সদানন্দ আর সন্ধ্যা লাইনে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা সদানন্দের পিছনে দাঁড়িয়ে। ছিয়াত্তর বয়সের মানুষটার শরীর টাল খেয়ে যায় যখন তখন। লাঠিটাও শক্ত করে ধরে রাখতে পারে না। শিরা বেরোনো হাতটা থরথর করে কাঁপে। সন্ধ্যা অতটা অশক্ত নয়। এখনও চারটে বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়। তার বয়েস তার মনে হয় আটান্ন হবে। কিন্তু আধার কার্ডে লেখা তেষট্টি। কি করে হয় কে জানে!
গত দু'দিন আগেও ভ্যাক্সিনের জন্য এসেছিল। ভোর ছ'টা থেকে লাইন দিয়েছিল। ডাক্তার এলো এগারোটায়। বলল, মোবাইলে নাম না লিখিয়ে আনলে হবে না। কিন্তু ওরকম বড় আঙুল ছোঁয়া মোবাইল সে কোথায় পাবে? তার যে মোবাইলটা গার্ডার দিয়ে বাঁধা আজ তিন বছর হল চলছে তাইতে কথাই শোনা যায় না ঠিক মত, তায় ভ্যাক্সিনের জন্য ফোন করবে কাকে?
"ফোন করবেন না... রেজিস্ট্রেশন করবেন। বাড়িতে আর কেউ নেই?"
"না তো, ছেলে বজবজে কাজ করে। মাসে একবার আসে।"
"পাশে কেউ নেই?"
উত্তর দেয়নি সন্ধ্যা। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সদানন্দ মোটা চশমার কাঁচের ফাঁক দিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। মানুষটা কিছুই বুঝতে পারে না আজকাল। সুখ-দুঃখ কিছুই বোঝে না, না নিজের, না সন্ধ্যার। চোখে ভালো দেখে না। হাস্পাতাল থেকে চশমা দিচ্ছে নাকি। কিন্তু যাবে কি করে? ট্রেন চলছে না। এদিকে খালের ধারে একটা জমি কিনে বাড়ি করেছে সারা জীবনের টাকা জমিয়ে। তাও ধারবাকি অনেক। সুজনের লকডাউনে কাজ নেই। ও কিছু পাঠায় না। সন্ধ্যাই কাজ করে যা পায় তার কিছুটা দিয়ে দিয়ে ধার শোধ করছে। চশমা বানানোর টাকা কই?
সদানন্দ দরদর করে ঘামছে। আজ গুমোট খুব। সন্ধ্যা সদানন্দ'র কাছে গিয়ে বলল, চলো, আজ হবে না।
"হবে না?", বাচ্চাদের মত মন খারাপ করে বলল সদানন্দ। সন্ধ্যা মুখের ঘাম মুছে বলল, না গো, বাড়ি চলো।
সাত সকালে ভাত আর আলুসেদ্ধ করে রেখে এসেছে। একটা ডিমসেদ্ধ করে দু'জনে আধখানা করে খেয়ে নেবে। সদানন্দ মাছ খেতে চাইছে ক'দিন হল। কিন্তু ও যে মাছ ভালোবাসে সেকি এখন কেনা সম্ভব?
"আপনার কাছে মোবাইল, আধারকার্ড আছে?", একটা অল্পবয়েসী ছেলে।
"হ্যাঁ, কেন বাবা?"
"দিন আমি রেজিষ্ট্রেশন করে দিচ্ছি।"
সন্ধ্যা সদানন্দের সাদা পাঞ্জাবীটার পকেট থেকে ফোনটা, আধার কার্ড দুটো বার করে ছেলেটার হাতে দিল।
ছেলেটা চটপট নিজের ফোনে একটা ফোন করে বলল, এই নাম্বার তো?
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। সদানন্দের পাঞ্জাবীটার জন্য লজ্জা লাগছে। অনেকদিন পর এই ধরণের লজ্জা লাগছে। নানা টানাপোড়েন সামলাতে সামলাতে সমাজের লজ্জার কথা ভুলেই গিয়েছিল। কি ময়লা হয়েছে পাঞ্জাবীটা! দুটো জায়গায় ছেঁড়া। নিজের অজান্তেই ছেঁড়া আঁচলটা মুখে চাপা দিল। সদানন্দ নির্বিকার চিত্তে মাটির দিকে তাকিয়ে লাঠিটার ছায়ার সঙ্গে খেলছে।
ছেলেটা ফোন আর কার্ডদুটো সন্ধ্যার হাতে দিতে দিতে বলল, কাল ভ্যাক্সিন হবে না, পরশু আসবেন। সকালে আসবেন হয়ে যাবে। আর এই কার্ডদুটো ল্যামিনেশন করিয়ে নেবেন নইলে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা মাথা নাড়ল।
আজ হয়ে যাবে। সকালে দু'জনেই ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। রাতে জ্বর আসবে। তাই মুড়ি খেয়ে নেবে, রান্নার ঝামেলা আর নেই।
সদানন্দ'র সঙ্গে কতদিন পর একসঙ্গে বাইরে বেরিয়েছে। সন্ধ্যার পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। পৃথিবী পুরোনো হয় না, মন পুরোনো হয় না, শুধু শরীরটা পুরোনো হয়ে যায়। মানুষ পুরোনো হয়ে যায়। আর কিছুদিন পর তারা দু'জনেই থাকবে না, কিন্তু এই সব থাকবে। হাস্পাতালের দরজার সামনে কয়েকটা ধুতরো ফুটে আছে। তার পাশে কুটুস ফুলের ঝাড়। কয়েকটা বড় আমগাছ। দূরে পুকুরপাড়ে বাচ্চাদের চীৎকার। লাইনে লোকজনের কথা। সব মিলিয়ে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা। এত মানুষের সামনে সদানন্দকে নিয়ে কতদিন বেরোয় না। আজকে পাঞ্জাবীটা সেলাই করে এনেছে। সদানন্দের আর তার মাস্কটা পঞ্চায়েত থেকে দিয়েছে এক কাজের বাড়ির দাদা। ঘাম হচ্ছে। তবে একটা স্বস্তিও হচ্ছে। মুখটা পুরো দেখা গেলে লজ্জা লাগত।
সদানন্দ'র কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, জল খাবে?
