পাড়ায় একেবারে ছি ছি পড়ে গেল।
"শেষমেশ কি না এই!"
"তাও কি না সাধুর সাথে!"
"বলি অমন শান্ত সদাশিব স্বামী থাকতে কি না...! ছি ছি..!"
উক্তিগুলো কার সে না বললেও চলবে। ওনার ছেলে মেয়েরা মুখ লুকিয়ে ঘরে বসে সকাল থেকে।
ওনার স্বামী মানে পরিতোষ আর অফিস জাননি আজ। ঘরে খিল লাগিয়ে খাটে শুয়ে। তার মাথার মধ্যে সাইক্লোন - আলো এটা করতে পারল! হ্যাঁ, গুরুজীকে বাড়িতে এনে ছিলাম আমিই। কিন্তু সে তো ব্যবসার উন্নতির জন্য। আর আলোকে যা যা করতে হয়েছে তাও তার সম্মতিতে, তন্ত্র মেনে। তা এটুকু সে সংসারের জন্য করবে না! তার ব্যবসার উন্নতি হলে এ সংসারে কে লাভবান বেশি হবে? সেই তো। তাই বলে গুরুর সাথে সে সম্পর্ক যজ্ঞস্থল থেকে অন্ত:স্থলে আনতে হবে! কি অনাচার!
বড়ছেলে এবার মাধ্যমিক দেবে, পরিমল। তার ঘেন্নায় গা জ্বলে যাচ্ছে। মা এটা কি করল? সারাদিন টিভিতে যা দেখায় সে তো তার বাড়িতেই হল! বাবা বার করে দিচ্ছেন না কেন মাকে! ছোটলোক কোথাকার!
মেয়েটা সাত বছরের ছোট পরিমলের থেকে। পারিজাত। মাকে সে কাঁদতে দেখেছে রাতের পর রাত। সে মায়ের পাশে শোয়। বাবা দাদার পাশে। রাতে সেও ঘুমোতো না, নড়ত না। পাছে মা জেগে যায়! কেন কাঁদত মা? আজ কি এমন হয়েছে? সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
পাড়ার হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, বিমলবাবু। অকৃতদার। সকাল থেকে গম্ভীর! পরিতোষের সমস্যাটা বিয়ের আগে থেকেই, তখন সবে সূত্রপাত। তাঁর মন দগ্ধাচ্ছে, "বার বার বারণ করেছিলাম, পরিতোষ বিয়ে কোরো না। তোমাদের কনজুগাল লাইফ সুখকর হবে না। দিন যত বাড়বে এ রোগ তত বাড়বে। শুনল না। হাজার গন্ডা ওষুধ গিলল। আরো এগিয়ে আনল রোগটাকে।"
যাকে নিয়ে এত কথা এত তোলপাড় সেই আলো চুপ করে খিল দিয়ে ঠাকুর ঘরে বসে। তার মন মাঝসমুদ্রের মত স্থির। সে জানে সে সমাজের চোখে দ্বিচারীণী আজ।
সমাজ?!
আলোর মুখে বাঁকা হাসির রেখা।
কোন সমাজ?
যে সমাজ অনায়াসে তাকে স্বামীর সজ্জা থেকে দেওরের সজ্জায় নিয়ে শোয়াতে পারে? বাড়ির বড়ছেলে নি:সন্তান হতে পারে না বলে! তাতে বংশের বদনাম হবে! ছি: ছি:! বংশের মুখে চুনকালি পড়বে যে। গ্রামের বাড়িতে খবর গেলে কোন সম্মান থাকবে মুখার্জী বাড়ির!
সেই তো।
সমাজ! আলোর দৃষ্টি বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠা প্রদীপ শিখার দিকে। মেয়ে মানুষের অসীম শক্তি, তাই সব কিছুর পরও সে সুস্থ ছিল। আর যেতোও বা কোথায়। বাপের বাড়ি তো ওই গ্রামেই, তার ওপর যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের আবার আত্মসম্মান! তাই মেনে নিয়েই ছিল একরকম।
ছেলে মেয়ে নিয়ে কাটছিল তো।
তারপর হঠাৎ একদিন স্বামী নিয়ে আসলেন তান্ত্রিক গুরুদেব ভৈরবজীকে, ওরফে নিশান্তকে। না, তান্ত্রিক বলতে যে রূপ মনে ভাসে সেরকম ছিলেন না উনি। আলোর ভাল লেগেছিল। একথা তার অন্তর্যামী ছাড়া কেউ টের পায় নি, আলো দিব্যি করে বলতে পারে। সে লুকিয়ে রেখেছিল তার মুগ্ধ চাহনি। মেয়েরা পারে।
কিন্তু তারপর? তার ভিতরের ক্ষুধার্ত আগ্নেয়গিরিকে কে জ্বালিয়ে সরে গিয়েছিল?
