Skip to main content

009.jpg

মাকে ডাকলে মা শোনেন। এ অনুরাগী বিশ্বাস। মতলবী বিশ্বাস না। অনুরাগী বিশ্বাস এক আশ্চর্য জিনিস। সাতানব্বই বছরের বৃদ্ধা রাধাকুণ্ডের ধারে বসে আছেন। দু চোখ বন্ধ। গভীর রাত। শ্রীরাধিকার নূপুরের ছন্দে ছন্দে জপের মালা ফিরছে। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গেয়ে উঠছেন। এত প্রশান্ত মুখে! যেন ঘাসের আগায় শিশিরবিন্দুতে ভোরের লাল সূর্যের ছবি। কী উজ্জ্বল। কী স্নিগ্ধ।

হংসেশ্বরী মন্দিরের চাতালে বসে যিনি তিনিও আশি ছুঁয়েছেন। মায়ের কাছে বসে আছে অবোধ মেয়ে। যার বয়েস আশি। মায়ের কাছে আবার সন্তানের বয়েস কী, সন্তানের কাছেই বা মায়ের বয়েস কী? ছেলে বাড়িতে শয্যাশায়ী। পক্ষাঘাতে। মা ভিক্ষা করে দিনের বেলায়। সন্ধ্যবেলা এখানে এসে বসে। শান্তি লাগে। মনে হয় আমি একা তো নই। এই অনুরাগী বিশ্বাস। আমি একা নই। আমি মায়ের। মা আমার। পরীক্ষা করার রুচি নেই। তর্কে যাওয়ার রুচি নেই। শুধু মনের মধ্যে জাগা অনুরাগের কাজলে হৃদয়ের দৃষ্টিকে রঞ্জিত করে নেওয়া। এ অনুরাগের কাজল। এও মায়েরই দেওয়া।

আরেক বৃদ্ধা। দুটো ফুল তুলে শ্রীরাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে নাচছেন। ওটা নাচ না। ওটা আহ্লাদ। ভীষণ আহ্লাদ। বৃন্দাবনের আনাচে কানাচে আহ্লাদ। এ আমাদের আহ্লাদীর জায়গা। এখানে বালিতে বালিতে সেই আহ্লাদ। তার নাম এখানে লাডলি। সে তর্কের না। সে বুদ্ধির অগম্য। সব ডাকই বুদ্ধির অগম্য। বুদ্ধি যখন ম্লান হয়ে আসে ডাক তখন প্রবল হয়ে ওঠে। দিনের আলো কমে এলে রাতের অন্ধকার যখন গাঢ় হতে শুরু করে মধ্যম তখন তীব্র স্বরে লাগে। এ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ বলতেন। বুদ্ধির আলো ম্লান হয়ে এলে ডাকের আকুতি জন্মায়। মা এসো। আমি আর যে পারছি না। ওগো মাধব এসো, আমার পা যে আর সরছে না। আর যে আলো দেখতে পাই না!

ডাক। কী ডাক! শুধু কি জিহ্বায় সে ডাক? চোখে মুখে চলায় বলায় তার শুধু ডাক তখন। মাগো, আমি তোমার, আমি তোমার। ডাক যত সহজ হয়ে আসে জগতের প্যাঁচঘোচ তত কমতে শুরু করে। হঠাৎ হঠাৎ ফুলের গন্ধ আসে। চন্দনের গন্ধ আসে। সে সাড়া দেয়। ব্যথায়, আনন্দে।

সব ডাক সাড়া পাওয়ার জন্যেও না। কিছু ডাক ডাকের নেশায় ডাক। অনুরাগ তখন বিশ্বাস ছাপিয়ে ব্যাকুলতায়। ব্যাকুল হৃদয় ভীষণ আত্মবিশ্বাসী হয়। সে জানে সে পাবে। তার ব্যকুলতায় শিকড় মাটি ছেড়ে ভেসে ওঠে কালসাগরে। বিষাদ নেই আর। মহত ক্যানভাসে কালো বিন্দু দাঁড়ায় না। মহতের আদর মানে নিজের মধ্যের বড় আমিকে বরণ। আত্মমগ্ন প্রাণ। আত্মমগ্ন মন। আত্মমগ্ন বুদ্ধি। আত্মমগ্ন চেতনা। আত্মমগ্ন চেতনার গভীরে জাগা গভীরতম চেতনা, যে চেতনায় জগত চেতিয়ে, যে চেতনার ইঙ্গিতে জগত নিদ্রায়। মা, আমায় ডাকতে শেখাও। মা আমার ডাক হয়ে এসো, সাড়া না হলেও হবে। মা আমার বুক এ ফোঁড় ও ফোঁড় করা ডাক হয়ে এসো। মা, আমি তোমার। আমি একা নই। মা, আমার ডাক হয়ে এসো।