Skip to main content

হিঁদু আর হিন্দু। আমি না, রবি ঠাকুর বলতেন। বৈষ্ণব আর বোষ্টুম। এও আমি না, রবীন্দ্রনাথ বলতেন।

গতকাল রাস্তায় দেখি ঝাঁটা আর ঝাঁটা। যেদিকে তাকাই ঝাণ্ডার মত করে ঝাঁটা হতে চলেছে নরনারী। এর নিশ্চয়ই কোনো পৌরাণিক বিধান আছে, কি গপ্পো আছে, দেবদূত পট্টনায়ক জানবেন, আমার সেসব জানার ইচ্ছা বা কৌতূহল কোনোটাই নেই। গয়না কেনা নিয়েও অনেক গপ্পো নিশ্চয়ই আছে। সেও জানবেন তিনি, ওতেও আমার কোনো উৎসাহ নেই। হিঁদুর নিয়মের, বিধানের, আচারের শেষ নেই। আর নেই শুচিবাইতার। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন হিঁদুর আচার-বিচার এক অলৌকিক শুচিমার্গে চলে। কখন কোন নক্ষত্রে, কি রাশিতে কি কি করলে অশুচি হয়, আর হয় না সে নিয়ে তর্ক, বিধান কিছুরই কোনো সুষ্ঠু সমাধান নেই। এই যে আমরা কথায় কথায় বলি না, "তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে?".... অর্থাৎ ওই "অশুদ্ধ" হওয়া নিয়েই আমাদের যত গোল।

তো গতকাল সোনায়-ঝাঁটায় রাস্তায় দোকানে বাঙালিকূলকে দেখে পরম পুলকিত হলাম। রবীন্দ্রনাথের নাম শুধু যে কোথায় কোন ফলক থেকে মুছে যাচ্ছে তাই নয়, বুদ্ধির ঘটেও আর সে চিহ্ন নেই দেখছি। শুধু কি রবীন্দ্রনাথ? রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদও দেখছি রীতিমতো বাঙালির ভক্তিবুদ্ধি ছাড়া হয়েছে। নইলে মা কালীর আকার এমন সত্তর হাত, পাঁচশো হাত হয়! বালাইষাট! যাঁকে বাঙলার এই মাটিতেই মাতৃসাধকেরা মা, মেয়ে রূপে দেখে এত এত পদ লিখল, তাঁর দেবীরূপের থেকে আত্মিক রূপ বড় হল, সে ভক্তিবুদ্ধিও জলে চলে গেল? রামকৃষ্ণদেব বলছেন ভক্ত ঈশ্বরের মাধুর্যে মগ্ন হয়, ঐশ্বর্যে মত্ত নয়। আর এদিকে একি দেখি! ঘাড় উঁচু করে ওই দশাসই চেহারায় মা! আচ্ছা আমাদের গীতাতেই আসা যাক। যখন অর্জুনকে ভগবান বিশ্বরূপ দেখাচ্ছেন তখন অর্জুন ব্যথিত হয়ে স্তব করে বলছেন, হে প্রভু তুমি মানুষ রূপেই আমার সামনে এসো, তোমার এই রূপ দেখে আমার মন ব্যথিত হচ্ছে, অশান্ত হচ্ছে। তুমি মানুষরূপে এসো প্রভু, মানুষরূপে এসো। ভগবান তখন মানুষ রূপে এসে দাঁড়ালেন অর্জুনের সামনে। রামকৃষ্ণদেবও বলছেন তাই, ভক্তের ভগবান ভোরের সূর্য। সে কোমল, সে মাধুর্যময়। আনন্দময়। একবার দক্ষিণেশ্বরে মায়ের গা থেকে সব সোনার গয়না চুরি হল। মথুর ক্ষোভ করে ঠাকুরের কাছে বলছেন, তোমার মা গয়নাগাটিও রক্ষা করতে পারল না? ঠাকুর বলছেন, তোমার কাছেই ওসব গয়নাগাটি। মায়ের কাছে ওসব মাটির ঢেলা।

কিন্তু ভিড়ের কাছে এসব কথা শুধুই ভাবের কথা। অকাজের কথা। সেখানে গয়না চড়ালেই ভিড় বাড়ে। বলে মায়ের গয়না দেখতে গিয়েছিলাম! সেখানে আর মাধুর্য কে খোঁজে। ভিড় খোঁজে উন্মাদনা। আসল যে সে তো মনের মাধুর্যের আলোয় মধুর। বাকি যা সে বিস্ময়ের ঝলকানিতে অভিভূতি বই তো নয়!