সদানন্দ মাথা নাড়ল। সন্ধ্যা সদানন্দের আরেকটু কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। সেই ছবি মনে পড়ছে। সার দিয়ে চিতার পর চিতা জ্বলছে। টিভিতে দেখেছে। সদানন্দকে নিয়েই ভয়, সে নিজে না হয় যুঝে যাবে, ও কি এই শরীরে পারবে? এমনিতেই শীতে যা শ্বাসকষ্টতে ভোগে! কি আতঙ্কে যে দিন কাটে! ঠাকুর ঠাকুর করে যেন ভ্যাক্সিনটা হয়ে যায়।
সন্ধ্যা ডান হাতটা দিয়ে সদানন্দের হাতটা ধরে বলল, বসবে একটু?
একজন পিছন থেকে বলল, দাদু আপনি বসুন... ঠাকুমা আপনি দাদুকে নিয়ে বসুন, আমরা লাইন এলেই ডেকে নিচ্ছি….
সন্ধ্যা সদানন্দকে নিয়ে একটা সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসল। মাথার উপর রাধাচূড়া গাছ একটা। এতদিন পর আবার কি প্রচণ্ড বাঁচতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে এখনই ফোন করে বাবুকে বলে, তুই কিচ্ছু ভাবিস না বাবু, আমরা ঠিক টাকা জোগাড় করে ধার শোধ করে দেব, তোর মায়ের শরীরে এখনো অনেক শক্তি আছে। সদানন্দ ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমাক। সারা জীবন অনেক খেটেছে। পুরুষ মানুষের প্রাণ মাকড়সার মত, একটা ঝাঁটার বাড়িতেই মরে গুটিয়ে যায়। মেয়েদের প্রাণ অত নরম না। সে একাই পারবে বাবুকে আর সদানন্দকে আগলে রাখতে।
"ঠাকুমা আসুন…."
লাইন থেকে একজন চীৎকার করে ডাকল।
সন্ধ্যা উঠে সদানন্দকে ডাকল, "এই শোনো... চলো…."
সদানন্দ সাড়া দিল না। ডাক্তার এলো। নার্স এলো। কত ডাকাডাকি করল। সাড়া দিল না সদানন্দ। সন্ধ্যা কাঠের মত দাঁড়িয়ে থাকল। বাবু নেই, চারমাস আগে করোনায় মারা গেছে দিল্লীতে। বজবজে কেউ থাকে না। সব মিথ্যা। নিজেকে সে প্রাণপণ বিশ্বাস করিয়েছিল যাতে সদানন্দ জানতে না পারে। একদিনও কাঁদেনি সে। শুধু মাঝে মাঝে বুকের ভিতরটা খামচে ধরা শ্বাসকষ্ট হত একটা। এখনও হয়। শ্বাসকষ্ট মানে বাবু। সে আছে। ঈশ্বরকে না দেখে যদি মানুষ শুধু বিশ্বাস করে তাঁকে নিয়ে থাকে, এত সেবাভক্তি করে, বাবুকে নিয়ে থাকতে পারবে না? বেশ পারবে। কাউকে কিছু বলেনি সন্ধ্যা, যাতে কোনোভাবে সদানন্দের কানে এসে না পৌঁছায়। ছেলে অন্তপ্রাণ মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে মারা যেত। রোজ ফোন ধরে বসে থাকত, অপেক্ষা করত ছেলের ফোনের। সন্ধ্যা বলত ফোনের লাইন খারাপ। বাবুর শেষ কথা, "আমার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মা। তোমাদের হয় তো আর দেখতে পাব না। তোমরা ভালো থেকো... সাবধানে থেকো".....
সন্ধ্যা নিজেকে প্রাণপণে বিশ্বাস করিয়েছিল সুজন আছে। বজবজেই আছে। এখন তার মনে হচ্ছে সবটা যেন খেলা, গোটা জীবনটাই যেন একটা খেলা, সদানন্দ একটু পরেই জেগে উঠবে। আজ তাদের দু'জনের জ্বর আসবে রাতে। গরমের মধ্যে কম্বল গায়ে দিয়ে শোবে দু'জনে। কম্বলটাও বাইরে বার করে রোদে দিয়েছে গতকাল সন্ধ্যা। বাবু খোঁজ নিতে ফোন করবে। তাদের ভাঙা ফোনে ফোন আসবে, মা, আমি সেরে গেছি, আমার ভ্যাক্সিন হয়ে গেছে, তুমি আর বাবাও নিয়ে নাও।
সব শেষ, হতে পারে? না, হতে পারে না। ডাক্তারের ঘরের দিকে এগোলো সন্ধ্যা ধীরে ধীরে। নার্সকে বলল, আমার ভ্যাক্সিনটা?