সৌরভ ভট্টাচার্য
18 February 2019
(এ লেখাটার আগে হয়ত একটা ভূমিকা লিখলে ভালো। কিন্তু কি সে ভূমিকা হবে? জানি না। হয়ত আমি বলতে চাইছি এ লেখাটা দর্শন আর গল্পের মাঝামাঝি কিছু। কিন্তু দর্শন বলার, বা লেখার মত কি ভাবনা আমার? জানি না। শুধু বলি, লেখাটা অন্যরকম তো অবশ্যই। আর অন্যভাবে আমি নিজেকে হয়ত প্রকাশ করতেও পারতাম না)
আমি এখন অটোর লাইনে। আমার ডিজিটাল ঘড়িতে সময় ৭.১৮। আমার সামনে তেরো জনের লাইন। আমার গন্তব্য বিধাননগর। আমার শার্টটার সাইজ ৪২, দাম ১৩০০/-, আমার প্যান্টের কোমর ৩৪, দাম ১৭০০/-, আমার ইনার দুটোর দাম দুটো মিলিয়ে ৮০০/- হবে। আমার চুলের রঙ কালো, সামনের দিকে বারগান্ডি করা। আমার ঘড়িটা fastrack, দাম ২৬০০/-, অনলাইন কেনা। ফোনটা আইফোন। জুতো বাটার, ১৩০০/-
আমি যাচ্ছি বিধাননগর। IT-তে কাজ করি, এখন Team-lead। আমার উচ্চতা ৫' ৬", গায়ের রঙ মিডিয়াম। আমার সামনে এখন পাঁচজন অটোর লাইনে। আমার অটোতে লাগবে ১৫ মিনিট, ট্রেন সময়ে আসলে বিয়াল্লিশ মিনিট, হেঁটে তেরো মিনিট। আমার বয়স আঠাশ বছর, ছয় মাস, দুই সপ্তাহ, চারদিন।
সবটা সময়ের অঙ্ক আমার কাছে। সময়ের ধারাবাহিকতাটাই আসল। যেমন এখন আমি অটোর লাইনে, এখন ৭.২৩। ক'জনের পরে, ক'টার সময় আমার সুযোগ ওঠার, আমার অটো থেকে নেমে স্টেশান যেতে কতটা সময় লাগবে, ট্রেনে উঠে কোথায় দাঁড়াব, কখন বাদামওয়ালা আসবে, কখন আমার সামনের মানুষটা সিট ছেড়ে উঠে যাবে, আমি বসব - এ সব একটা জটিল সময়ের অঙ্কের উপর নির্ভর করে। যে সময়ের সমীকরণ বহু সমান্তরাল ও আকস্মিক অন্যান্য সমীকরণের সাথে জড়িয়ে। যেমন যে মানুষটা সোদপুরে নামবে, তার ঘটনাপ্রবাহের সূত্র ধরে, সেই সূত্রেই আমার বসার সুযোগ। আমাদের যুক্তি কিভাবে কাজ করে? একটা algorithm উপর। যা যা input আছে সেগুলোকে ধাপে ধাপে ভেঙে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। এই হল আমাদের thought process, decision making।
আমি অটোতে এখন। কখনও ভেবেছেন, সময় নিজে একটা input। এটা ভাবা যায় না। কারণ আমরা নিজেরাই সময়ের মধ্যে। মহা কালচক্রে আমার অস্তিত্বটাও একটা বায়োলজিক্যাল, চেতনার ইনপুট। তবু, একটু নিজের কল্পনা শক্তিকে যদি কাজে লাগান, ভাবুন আপনি আর আমি সময়ের বাইরে। এবার সময়টাকে একটা input হিসাবে দেখুন। আপনি বলবেন সময় মানে কি? সংজ্ঞা চাইবেন না। সংজ্ঞায়িত করার অভ্যাসটা একটা মানবিক ভাবনার দুর্বলতা। সীমাবদ্ধতা।
সময় নিজে একটা ইনপুট, যেটা আগেও বললাম। এবার দেখুন সময় কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সে একটা ঘটনার ক্রমের বিন্যাস। যেমন এই ট্রেন আসার সময় নির্ভর করছে আগের ঘটনাগুলোর পারম্পরিক সজ্জাবিন্যাসের উপর। অর্থাৎ একটা ঘটনা অনেকগুলো ঘটনার সাথে জড়িয়ে। কিন্তু ঘটনা মানে সময় নয়। যদিও সব ঘটনা একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু সময় তবে কি? দেখুন আমি সংজ্ঞায় আসতে চাইছি, অর্থাৎ একটা ভাবনার পরিচিত ছন্দের পরিসরে ঢুকতে চাইছি। আপনি যদি বলেন সময় একটা মানবিক বোধ। আমি বলব, না, তবে carbon aging কি? সেটার তথ্যগুলো যদিও মানুষের সময়ের সাথেই কল্পিত, তবু সেই পরিবর্তনের একটা নির্দিষ্ট ছন্দ তো আছেই। তবে কি সেই ছন্দটাই সময়? যে ছন্দের তালের কথা নটরাজের কল্পনায়, "নৃত্যের তালে তালে"... আমার ব্যক্তিগত জীবনও সেই ছন্দের তালে প্রভাবিত, "মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে, লোকে লোকে ঘুরে এসেছি তোমার নাচের ঘূর্ণিতালে"।
