(লেখার দুই চরিত্র। আমি আর আমি। এরা একজন বিশুদ্ধ বাংলা বলে। আরেকজন বাঙাল আর কলকাতার ভাষা মিলিয়ে কথা বলে)
- তা বলি উপায় কিছু ভাবলে? বলি সবদিক দেখেশুনে তো আমার চিত্তির লাগার জোগাড়। আরে মন তোমায় বলছি, বলি কিছু বুঝলে? ওদিকে বেলা যে পড়ে এলো গা। এখনো ভ্যাবলার মত হাঁ করে, হাফ প্যান্ট পরা, নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে এমন ক্যাবলা কাত্তিকের মত ঘুরে বেড়াচ্ছো! বলি এর মধ্যে যদি চোখ উল্টিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করো, সেটা খুব একটা ভালো দেখাবে কি? নিয়ে গিয়ে না হয় ঘি-টি মাখিয়ে পুড়িয়ে এসে লোহাটোহা ছুঁয়ে লোকজন সব মোচ্ছব করবে, তোর তাতে কি হবে রে ব্যাটা? প্রথম কথা দেখ, তুই ব্যাটা আস্তিক কি নাস্তিক সেটাই বুঝলুম না এখনো।
- আর বুঝবেনই বা কি করে দাদা, বড় গোলমাল। এই ধরেন না কেন, আমাদের বেদ উপনিষদের কথা তো ছাড়ানই দেন, সে সব পড়ে একটা কিছু ঠিক করা আমাগো কম্ম না। তাতে বিস্তর হেঁয়ালি। এতসব কঠিন কথা যে মনে হয় যেন সাইকেলে চেপে থর মরুভূমি পার হতে এসেছি, যতই এগোতে যাই, ততই চাকা বসে যায় বালিতে, আর তার উপরে ধূলোঝড়ের ধাক্কা তো আছেই।
- ওরে মূখ্যু আমার, শাস্ত্রে তাই বলেছে গুরুকরণ করতে হয়।
- তা গুরু তেমন পাই কই? এ যে নানা মুনি নানা মতের বাহার। এই ধরেন কেন, আমাদের রামকৃষ্ণ ঠাকুর, কেমন সুন্দর মা কালী দর্শন করলেন। মনটা ভক্তিতে প্রায় জুড়োয় জুড়োয়, ওদিক থেকে বুদ্ধ এসে বললেন, হেঁ হেঁ বাপধন আমার, তোমার ওই কালীটি কে? আমি পড়লুম ফ্যাসাদে। তা যিনি নিজে দেখেছেন, তিনি থাকলে যে না হয় এর একটা গুছিয়ে জবাব দিতে পারতেন। আমি কোত্থেকে দেব বলুন? ওদিকে যীশু বলেন, তাঁর পিতা আছেন ওই দূরে উপরে, তিনি আসল দিনে সবার বিচার করবেন। আচ্ছা এমনধারা ভয় দেখানো কেন বলুন? কখন কোথায় কি করেছি, তাও আবার কার বিধানে সেটা পাপ আর কার বিধানে সেটা তুচ্ছ, তাই বা বুঝি কি করে? তিনি বললেন, ঈশ্বরের রাজ্য আমাদের অন্তরে। তা চার্চের ঠেলায় সে কথা শোনার জোগাড় আছে? তারা বলছে, যীশুর সাথে এইবেলা বনিবনা না করে নিয়ে ওদিকে গেলে পস্তাতে হবে। বুঝুন, কেমন বন্ধুত্বপূর্ণ হুমকি!
আর ওদিকে বুদ্ধের কি অবস্থা দ্যাখেন, বুদ্ধ তো ঈশ্বর সম্বন্ধে টুঁ শব্দটা করলেন না। এখন ব্যাটা কেমন ফাঁপরে পড়েছে। সব্বাই মিলে কেমন তাঁকেই ঈশ্বর বানিয়ে তুলে,পূজাপাঠ নামগান ইত্যাদি লাগিয়ে দিয়েছে। বোঝ ব্যাটা এখন কেমন লাগে!
- তা যাই বলিস, এসব তোর ও দিকে না যেতে চাওয়ার অজুহাত সব।
- আরে রোসো না দাদা, আগেই ফুট কাটেন ক্যান? আপনার হল গিয়ে সেই বেদ-বেদান্ত থেকে দশাবতার হয়ে সেই শঙ্করাচার্য্য, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ (মাঝে আরো মেলা ফুল, হাফ, সেমি অবতারেরা আছেন কিন্তু, আমি সময় আর স্থানাভাব বলে 'দুরন্ত' চালালাম) সবাই তো নানান একটা পথ বাতলেছেন।
- এই জন্য তোরে বলি 'কথামৃত'টা মন দিয়ে পড়। 'যত মত তত পথ' পড়িস নি গর্দভ?
