প্রাণানন্দবাবু রিট্যায়ারের পর পরই পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরে ইস্তক ওনার মধ্যে উনি একটা বিশেষ পরিবর্তন খেয়াল করছেন। উনি এখন আলোর গন্ধ পান। প্রথম প্রথম ভাবতেন বুঝি অন্য কিছুর গন্ধের সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। এখন দেখছেন, তা না। সকালবেলা সূর্য্যের আলো জানলা দিয়ে ওনার বিছানায় এসে পড়লেই উনি সারা ঘর শিউলির গন্ধ পান। জ্যোৎস্নারাতে ছাদে বসে থাকতে থাকতে জুঁই-এর গন্ধে বিভোর হয়ে ওঠে ওনার মন। সব গন্ধ অবশ্য চিনতে পারেন না। যেমন টর্চের আলোর, টিউবের আলোর, ট্রেনের আলো, বাসের আলো। কিছু গন্ধ খুব ঝাঁঝালো, যেমন ট্রেনের, বাসের। টর্চের আলোর গন্ধটা টকটক। প্রদীপের আলোর গন্ধটা খুব মিষ্টি, কিসের মত গন্ধটা যেন, উনি মনে করতে পারেন না।
তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। মাঝে মাঝে ভাবেন এটা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে বিদেশের কোনো একটা বিজ্ঞান পত্রিকায় পাঠাবেন, কিন্তু যুক্তি জোগাড় করে উঠতে পারছেন না।
ইদানীং আরেকটা সমস্যা হয়েছে, উনি এখন আর যার তার বাড়ি যেতে পারেন না। এই সেদিন মজুমদারদের বাড়ি গিয়েছিলেন ওর নাতির জন্মদিনে। কিন্তু সন্ধ্যে পড়তেই যেই ওরা আলো জ্বালল প্রাণানন্দবাবুর গা পাক দিতে শুরু করল। মজুমদারদের অনেকগুলো অবৈধ ব্যবসা আছে, পাড়ার অনেকেই জানে। উনি ফিরে এলেন। এরকম বহু বাড়ি ওনার এখন আর যাওয়া হয় না।
অবশ্য বিপরীতটাও হয়। অনেক বাড়ির বাইরে দিয়ে যেতে যেতে এমন একটা মিষ্টি গন্ধ তাদের বাড়ির জানলা দিয়ে আসা আলোর সাথে বাইরে এসে পড়ে, যে উনি আর না গিয়ে থাকতে পারেন না সে বাড়ি।
এভাবে পাড়ার, বেপাড়ার বহু গরীব মানুষের সাথে ওনার ভাব হয়ে গেছে, আর অনেক বড়লোক ধনী মানী পরিবারের থেকে বেড়েছে দূরত্ব। যদিও কিছু ব্যতিক্রমও আছে। তবে তার সংখ্যা খুব কম।
সেদিন ভোরে উনি গঙ্গার ধারে বসে আছেন। সারা গায়ে শিউলির মত গন্ধ মেখে রোদ পড়েছে। হঠাৎ ওনার মনে হল কি করে হচ্ছে এগুলো!
আমাদেরও হয়, উনি চমকে উঠে তাকালেন চারিদিক। কাউকে দেখতে পেলেন না। ভাবলেন বুঝি মনের ভুল। চোখ বন্ধ করতে যাবেন, এমন সময় একটা টুনটুনি ওনার কাঁধে এসে বসল। প্রাণানন্দবাবুর কানের কাছে এসে বলল, আমরাও পাই
প্রাণানন্দবাবুর কি এক অপূর্ব আবেগে প্রাণ ভরে আসল। চোখ সজল হল।
তিনি বললেন, এ গন্ধটা আসে কোথা থেকে?
পাখি বলল, ভিতর থেকে। হৃদয়টা পরিস্কার হলেই।
পাখিটা উড়ে চলে যাওয়ার পর উনি উঠতে যাবেন, সামনের অশ্বত্থ গাছটা বলল, আরেকটু বসে যাও প্রাণানন্দ, দক্ষিণের বাতাস পারিজাতের গন্ধ নিয়ে রওনা দিয়েছে, আমি খবর পেলাম একটু আগে। এখুনি এসে পড়বে। দেখবে আলোরই শুধু গন্ধ নেই, গন্ধেরও আলো আছে। তোমার ভিতর অনেক দরজা খুলে দেবে সে গন্ধ, নতুন আলোতে।
লোকে রাস্তায় যেতে যেতে দেখল প্রাণানন্দবাবু অশ্বত্থগাছটাকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন, আর একটা টুনটুনি ওনার ঘাড়ে মাথায় খেলে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ এক দমকা দখিণা বাতাস কিছু ঝরা পাতা উড়িয়ে সব এলোমেলো করে দিল।
(ছবিঃ সুমন দাস)