সিদ্ধেশ্বরবাবু এমনিতে বেশ খোলা মনের মানুষ। কিন্তু নিজের নামটা নিয়ে ওনার খুব আক্ষেপ। এখনও সিদ্ধিলাভ বলতে যা বোঝায় তা হল না। অবশ্য ঠিক কি বোঝায় তাও সঠিকভাবে কোনো ধারণা নেই ওনার। তবু খুব ইচ্ছা, সিদ্ধিলাভ হোক। বয়েস চুয়ান্ন। সরকারি অফিসে সাধারণ একটা কাজ করেন। আহামরি জীবনে কিছু একটা চাহিদা কোনোদিনই তেমন কিছু ছিল না, এখনও নেই। এমনকি ওনার স্ত্রী ব্রজবালারও নেই। সুখের জীবন। একমাত্র মেয়ে, তাও বিয়ে হয়ে গেছে। ঝাড়া হাত পা। মাঝে মাঝেই তীর্থে বেরিয়ে পড়েন দু'জনে। আজ কাশী, কাল গয়া, পরশু রামেশ্বরম, এরকম লেগেই আছে। একবার শালাদের পাল্লায় পড়ে গোয়া গিয়েছিলেন, কিচ্ছুতেই ভালো লাগল না। না ওনার, না ওনার স্ত্রীর। সেই থেকে আর ওসব জায়গায় যান না।
যেখানেই যান, হোটেলে ঢুকে হাত মুখ ধুয়েই সিদ্ধেশ্বরবাবু সাধু খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। এই চক্করে বহু টাকার নয়ছয় হয়েছে। প্রচুর ঠকেছেন। তবু হাল ছাড়েননি সিদ্ধেশ্বরবাবু। গুরু চাই। তত্ত্ব চাই। পাই কই?
ঠিক কোন পথে গেলে দিশা মিলবে তাও ঠাহর করে উঠতে পারছেন না। বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব সব মত পড়ে দেখেছেন। কিছুতেই মন বসে না। তাদের পাড়াতেই তো কত ঘর। রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত চক্কোতিরা। বোসেরা রাম ঠাকুরের। পাকড়াশিরা লোকনাথ বাবার। গুরুপদরা অনুকূল ঠাকুরের। মুখার্জীরা বালক ব্রহ্মচারীর। দাসেরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে। রায়চৌধুরীরা নিগমানন্দের। ভটচাযেরা তারা মায়ের। বাড়ুজ্জ্যেরা পরমহংস সরস্বতীর। পালেরা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর। আরো কত কত নাম না জানা দাড়িমুখ, জপের থলি হাতে, ঊর্দ্ধদৃষ্টি সব গুরুরা তো আছেনই। সিদ্ধেশ্বরবাবু খুব বিভ্রান্ত, যায় তো যায় কোথায়। তিনি গীতা, ভাগবত, উপনিষদ, চণ্ডী, পুরাণ সব পড়েছেন। বৌদ্ধ, খ্রীষ্ট, সুফি ইত্যাদি শাস্ত্রও পড়েছেন। সবই তো এক রকম লাগে। বলার ভঙ্গীগুলোই যা আলাদা। সবই ভালো লাগে সিদ্ধেশ্বরবাবুর, কিন্তু সবার সবটা আবার বুঝতে পারেন না। তাই গুরুকরণ আর করা হয় না। এদিকে বয়েস হয়ে যাচ্ছে। শরীরে নানান গড়বড় আসা শুরু হয়েছে। কি করেন কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছেন না। তুলসীর মালা, রুদ্রাক্ষের মালা সবই কিনে রেখেছেন। পাছে কোনোটা একটা কাজে আসে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
জুলাই মাস। সিদ্ধেশ্বরবাবুরা পুরী এসেছেন। যথারীতি সাধু খুঁজে ফিরে এসেছেন। মেলা সাধু কিন্তু তবু মনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সামনেই রথ। ভিড় বেশ জমেই উঠেছে। সিদ্ধেশ্বরবাবু চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে হোটেলের ঝুল বারান্দায় এসে বসেছেন। এখন বিকাল, কিন্তু যেহেতু সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, আলোটা কম। ব্রজবালা ঘুমাচ্ছে, ওর মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে।
সিদ্ধেশ্বরবাবু উদাস। দূরে তাকিয়ে দেখছেন জেলেরা নৌকা নিয়ে উত্তাল সমুদ্রের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। কিছু ইয়ং ছেলে এরই মধ্যে স্নান করছে। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের ভঙ্গী ওদের সারা শরীরে। বাইরের মনটা এসব দেখলেও, ভিতরের মনটা ক্ষুণ্ন হয়েই রয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন - কিচ্ছু হল না।
হঠাৎ কি হল। শরীরটা খারাপ লাগতে লাগল। মাথাটা টলতে শুরু করল। ভীষণ ঘুরতে শুরু করেছে। ঘাম হচ্ছে। সারাটা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ের কাছে একটা চিনচিনে ব্যাথা করছে। ব্রজকে ডাকতে গেলেন, জিভ জড়িয়ে গেল। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল।
একটা সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে চলেছেন মনে হচ্ছে। হঠাৎ সুড়ঙ্গটা শেষ হয়ে গেল। উনি দেখলেন উনি চেয়ারে একদিকে কাত হয়ে হেলে পড়ে আছেন। চায়ের কাপটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে। চা মাটিতে গড়িয়ে ধারের দিকে যাচ্ছে। উনি হাল্কা হয়ে যেন শূন্যে উড়তে পারছেন। কিন্তু চারদিকে সমুদ্র, মন্দির এসব কই? শুধুই আলো আর আলো। আর তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে কিছু কিছু কালো বিন্দু বিন্দু। কিচ্ছু বুঝছেন না সিদ্ধেশ্বরবাবু। নিজের চেহারার দিকে তাকালেন। শুধুই একটা আলোর অবয়ব মনে হল। হঠাৎ মনে হল, কাকে যেন খুঁজতে হবে। সাধুকে খুঁজতে হবে। কিন্তু সাধু কোথায়? এ তো শুধু আলো আর আলো। তিনি ভেসে বেড়ালেন, যতই যান ততই আলো। কিছু কিছু খুব ঘন আলো। আলোর মধ্যে আলো। সিদ্ধেশ্বরবাবু কিচ্ছু বুঝছেন না, কিন্তু তবু বেশ লাগছে। হঠাৎ মনে হল, ইস যদি ব্রজ আসত আমার সাথে। যেই না ভাবা, অমনি একটা আলোর ফুলকি তার শরীর থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সিদ্ধেশ্বরবাবু থতমত খেয়ে বললেন, কে?
