Skip to main content

গোবিন্দপদর রাস্তাতে বেরিয়েই মাথাটায় আগুন খেলে গেলো। আজ দোলের দিন, কোথায় মহাপ্রভুর জন্মদিনে মানুষ হরিনাম করবে, সাত্ত্বিক আহার করবে, তা নাখাসির দোকানে এত লাইন!... সাধে জাতটার কিছু হয় না?

গোবিন্দপদর প্রোমোটারির ব্যবসা। গলায় কণ্ঠী। বুকের কাছে হরিনামের ঝুলি। কপালে তিলক। সোনার সিংহাসনে সোনার গৌরাঙ্গ, সোনার রাধাকৃষ্ণ। সোনার ফ্রেমে বাঁধানো গুরুদেবের ছবি। যখন বুলেটে চেপে কাজ দেখতে বেরোয়, সবাই বলে বেশ রাজার মত ভক্ত বটে। তবে লোকে একটু এড়িয়েই চলে। তবে সে এমনি সাধারণ দিনে। উসবের দিনের কথা আলাদা। সেদিন তো এত পদএত পদনিরামিষের যে এত পদ হয় সে এ তল্লাটে কেউ আগে জানতো না সে কথা গোবিন্দপদ হলফ করে বলতে পারে। কথাটা সত্যিও। গোবিন্দপদ মদ খায় না। খেতেও দেয় না। আমিষ খায় না। কাউকে খেতেও দেয় না। রীতিমতো বাপ বাপান্ত করে তোলে কেউ আমিষ খেলে। সে নিজের মাছ অন্তপ্রাণ মা হোক, কি লেগপিস অন্তপ্রাণ বিধবা বৌদি, কি মাটনবিরিয়ানি অন্তপ্রাণ শাশুড়ি। গোবিন্দপদ মুখ খুললে অনেকেরই চোখে জল রাখা দায় হয়। ভক্তিতে না, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ আর খোঁচা মারা কথায়।

আজ দোলের দিন। তিনতলা বাড়িতে ভোর থেকেই বক্সে হরিনাম চলছে। পাড়াপ্রতিবেশির কানের অবস্থা খারাপ। মাথার অবস্থা আরো খারাপ। ফাঁকিবাজ ছাত্ররা বই গুটিয়েছে। পড়ুয়ারা ফুঁসছে। কিন্তু হলে হবে কি? কারোর কিছু বলার জো নেই। এ পাড়ার ক্লাবে প্রচুর টাকা চাঁদা আসে গোবিন্দপদর অফিস থেকে। সবাই চুপ। সহ্য করে নিতেই হচ্ছে হরিনামের আঘাত।

গোবিন্দপদ বুলেটটা রাস্তার একদিকে দাঁড় করিয়ে মাংসের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। সানগ্লাসটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল, হ্যাঁ রে বিলে, তোর লজ্জা লাগছে না, আজকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের এ ধরাধামে জীব উদ্ধারের জন্য আবির্ভাবের দিন। আর তুই মানুষকে এইভাবে পাপের পথে টানছিস? ছাগলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ, তোর প্রাণে কি একটুও ভয়ডর নেই? কি নরকে পড়বি জানিস?

বিলে একজন খদ্দেরকে দেওয়ার জন্য মাংস প্যাকেটে ভরতে ভরতে বলল, আর ওই যে যদুদা সকাল থেকে প্রায় পোনেরোটা মুরগীকে কেটে বেচে ফেলল, ওকে চোখে পড়ল না তোমার? আমাকেই চোখে পড়ল?

রাস্তার ও ফুটেই যদু, রক্ত ঝরাচ্ছে একটা মুরগীর গলা কেটে। গোবিন্দপদ বলল, কি পাষণ্ড তোরা এক একটা রে!

যদু বলল, আর মাছের বাজারে ওরা? চাকদার সব পুকুরের অর্ধেক মাছই প্রায় বিক্রি হয়ে গেল আজ, দেখোনি যেন?