- পড়েছি। ওতে ওরকম কিছু লেখা নেই যদিও, তবে ওই ভাবের অনেক কথা আছে। কিন্তু সে নিয়েও বড় গোলমাল। যদি শোনেন তো বলি, না হলে পাশ কাটাই।
- না, শুনছি, বল।
- এই ধরেন না কেন কাম- কাঞ্চন ত্যাগের কথা। তা কাঞ্চন ত্যাগ তো সাধুরাই করতি পারতেসেন না দেখসি আর আমরা তো কত্তা গেরহস্থ। আর কাম ত্যাগ? সে সব কথা মুখে আর কি বলি? সে দাদা প্রেশার কুকারের মত, কখন সিটি দেয় কেউ বলতে পারে না। আর সে প্রেশার কুকার যে গ্যাস থেকে নামাবেন সে হওয়ারও যো নাই। এখন কার কুকার কখন সিটি দেয় কেউ কইতে পারেনা। লোকে, সাধুতে সে তথ্য গোপন রাখে।
ঠাকুরের কাছে শম্ভু বলে একজন ভক্ত যখন বললেন, আমার খুব ইচ্ছা সব টাকা দিয়ে একটা হাসপাতাল কি ওইধরণের সেবামূলক কাজ করে যাই। ঠাকুর বাদ সাধলেন, বললেন, ‘ঈশ্বর তোমার সামনে এসে দাঁড়ালে কি তুমি হাসপাতাল ডিস্পেনসারী চাইবে? না ভক্তি চাইবে? ভক্তি চাও। ওসব ছাড়ো।‘ তবে আর স্বামীজীর সেবার কতাডার কি হইল?
আবার এদিকে দ্যাখেন স্বামীজীর তো নানান কথা। ভক্তির কথা, জ্ঞানের কথা, কর্মের কথা, যোগের কথা, সেবার কথা, চিঠির কথা, মুখের কথা। এত ভাবের মধ্যিখানে আসল কথাডা খুঁজতি যেয়ে কি নাকানি চোবানি না খাতি হয়। এক এক সময় তাঁরেও নাস্তিক মনে হয়, আবার আস্তিকও মনে হয়। যেন তিনিও কোথাও একটা সবদিক সামাল দিতি যেয়ে সব গুলাইয়া থুইসেন! আসলে মানুষটা আমাগো দ্যাশডারে বড্ড ভালোবাসত কত্তা। তাই তার আর গুরু হওয়া হলনি।
আর শিবজ্ঞানে জীব দেখা তো আর হইল না কত্তা। হয় শিব দেখি না হয় জীব। আর কত্তা শিবের কি আর খিদে, তেষ্টা, কাম জ্বালা আসে, অগুলান তো সব আমাগো জীবের অশান্তি! তাই সেদিকেও বড় একখান যুত করতি পারলুম না।
- তা তুমি এসব কথা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের জানাও নি কেন? তারাই সব সংশয়ের বিনাশ ঘটাতেন!
- জানাই নি আবার?! আপনি তো আমার স্বভাবখান জানেন, মনে প্রশ্ন উঠলেই হল। জিজ্ঞাসা করলুম, বেশিরভাগ গেরুয়া জ্ঞানীই প্রচণ্ড ব্যস্ত, যাঁরা উত্তর দিতে চাইলেন তাদের মোদ্দা কথা – আম খাও, পাতা গোনো কেন? সব্বাই বুঝলেন কি না, আম খেতেই ব্যস্ত, পাতা গোনা কি? গাছটায় পোকা লাগছে কি না সে দ্যাখনেরও সময় নাই কারোর। আরেকটাও কথা ধরেন, এই যে তেনারা একটা ঘরে একশো দেড়শো লোককে ঢুকিয়ে দীক্ষা দ্যান শুনিসি, তা তাতে কিছু হয়? কার কি পথ তেনারা জানলেন কি করে? বলি সব্বার ধাত তো আর এক নয়! এতে ভালো না মন্দ জিগাইতে যাও, খ্যাদাইয়ে দেবে। বলি আরে মশাই যে গুরু আমার লগে চারটে সুখদুঃখের কথা কন নাই, আমার মনডারে পইড়া দ্যাখেন নাই, সে আমার আত্মার খবর পায় কি কইরা? এতবড় জীবনে ওই ঘন্টা তিনেকে কি হয় কত্তা! সবই যে ফাঁকি দেখি!