অটোটায় একটা দক্ষিণভারতীয় গান চলছে। ভাষা বুঝছি না। আবেদনটা বুঝছি। আসলে কোনো কিছুই অকারণ, খামখেয়ালি নয় জানেন। একটা সুবিশাল algorithm-এর মধ্যে আমরা। এখানে data input infinite, সময়কেও infinite ধরুন, তার মধ্যে আমরা। অসীম বৈচিত্রময় সেই algorithm-এর প্রকাশ তখন। কোন মানবিক বোধ সে নৃত্যের ব্যঞ্জনায় নিজেকে মেলাতে পারে? পারে না। সে অসীমের মধ্যে লীন হয়। মানুষের হিসাবের পাতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংখ্যা, সেই যুগসিঞ্চিত প্রবল সংখ্যার বন্যায় ভেসে যায়। সে হিসাব হারিয়ে ভয়ে কেঁদে বলে, "আমি হারালুম"।
আসলে অনিশ্চিত বলে কিছু হয় না জানেন। ধরুন আপনি আপনার মনটাকে এই অসীম তথ্যের ভাণ্ডারের সাথে যুক্ত করতে সক্ষম হলেন। যেমন করে আপনি মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি নানা সূত্রের সমাধান করেছেন নিজের মননেই, এখানেও আপনি সেই ক্ষমতাটাই পেলেন। সেক্ষেত্রে যেহেতু আপনি infinite inpute-এর সম্বন্ধে জ্ঞাত, যেখানে সময়ও একটা input, তাই মহাকালের গণনাটাও আপনার নখদর্পণে। একটা পাতা কখন মাটিতে পড়বে, কিম্বা একটা তারা কখন খসে যাবে, আপনার কাছে আর অনিশ্চিত নয়, অর্থাৎ আপনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।
আমি এখন হাঁটছি, বিধাননগর স্টেশানের দিকে। এই যে মানুষগুলোর সাথে আমার ধাক্কা লাগছে, চোখাচোখি হচ্ছে, এ সবই ওই একই algorithm-র খেলায়। অর্থাৎ, chance , uncertainty শব্দগুলো শুধুই মানবিকবোধের সীমাবদ্ধতা! এগুলো আসলে ঘটেইছিল। সেই কৃষ্ণ যেমন অর্জুনকে বলেছিলেন, এরা আগে থেকেই মরে আছে, তুমি শুধু মারো।
আমি বিধাননগর স্টেশানে এখন। থিকথিক করছে ভিড়। আমি দুটো ট্রেন ছাড়ব। আজ পারমিতার সাথে date আছে। date মানে sex আমার কাছে। না, আপনি যা ভাবছেন তা নই আমি, আমি pervert নই। আমি conditioned। sex একটা existential factor আমার কাছে। এটা আমার চাহিদা না। এটাও আমি। খিদে, তেষ্টা, চিন্তা, এ সবের মত এই তাগিদটাও আমি। আমার সব চাইতে বেশি অসুবিধা আমার চিন্তার conditioning। আমি চাইলেও বেরোতে পারি না। আমরা কেউ বেরোতে পারি না। নৈর্ব্যক্তিকতাটা আমাদের কাছে অক্সিজেনহীন জায়গা। যৌনতা প্রাণের আদিমতম তাগিদ। প্রকৃতির নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় সর্বাধিক সফল ও ত্রুটিমুক্ত প্রাণজ প্রেরণা। হয়তো সবচাইতে বেশি নির্ভরযোগ্য আবেগ, শক্তিশালীও। কিন্তু intelligence তা নয়। সে এখনও হাজার সীমাবদ্ধতা নিয়ে ক্রমোন্নতির পথে। আমার স্মৃতিকোষ তার অস্ত্রাগার। কিন্তু সে স্মৃতিও তো ত্রুটিমুক্ত নয়। সে নিজের খেয়ালে নিজের পছন্দানুযায়ী তথ্যকে বেছে বেছে আপন ভাণ্ডারে রাখে সযত্নে। তাই স্মৃতি মানে অচেতনে নির্বাচিত কিছু পরম্পরাহীন তথ্য। তাই সেই ত্রুটিযুক্ত ইনপুটে ত্রুটিযুক্ত ফলাফল, মানবিক চিন্তার অ্যালগরিদমে।