যা হোক, তবে বিস্মিত হওয়ার আরো বাকি ছিল। এখন তো কোলেকাঁখে, বাইকে, সাইকেলে, ট্রেনেবাসে গোপাল নিয়ে যাওয়ার চল হয়েছে। বাঙালিকে যাঁরা ভক্তিমার্গ শিখিয়েছেন, সেই তাঁদের মধ্যে যিনি উজ্জ্বলতম, সেই মহাপ্রভুর ওসব লাগেনি। বাদবাকি অনেক পরে যদিও বা কেউ নিয়েছেন তাঁরা হয় তো গোপনে, অতিযত্নে আড়ালে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ সে সবের বালাই নেই। বিজ্ঞাপনের যুগে সবই বিজ্ঞাপনের বিষয়। এক ভক্ত শুনলাম তিনি তাঁর গোপালকে মাছ-চিকেন-মটন সব খেতে দেন। আশ্চর্যই লাগল। বৈষ্ণব মতে এসব তো শুনিনি। তারপর মনে হল এই এত বছর ধরে তো হংসেশ্বরী মন্দিরে, মায়ের সামনে বলি হয়ে এসেছে। গোপাল কি আর কালী নন? তবে আজ হংসেশ্বরীতে সে সব বন্ধ হল। কেন বন্ধ হল জানি না। তবে আবার রামকৃষ্ণদেবের একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক বাড়ি ধুমধাম করে পুজো হয়। অনেক অনেক পাঁঠাবলি হয়। তা এক বছর হল কি, বলি হল না। তখন একজন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁ গা, তোমাদের বলি হবে না এবছর? তো গৃহকর্তা বললেন, না না, সব দাঁত পড়ে গেছে তাই আর বলি-টলি হয় না।

ধম্মো বলো, অধম্মো বলো, নীতি বলো, দুর্নীতি বলো… সবের মূলে হল মানুষের মন। ওই মনেতেই সব। মন সৎ হলেই সব সৎ হয়। স্বার্থবুদ্ধি আর নিঃস্বার্থ বুদ্ধি, এই গোলকধাঁধায় সব। তার মধ্যে অলিগলি চোরাপথে চালাকির গুপ্ত স্রোত। মন যদি চালাকি না ছাড়ে তবে বাইরে যতই যাই হই না কেন - আস্তিক, নাস্তিক, সেক্যুলার, ফাণ্ডামেন্ডালিস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি…. সবই শুধু পোশাক। রামকৃষ্ণদেব বলছেন তিনি মন দেখেন। কথাটা বিশ্বাস হয় না আমাদের। কারণ মনটাকে স্বচ্ছ করে দেখার অবকাশ সংসারে এত এত রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান-বিশ্বাস-প্রথা ইত্যাদি সামলাতে সামলাতে আর পাওয়া যায় না। তখন মনে হয় অত তলিয়ে ভাবার দরকার কি? স্রোতে গা ভাসিয়ে দিই। সবার যা হবে, আমারও তাই হবে। এই করে একটার পর একটা চালাকি গ্রাস করতে থাকে। ভাষা পটু হয়ে ওঠে। ভাব পঙ্গু হয়ে ওঠে। চিন্তার জালে আটকে পড়ে গভীরের প্রাণী হাঁসফাঁস করে ওঠে। অথচ বেশি কিছু না, নিজের মনটাকে একটু স্বচ্ছ করে দেখার কথা ছিল। ওকেই নিজেকে জানা বলে। ওকেই অন্তরের আলো বলে। ওকেই শান্তি বলে। ওকেই তুষ্টি বলে। কিন্তু সে আলোকে চাই কি আমরা? নাকি বাইরের আড়ম্বরের আলোরই তৃষ্ণা আমাদের?