলল, ঘুমাচ্ছে।

       আমি মুখ ধুয়ে মুন্নার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ মিনতিদি বলল, তুমি একটু ওর খেয়াল রাখবে? মায়ের খুব জ্বর দেখে এসেছি সকালে, আমি তালে তাড়াতাড়ি যেতাম।

       মিনতিদি চলে গেল। আমি একবার দেখে এসেছি মুন্না ঘুমাচ্ছে। মুন্না আমার কাছে বরাবরই ভালো থাকে। আমি সিরিয়াস কিছু ভাবলাম না। বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছি ডাইনিং স্পেসে বসে, হঠাৎ মুন্নার ঘরের থেকে হাসির আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গেলাম।

       দেখি মুন্না খাটে বসে আছে। একটা হলুদ টিয়াপাখি আঁকা ফ্রক পরে আছে। সামনের কাঠের আলমারিটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। আলমারিটার একটা পাল্লা খোলা।

       আমার একটু অবাকই লাগল। মাসি বা মিনতিদি তো এতটা ক্যাজুয়াল না, তবে? আমি আলমারিটা বন্ধ করতে যেতেই মুন্নার হাসি থেমে গেল। কেমন উৎকণ্ঠা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর কিছু না বলে, বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল।

       আমি ওর পাশে গিয়ে শুলাম। ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই কার সাথে কথা বলছিলি বাবু?

       মুন্না হাতের আঙুলটা আলমারির দিকে দেখিয়ে বলল, দিদি...

       আমি ভাবলাম কোনো পুতুল আছে হয় তো আলমারিতে। উঠে গিয়ে আলমারিটা খুলে দেখলাম। কিচ্ছু নেই। শুধু মুন্নার জামাকাপড় আর একটা বড় ঘোড়া। কাপড়ের তৈরি, কাঠের না। আমি ওটাকে বার করে ফিরতেই দেখি মুন্না উঠে বসেছে, ওর চোখমুখ আদৌ স্বাভাবিক নয়। আমার একটা অস্বস্তি লাগল। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ও আমার দিকে তাকিয়ে নেই আসলে, ও অন্য কিছু দেখছে। বা অন্য কাউকে?

       আমার পিঠের ভিতর দিয়ে কিছু একটা নেমে গেল মনে হল, আমি বললাম, কি দেখছিস তুই?

       মুন্না কিছু না বলে শুয়ে পড়ল আবার। ঘোড়াটার দিকে ফিরেও তাকালো না।

       আমি ওর পাশে গিয়ে শুলাম আবার। ও আমার দিকে পিছন ফিরে শুয়ে। আমি জোর করে ওকে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম, কি হয়েছে তোর? ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় কলিংবেল বাজল। মাসি। আমি উঠে দরজা খুলতে যাব, দেখলাম আলমারিটার একটা পাল্লা আবার খোলা।

আমি মাসি মুখোমুখি খেতে বসেছি। মুন্না মেঝেতে একটা বড় ডাইনোসোর নিয়ে খেলছে। সবুজ রঙের ডাইনোসরটা। মুখটা হাসিহাসি। মুখের ভিতরে আবার ড্রাগনের মত জিভ লাল রঙের।

       মুন্নার আলমারিটার দরজাটা কি হয়েছে গো?

       মাসি বলল, মিনতিও বলেছিল। কেন বলতো? খুলে যাচ্ছে না খালি খালি?

       আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি দুবার...

       কথাটা বলতে বলতে আমি মুন্নার দিকে তাকিয়ে দেখি ও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

       মাসির সাথে কথা আর এগোলো না। মাসির মাইগ্রেনের ব্যথাটা বেড়েছে আজ। ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বে তাড়াতাড়ি।

       আমি যে ঘরে এসে থাকি এটা মাসি মুন্নার জন্য ভবিষ্যতে স্টাডিরুম ভেবে করে রেখেছে। খুব বড় না ঘরটা, একটা খাট আর দেওয়াল আলমারি ভর্তি বই। আমি মশারির মধ্যে ঢুকে আলো নিভিয়ে দিলাম। এত তাড়াতাড়ি আমি শুই না। কিন্তু আজ কি একটা যেন অস্বস্তি হচ্ছে। একটা মুভি ডাউনলোড করা আছে মোবাইলে। কানে হেডফোন গুঁজে সেটাই চালালাম।

       ট্‌ করে একটা আওয়াজ হল দরজার কাছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে এদিকে বুঝলাম। আমার মনে পড়ল আমি যখন স্নান করে এসে খেতে বসেছিলাম তখনই চার্জ পনেরোতে এসে ঠেকেছিল। ভেবেছিলাম মুন্নার সাথে খেলার সময় চার্জে বসিয়ে দেব...