গোবিন্দপদ আবার বিলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এ অনাচার বন্ধ করেই ছাড়ব। আজই ক্লাবে কথা বলছি। আমার পরিবারকে তো পারলাম না, এই পাড়ার ক্লাবকে ধরেই কাজটা করাতে হবে। কোনো মাছমাংসের দোকানই থাকবে না শালাতবেই সবার কৃষ্ণে মতি হবে।

গোবিন্দপদ বুলেট হাঁকিয়ে গেল ক্লাবের সেক্রেটারি আদিনাথ সামন্তের বাড়ি। আদিনাথ সদ্য খানিক আগেই পাঁঠার মাংস কিনে এনে ঢুকেছে। আজ পার্টি আছে বাড়িতে। মাটন বিরিয়ানি হবে। গোবিন্দপদ ঢুকেই হুঙ্কার পেড়ে বলল, ও আদিনাদ্দা……. আদিনাদ্দা

আদিনাথ লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল, আরে আরে ভিতরে এসো…. তোমাকে তো আর রাত্তিরে ডাকতে পারি নাআজ আমার শালীর হাতে মাটন বিরিয়ানিজনা কুড়ি লোক খাবেসবই আমাদের পার্টিরতোমায় আর কি বলি ভায়া….

গোবিন্দপদের মাথায় তুবড়ি ফাটল। সে তুবড়ির আলোর ফুলকি চোখেমুখেও কিছু তো দেখা গেল, নইলে আদিনাথ হঠা অমন গুটিয়ে গেল কেন। সে আমতা আমতা করে বলল, সবাই কি আর ভক্ত হয় বলো?

গোবিন্দ বলল, হবে না তো…. পাষণ্ড হবে তোমরা সবনীচ…. হীন….

বলতে বলতে সোফায় বসে জামার বুকের কয়েকটা বোতাম খুলে বলল এসিটা বাড়াও….

জামাইবাবু কে এসেছেনচা পাঠাব?

বলতে বলতে শালী এসে ঘরে ঢুকল। ছোবোল লাগল গোবিন্দের বুকে। চোখ পুড়ল। মাথার মধ্যে বিস্ফোরণ। এত রূপ! মানুষ মারার ফাঁদ তো! হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ…..

শালীর সঙ্গে পরিচয় হল। সে অসভ্য মাগী সামনেই বসল? আশ্চর্য! সাধারণত বাজে কথা মনে মনেও বলে না গোবিন্দপদকিন্তু একি! একজন বুকের লোম বেরোনো, জামা আলগা, ঘামন্ত বিবাহিত পরপুরুষের সামনে বসে যাবি…. কিন্তু নিজের জিভে এত মধু এলো কোত্থেকে!

আপনিই বুঝি আজ বিরিয়ানি রাঁধবেনকি আশ্চর্যঅথচ আজ যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মদিনকি আশ্চর্য তাও আপনারা জীবহত্যা করবেনকি আশ্চর্য আমি সবটা শুনেও আপনাকে কিছুই বলছি নাআমাদের সনাতন ধর্ম টিকবে এইভাবে চললেআপনিই বলুন….

একি করছ গোবিন্দ…. গোবিন্দ সামলাও নিজেকেআহা করো কিতুমি যে হাত ধরে ফেলেছআরে একি বাড়াবাড়িতুমি তো কাঁদছকিন্তু তুমি তো সনাতন ধর্মের জন্য কাঁদছ না গোবিন্দতুমি কেন কাঁদছ সে তো জানিইআমি অন্তর্যামীওরে ছাড়….

গোবিন্দপদ মনে মনে বলল, কেন প্রভু ছাড়ব…. নাই হোক এ শরতের পূর্ণিমানাই হোক এ যমুনাতটনাই থাকুক কদম্ববৃক্ষ…. কিন্তু আমার প্রাণে কি ভালোবাসার মধু জন্মাতে নেই…. সেকি পাইকারি দরে শুধুই স্ত্রীকে দেওয়ার জিনিসএনার কি দোষ? এ কেন বঞ্চিত হবে আমার ভালোবাসার ধারা থেকেকেন কেন

হাতটা ছাড়ুন। চোখটা মুছুন। মীরা কবীর পড়েননি? কবীর বলছেন নিরামিষ খেলেই যদি হরিপ্রাপ্তি হত তবে গরুছাগল কবে গোলোকে পৌঁছে নারায়ণের দফারফা করে ফেলত। পড়েননি?