তার স্বামী!
সমাজ! ভন্ড সমাজ!
সমাজের কোন প্রাচীন পাপকে তার স্বামী টেনে আনেনি তার নিজের হৃত যৌবন উদ্ধারের আশায়? তার আর্থিক উন্নতির আশায়? জোর করেনি তাকে তন্ত্রসিদ্ধির জন্য নিশান্তর সাথে মিলিত হতে? তখন তাদের বিবেক, নীতি কোথায় ছিল? কোথায় ছিল এই শুদ্ধ নিষ্কলঙ্ক সমাজ?
তবে এও সত্যি, নিষ্ঠুর সত্যি! ততটা খারাপ তার লাগেনি তখন। অপমান লেগেছিল, সে নিজেকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুর্বার ক্ষুধার্ত হৃদয় কি আর নীতিকথা শোনে ঠাকুর! নিশান্ত'র চোখে সে দেখেছিল একজন মানুষকে। নিশান্ত তাকে ভালবেসেছিল। সেই প্রথম সে কোন পুরুষের স্পর্শে কুঁচকে যায় নি। সেই প্রথম, যে তার সর্বস্ব চেয়েছিল, তাকে চেয়েছিল।
আলো দিয়েওছিল সব উজাড় করে তাকে। নিশান্ত যে তাকেই চেয়েছিল! খন্ডিত করে না! প্রয়োজনে না! ভালোবেসে! হ্যাঁ হ্যাঁ ভালবেসে!
নিশান্ত অনেকবার বলেছিল তাকে বেরিয়ে আসতে তার সাথে, হতে নিরুদ্দেশ।
পারেনি দুটো মুখের দিকে তাকিয়ে, যাদের পৃথিবীর আলো সেই চিনিয়েছিল। আলোর সারা শরীর কেঁপে উঠল থর থর করে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে লুটিয়ে পড়ল ঠাকুর ঘরের আলপনা দেওয়া মেঝেতে।
"কোনটা পাপ ঠাকুর? ভালবাসাহীন কারোর প্রয়োজনীয় কাজের বস্তু হয়ে বাঁচা, না কারোর ভালবাসায় মানুষের সম্মান নিয়ে বাঁচা! সেই তো প্রথম বুঝিয়েছিল আমি একজন মানুষ, হা ঈশ্বর! আমার যে মন আছে আমি তো ভুলতেই বসেছিলাম ঠাকুর! আমি জানতামই না আমিও বেঁচে আছি, আমারও ইচ্ছা, সাধ আছে ঠাকুর! হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ভালোবাসি, ভালোবাসি ওকে, নিশান্তকে।"
আলোর চাপা কান্নায় ঠাকুরঘরের পুরোন কড়ি বরগা কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
যখন আলোকে বার করা হল তখন তার সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ। আত্মা আছে কি না জানি না। কিন্তু তার প্রাণ যে বিষের স্বাদ আজ পেল শরীরে, তা তার কাছে হাল্কা লাগল কি না বলতে পারি না, যে বিষ সে এতদিন সহ্য করে এসেছে তার কাছে। সবাই কাঁদল। বাতাস যেন কেঁদে কেঁদে ফিরছিল সবার কানের কাছে, আর বলছিল, "ভন্ড.. ভন্ড... ভন্ড.."
দিন গেল। সবাই ভুলেই গেল আলো নামে কেউ কোনোদিন ছিল। শুনতে পাই সেই ভৈরব নাকি আজ বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত। বাকি জীবনটা বৃন্দাবনে থাকবেন স্থির করে সেখানেই চলে গেছেন। তাঁর আশ্রমের নাম আলোকাশ্রম। কোন আলো?
(নামগুলো সব কাল্পনিক)