       কেউ একটা যেন এগিয়ে আসছে আমার মশারির দিকে। আমার গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে, আমি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছি, কে? মাসি? কে? মুন্না?

       আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার মশারির বাইরে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে। কোনদিকে বেড সুইচ মনে পড়ছে না। আমার হাতটাও কেমন অসাড় হয়ে আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে?

       একটা স্পষ্ট গলায় উত্তর এল, পাপিয়া।

       আমি কিছু বলার আগেই দেখলাম আমার ঘরের জিরো পাওয়ারের নীল আলোটা জ্বলে গেল, আমার সামনে একটা সাদা ফ্রক পরা পনেরো ষোলো বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে। ছিপছিপে শরীর, গায়ের রঙ অস্বাভাবিক সাদা, ফ্রকটার রঙও সাদা। আমার দিকে স্থির তাকিয়ে, চোখের পলক বলতে কিছু নেই। আমি চমকে উঠে দেখি ওর পাশে দাঁড়িয়ে মুন্না।

       আমি ধড়মড় করে মশারির বাইরে এলাম। বললাম, কে তুমি?

       মেয়েটা মুন্নার হাত ছাড়িয়ে খাটে বসল। মুন্না ওর পাশে গিয়ে ঘেঁষে দাঁড়ালো।

       মেয়েটা বলল, আমার ধৈর্য ভীষণ কম, তুমি বারবার আলমারিটা খুলছিলে কেন? আমার আলো অসহ্য লাগে। আমি চাইলেই ওকে শেষ করে দিতে পারি? তুমি চাও সেটা?

       আমি কিছু বলতে পারছি না, আমার কি হচ্ছে আমি বুঝতেই পারছি না, আমি শুধু দেখছি আমি এত জোর কাঁপছি যে আমি দাঁড়াতেই পারছি না স্থির হয়ে। মুন্নার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি ওকে ছেড়ে দাও... তুমি যা চাও আমি তাই বলব মাসিকে... তুমি প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও...

       মেয়েটা আবার বলল, আমার ধৈর্য ভীষণ কম... মিনতির মা মারা গেছে একটু আগে... মিনতিকে আমি বারণ করেছিলাম ওই ঘরে না ঢুকতে এত... ও শোনেনি... আমি ওর মাকে...

       আমি কেঁদে ফেলে বললাম, তুমি কি চাও... বলো... আমি মাসিকে তাই করতে বলব...

       মেয়েটা উঠে এসে আমার মুখের সামনে দাঁড়ালো। কি ভয়ংকর পলকহীন দুজোড়া চোখ, অথচ কি অপূর্ব দেখতে... আমি স্থির দাঁড়িয়ে ওর সামনে... মুন্না এই প্রথম আমার হাত ধরল...

       মেয়েটা আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলল, আমার ধৈর্য ভীষণ কম... বললাম না...

 

       আমার ঘুম ভাঙল যখন সকাল নটা বেজে গেছে। আমি ঘুমালাম কখন? কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। মাথাটায় ভীষণ ব্যাথা। আমি উঠে রুমের বাইরে এসে দেখি, মাসি ডাইনিং রুমে বসে পেপার পড়ছে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসতেই বলল, একটা খারাপ খবর রে, মিনতির মা কাল রাতেই মারা গেছে।

       আমি বললাম, মুন্না কোথায়?

       মাসি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করল মনে হল, বলল, টিভিতে কার্টুন দেখছে, কেন রে?

       আমি মাসিকে সবটা বললাম। সবটা শুনতে শুনতে মাসির মুখটা বদলে গেল। চোখটা লাল হয়ে গেল। বলল, পাপিয়া, তোর মেসোর বোন। মাধ্যমিকের রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল। তাই বাড়িতে বকাবকি করা হয়েছিল বলে গলায় দড়ি দিয়েছিল। মাসি মোবাইল খুলে ওর ছবি দেখালো। বলল, এ-ই তো?

       আমি দেখলাম, ঝাপসা ছবি, তবে চিনতে অসুবিধা হল না। আমার মাথাটায় কেমন একটা চরকি খেলে গেল।

       আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি জানতে সব?

       মাসি বলল, হ্যাঁ। আমরা সামনের মাসে গড়িয়ায় একটা ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছি। এখানে ও কাউকে থাকতে দেবে না। আমি ভেবেছিলাম হয় তো সবটা ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু...

       আমি একবার বলতে গেলাম, মিনতিদির মা...

       মাসি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, কি?

 

       আমি বললাম, না কিছু না...