যুক্তি তো আছেই। কিন্তু এ আচার। তাছাড়া পশ্চিমেও তো ভেগান ক্লাব হচ্ছে

সেকি কৃষ্ণপ্রাপ্তির জন্য, নাকি রুচি বদলের জন্য?

ডাক্তারেরাও বলেন

থামুন তো মশায়নিজের রুচি অন্যের ঘাড়ে চাপানো মানুষদের আমি কাপুরষ দুর্বল ভাবি

আমি দুর্বল, আমি কাপুরষ?

নয় বদমাশনয় লোভীনইলে কেন আপনি অন্যের খাওয়া নিয়ে এত ঝামেলা করবেন….

করব না?

না করবেন না। নিজের যা ভালো লাগে করুন। কিন্তু আমি নিরামিষ খাই বলে আমি উচ্চমানের, আমি ঠিক রাস্তায়, বাকিরা সব কীটমাত্রএসব তুচ্ছতাচ্ছিল্য বোধ ছাড়ুন

গোবিন্দপদ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। যুক্তি হারিয়ে গেছে। রাগটাকেও হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছে না। পৌরুষ লেজ নাড়ছে বসে বসে সামনে। ছি ছি। তবু কিছু বলব না? বলতে চাইলেই বা বলতে পারছে কই? ভাবছে এক, জিভ বলছে এক! উফ, একি হল!

গোবিন্দপদ বাড়ি এলো। স্নান করে ঠাকুরঘরে গেল। বলল, কেউ ডাকবে না আমায়।

ঠাকুরের সামনে বসল। মন বসল রত্নাবলীর সামনে। আদিনাদ্দার শালী। বুদ্ধি বলল, হরে কৃষ্ণ। হৃদয় বলল, ওগো রত্না! বুদ্ধি চাইছে শান্তি। হৃদয় চাইছে দহনজ্বালা। পুড়ছে। কৃষ্ণের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি। মানসচক্ষে দেখছে গোবিন্দপদ, বিলের পাঁঠাগুলো হাসছে। স্বর্গে যেতে যেতে হাসছে। মুরগীগুলো বুকের পাঁজরের উপর বসে বলছে, ওকি রত্নাদি যে, স্নান করে ভিজে চুলে রোদে দাঁড়িয়ে কাকে দেখো?

গোবিন্দপদও বলল, কাকে দেখো?

পাশের ঘর থেকে লাঠি নিয়ে গোবিন্দর মা অজন্তাদেবী এসে দাঁড়ালোডাকলি কেন রে?

গোবিন্দ চমকে উঠে বলল, আমিতোমায়না তো?

কেন বউমা যে শুনল তুই জোরে জোরে বলছিস.. মাকে ডাকোমাকে ডাকো….

গোবিন্দ লজ্জা পেলো। রত্নাকে দেখে ডাক শেষে মাকে ডেকে এনেছে! গোবিন্দপদ মাকে প্রণাম করে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ ডেকেছিই তোবোসো

বসব, কিন্তু মাছ ছাড়ব নাওসব আমায় আর বুঝোস নে কিন্তু….

গোবিন্দপদের চোখে জল এলো। এক ঘর থেকে আরেক ঘরের ডাকেই যদি মানুষ এত ভুল শোনে, তবে যুগান্তরে কবে কি বলছিল সেই বা মানুষ ঠিক শুনবে কি করে? আর ঠিক বোঝার সে-ই বা কে? সে শুধু রত্নার চোখে ডুবতে চায়। রত্না তাকে নিক। কিন্তু এ তো পাপ! সে বিবাহিত। হোক। সে তো সমাজের। সমাজের বাইরে কি কিছুই অবশিষ্ট থাকে না? সব পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু অন্তর্যামী পুড়ছে না কিছুতেই। গোবিন্দ অন্তর্যামীকে জিজ্ঞাসা করল, কি হবে?

অন্তর্যামী মুচকি হেসে, দুষ্টু তাকিয়ে বলল, আমি কি জানি!