- আমি
- আমি মানে? কে আপনি?
- ভালোবাসা। তুমি যে এইমাত্র ভালোবাসা অনুভব করলে, আমি সেই।
সিদ্ধেশ্বরবাবু বললেন, আপনি... মানে ওই যে বিন্দু বিন্দু আলোর ফুলকি ঘুরে বেড়াচ্ছে ওগুলো সব ভালোবাসা?
- হ্যাঁ।
- আর এই যে আলোর সমুদ্র, এটা কি তবে?
- চেতনা
- মানে?
- মানে, চেতনার সাগরে ভালোবাসার বিন্দু।
- ওরা চিরকাল ভাসে?
- না, যতদিন মানুষের আয়ু ততদিন বাঁচে।
- তারপর?
- মিলিয়ে যায় এই আলোর সাগরে
- ওই বিন্দুগুলো ভেসে কি করে?
- প্রার্থনায় সাড়া দেয়
- কার প্রার্থনায়?
- যে ভালোবাসাটা জন্ম দিয়েছে তার প্রার্থনায়
- তবে যে সবাই বলে ঈশ্বর সাড়া দেয়
আলোর বিন্দু চুপ করে রইল।
সিদ্ধেশ্বরবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ওই কালো বিন্দুগুলো কিসের তবে?
- ওগুলো ঘৃণার
- ওরা কি করে?
- ওরা আশ্রয় খোঁজে
- কেন?
- কারণ ওরা আলোর সাগরে মিশে যেতে পারে না বলে
- কোনোদিন মেশে না?
- মেশে, যদি ওর আশ্রয়দাতার হৃদয়ে আমি জন্মানোর সুযোগ পাই তো, তখন ওরা আমাতে এসে মেলে।
- এত কালো বিন্দু কেন?
- অনেক কালো বিন্দু মিলে একটা প্রলয় তৈরি হয়।
- তখন কি হয়? সব ধ্বংস হয়ে যায়?
- তাই হয়েছে কখনও? তখন আমরা সবাই মিলে একটা গ্যালাক্সি তৈরি করি, তারপর জন্মাই।
- কোথায় জন্মাও?
- কোনো মহাত্মার হৃদয়ে।
- তবে ভগবান? তিনি নেই?
আলোর বিন্দু চুপ করে রইল।
সিদ্ধেশ্বরবাবুও চুপ।
হঠাৎ কি হল, সিদ্ধেশ্বরবাবু ডুবে যেতে লাগলেন কোনো অতল গভীরে... তীব্র আনন্দে সমস্ত অস্তিত্ব ছিঁড়ে পড়তে লাগল ওনার টুকরো টুকরো হয়ে... এক বিশাল আলোর শূন্যতা যেন ওকে ঘিরে দাঁড়াল... চারদিকে সিদ্ধেশ্বরবাবু নিজেকেই যেন দেখছেন... সব সব সব তিনি... আলো অন্ধকার... সব সব সব তিনি...
সিদ্ধেশ্বরবাবুর জ্ঞান ফিরল। হাতে চায়ের কাপ ধরা। ভাঙেনি তো। মেঝেতে চায়ের দাগও নেই। চা গরমই আছে। ওই তো জেলেরা, ওই তো ওরা স্নান করছে এখনো। সিদ্ধেশ্বরবাবুর মনটা অদ্ভুত শান্ত।
- হ্যাঁ গো শুনছ... কি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম গো...
ব্রজবালা আলুথালু হয়ে এলেন, সামনের চেয়ারে বসলেন...
- সে একটা আলোর সমুদ্র... তুমি আর আমি ভাসছি... যতবার তোমায় ধরতে যাচ্ছি তুমি আমার সাথে মিলিয়ে যাচ্ছ...
সিদ্ধেশ্বরবাবু চোখ বুজলেন। তার কাউকে খোঁজার নেই আর। শুধু আলো তৈরি করতে হবে আরো... না হলে কে সাড়া দেবে তার প্রার্থনায়...
বললেন, আজ জেলেদের বস্তিতে যাই চলো... বাচ্চাগুলো কিরকম তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে যখন আমরা মন্দিরের দিকে যাই... চলো কিছু কিনে নিই... তুমি রেডি হও...
ব্রজবালার চোখ জলে ভরে এলো, আমিও ভাবছিলাম জানো... জগন্নাথের চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না..বাচ্চাগুলোর মুখ মনে পড়ত.... বলত লজেন্স দে...