আরো মেলা গুরু দেখেছি কত্তা, কেউ অ্যামওয়ের ব্যবসার মত শিষ্য ধরে আনতে বলেন। কেউ অর্থ, কেউ দল, কেউ কেউ মানের জন্য ডেকে ফেরেন। আর ওদিকে বৈষ্ণবা বাবাজীরা তো বলেই থুইসেন, আমাগো কৃষ্ণ নাম না করলি ভাই, গেটপাস পাওয়া নাই...হরে কৃষ্ণ! পুরো মনোপলি!
- বেশ বুঝলাম, ঠিক করেছ কি?
- এখন যাই কোথা বলেন। তাই ঈশ্বরকে রেহাই দিসি। আর তাঁরে খুজে কাম নাই। তিনি যদি নিজে থেকে আমায় খুঁজে নেন হল, না হলে না হল। তবে কি জানেন, মাঝে মাঝে মনে একটা সন্দেহ হয়। মানুষের মধ্যে চিরকাল থাকনের লগে একটা বাসনা আছে। এই বাসনাটার বশবর্তী হয়েই সে এই সব আত্মা, ঈশ্বর বানাইনি তো! আর ভবভয় তো আছেই। মরণের, রোগের, দুর্যোগের। কে বাঁচায় এসবের হাত থেকে – "হেথা কে রাখিবে? তেমন আপন কেহ নাই এ সংসারে হায় রে..."
কি জানেন, মাঝরাত্তিরে যখন ইয়ে করতে উঠি, তখন হঠাৎ মনটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। মনে হয় এই আমিডা কে? কার লগে এত বড় বিশ্বে আছি? কে আমি? এই শরীরটার ভিতরে যে বুকটা, সেই বুকের ভিতর কি যে রহস্যময় অন্ধকার! এক আধখান ঈশ্বর থাকলে থাকতিও পারে মনে হয়। মনটায় কেমন একটা মায়ার টান হয়। এতকিছুর মধ্যে এমন জড়িয়ে আছি, হঠাৎ করে সব ছেড়ে চলে যেতে হবে? মানে ফুরিয়ে যেতে হবে? এক আকাশ তারার দিকে তাকিয়ে মন বলে, না না না, সে কিছুতেই হতে পারে না। তখন ভাবি, ঈশ্বর বুঝি মানুষের অবাধ্য অবুঝ হৃদয়ে জন্মানো প্রথম কবিতা! যার সুর আছে, ছন্দ আছে, অথচ না আছে সংজ্ঞা না আছে অর্থ। সবটাই আছে আবার নেইও।
এই দ্যাখেন, কেমন শক্ত ক'টা কথা বলে ফেললুম। আসলে কি জানেন, সব নিয়ম, সব যুক্তি, সব নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর দিকেই চেয়ে বসে আছি, যে আমায় চিনতে পারবে আমি চেনার আগে। যারা বলে মানুষকে ভালোবাসো, তাদেরও দূরে সরিয়ে রেখেছি। যে ভালোবাসা বললে জন্মায় সে কি ভালোবাসা? মানুষের ভিতরে ডুবছি। নানা মানুষ নানা মন। কোনো বাণী নয়, কোনো উপদেশ নয়, কোনো তীর্থ নয়। শুধু মানুষ। শিবজ্ঞানে মানুষ না। 'ঈশ্বর' 'আল্লহ্' 'গড্' তকমা মারা মানুষ না। যে মানুষকে প্রকৃতি তৈরি করেছে এত কোটি কোটি যুগের অধ্যবসায়ে, সেই মানুষকে খুঁজছি, তাতেই ডুবছি, ডুবতে ডুবতে নিজেকে চিনছি, আর নিজেকেই হারাচ্ছি। এখন আমি তত্ত্ব-মত-পথ থেকে মেলা দূরে। যতটা মানুষের সাথে মেলে, নিই, বাকিটা ফেলে দিই। লোভও করি না, ভয়ও পাই না। এই আমার ধর্ম এখন। মানুষ মলে কি হয় জানি না কত্তা, সে বেঁচে কতরকম হয় তাইতেই মজেছি। অমর আত্মা আছে কি না জানি না, তবে সর্বগ্রাসী ভালোবাসা আছে বুঝি। যে মানুষকে মানুষ বানিয়ে তুলেছে তাকে চিনি না, মাটির গন্ধলাগা মানুষেই ডুবেছি।
ছবি - সুমন দাস