Skip to main content

তপেন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। নার্সদিদি এসে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ তপেন?

তপেন বলল, দিদি আমি বাড়ি যাব, না মারা যাব?

নার্স বলল, বাড়ি যাবে।

তপেন বলল, জানো কাল যখন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল, তোমাদের হাস্পাতাল মনে হচ্ছিল ভাসিয়ে নিয়ে যাবেআমি তখন একটা স্বপ্ন দেখলামতোমার চড়াই পাখির মত একটা বাচ্চা হয়েছে

নার্স কপট ধমকের সুরে বলল, ওই, আমার তিপ্পান্ন বছর বয়েসসাতকূলে কেউ নেইআমার কি করে বাচ্চা হবে শুনি?.. তাও চড়াই!

তপেন বলল, আরে শোনোই না…. সে তোমার বাড়ির সামনে পেয়ারা গাছে থাকে….

আমার বাড়ির সামনে ধুধু মাঠকোনো গাছ নেইনার্সদিদি তাকে থামিয়ে বলল।

তপেন শুনল নাসে বলে চলল.. সেই মাঠে একটা পেয়ারা গাছ। সেই গাছে একটা চড়াই পাখিআসলে ও তোমার ছানাতুমি যেই না তালা লাগিয়ে রাস্তায় নামো হাস্পাতালে আসবে বলে, অমনি সে বলে, মাতাড়াতাড়ি চলে এসোআমরা বেড়াতে যাব….

নার্সদিদি হাসতে হাসতে, বলতে বলতে চলে গেল.. শেষে কিনা চড়াইয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাব! তপেন নার্সদিদির যাওয়াটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চাদরটা ঢেকে শুয়ে পড়ল। তার পায়ের কাছে জানলায় এসে বসল একটা চড়াই।

পরেরদিন সকালে আবার নার্সদিদি এলো। তপেনকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ বাবা?

তপেন বলল, আমি বাড়ি যাব, আবার ভ্যানে করে সব্জী বিক্রি করব? না তোমাদের গাড়ি করে শ্মশানে যাব গো?

নার্সদিদি বড় বড় চোখ করে বলল, ফের বাজে কথা। তোরও সাতকূলে কেউ নেই, আমারও নেই। আমি ওসব ছাইভস্ম বকি?

তপেন বলল, তোমার তো ক্যান্সার নেই পেটে

নার্সদিদির মুখটা কালো হয়ে গেল।

তপেন বলল, আমি আবার একটা স্বপ্ন দেখেছি জানোএবার তোমার একটা বেড়াল ছানা হয়েছেতুমি যেই তালা লাগিয়ে তাকে বাড়িতে একলা ফেলে আসোতোমার হুস করে মন খারাপ হয়ে যায়…. এখন যেমন হলতুমি জানো আমি বেশিদিন বাঁচব নাকিন্তু তোমার চড়াই আর বেড়াল অনেকদিন বাঁচবে দেখো….

নার্সদিদি ঝাপসা চোখে অন্য বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল, কি যে বলে পাগলের মত।

তপেনের বেডের নীচে একটা বেড়াল ডাকল, ম্যাও। তপেন চাদরটা ভালো করে ঢেকে নিল। তার জ্বর আসছে আবার।

পরেরদিন সকালে আবার নার্সদিদি এলো। আবার একই কথা হল। তবে আজ তপেন নিজের মারা যাবার কথা জানতে চাইল না। সে নার্সকে বলল, আমার কাছে এসে আমার হাতটা ছোঁও….

নার্স ছুঁলো। তপেন বলল, আমি আজ স্বপ্ন দেখলাম, ভোররাতে দেখলাম, আমি তোমার পেটে জন্মেছিআমায় এমন বিশ্রী দেখতে হয়নি গোতোমার মত ফর্সা, সুন্দর দেখতে হয়েছি…. তুমি আমায় কোলে নিয়ে দোলা খাওয়াতে খাওয়াতে বলছ, আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, তুমি খুব লক্ষ্মী হয়ে থাকবে হ্যাঁচড়াই আর মিনি তোমার সঙ্গে খেলা করবে…. হাস্পাতালে একজন তপেনকাকু আছেসে আজ বাড়ি যাবে.. আমি ওকে এগিয়ে দিয়ে আসি? তোমার কোলে যে আমি, তার নাম তখন তো তপেন নাতুমি নতুন নাম দেবে আমারদেবে না?

হাস্পাতাল থেকে ফিরে সুনন্দা বাড়ির দরজা খুলল। সারাটা ঘর এত ফাঁকা লাগেনি কোনোদিন। আজ ভোরে তপেন মারা গেল। সুনন্দা খেল না কিছু। শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। এত ফাঁকা লাগেনি কোনোদিন সব কিছু। অসহ্য লাগছে সব।

রাতে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। ঘুম ভেঙে গেল। বৃষ্টির ছাঁট আসছে। জানলাগুলো ধুমধাম পড়ছে। আলো জ্বালল সুনন্দা। অবাক হয়ে দেখল, একটা চড়াই আর একটা বেড়াল ভিজে চাপ হয়ে একজন পাখার উপর আর একজন তার সোফার উপর বসে। সুনন্দা মাটিতে বসে পড়ল। ফোয়ারার মত কান্না এলো গলা চিরে। এত এত কান্না সে মা, ভাই কেউ মারা যাওয়াতে কাঁদেনি। চুপ করে সহ্য করেছে। মনে হয়েছে সব কান্নাকে চেপে পিষে শেষ করে দিয়েছিল এতদিন। ছেলেটা সব জেনে গেল কি করে? এত এত কান্না?

ঝড়ের আওয়াজে কান্নার আওয়াজ গেল ঢেকে। সুনন্দা দেখল তার কোলের কাছে এসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বেড়ালটাযেন বলছেমাআমায় নাও।

সুনন্দা চোখের জল মুছে বলল, দাঁড়া দুধ গরম করি