আমি রাণাঘাট লোকালের চতুর্থ কামরায়, তৃতীয় দরজার বাঁদিকের প্রথম সারির তৃতীয় সিটের সামনে। কল্যাণী নামব আজ। পারমিতার ফ্ল্যাটে যাব। অরগ্যাজম, অহং চেতনালুপ্ত অনুভব। আত্মপরিচয় মানে আমিবোধ, অহং। অহং-এর নাশ যেখানে সেই অনুভব অনেকটা ভ্রান্তিহীন। অহমিকা নিজের পছন্দানুসারে ঘুঁটি সাজায়। নিজের জেতার তাগিদে ছলনার আশ্রয় নেয়। ছলনা মানে ভুল ইনপুট। ভুল ইনপুট, ভুল ফলাফল। ভ্রান্ত বিচার। ভ্রান্তি মানে বিচ্ছিন্নতা। বাস্তবতা থেকে, যা ঘোর, মায়া। "আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে"... "আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ"।
কল্যাণী। আমি নামব। পারমিতা নেই, থাকছে না, টেক্সট করল। ওর বাবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। কিন্তু আমি ফিরব না। ওর ফ্ল্যাটেও যাব না। প্ল্যাটফর্মে সারারাত কাটাব। তবে কোনো চিন্তার স্রোতে, মতলবের যুক্তির চাল চালব না। চিন্তা মানে ভাষা, আমি কথা বলব না। একটা অতৃপ্ত যৌন তাড়না মনের মধ্যে দাপাচ্ছে। হয়ত স্বমেহনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যাক। আবেগ আর যৌনতা কাছাকাছি। যৌনতার তাগিদ যাদের কম যাদের আবেগও কম। ওটা একটা driving force. যদি intelligence -এর সাথে না যায় তবে ধ্বংসাত্মক।
আবেগের input প্রকৃতি অগম্য করে রেখেছে। ওটা administrative zone of mother nature. ডারউইনের natural selection? হয়তো বা। আবেগ আর চেতনার যোগবন্ধন কোথায়? আবেগের সুক্ষ্মতম রূপই কি চেতনার দিকে এগিয়ে এসে নিজেকেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয় মাঝে মাঝে? এ রহস্য। প্রাণ আর মনের এ আদিম রহস্য। প্রাচীন দ্বন্দ্ব। "ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা, বাম হাতে চুর্ণ কর পাত্র"। প্রাণের যে সদ্যোজাত সন্তান, সে স্বজ্ঞা, intuition। অজানা সমুদ্রে কম্পাস। কতটা নির্ভুল? জানা নেই। রহস্য মানে অনিশ্চয়তা না, দুর্গমতা। বর্ণান্ধর কাছে যেমন সবুজ মাঠ, বা নীলাকাশ।
শেষ ট্রেন চলে গেছে। স্টেশান ফাঁকা। হালকা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। মোবাইল অফ করে দিলাম। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। অন্ধকার থিক থিক করছে। আকাশ পরিষ্কার। তারাগুলো বালির মত চিকচিক করছে। মহাকালের সমুদ্রতীরে আমি। "আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে"। চারদিকে মানুষের আওয়াজ নেই। কুকুর ডাকছে এখানে ওখানে। রাস্তায় নেমে এলাম। আমি স্মোক করি না। রাস্তায় একা হাঁটলে পুলিশে বিরক্ত করতে পারে। করুক। একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে। রাস্তাটা সামনে সোজা একটা ঘুমন্ত শরীরের মত শুয়ে। গাছগুলো সার দিয়ে। লক্ষকোটি বছরের পুরোনো পৃথিবী। আসলে পুরোনো শব্দটাই ভীষণ মানুষের। প্রতিটা অণু-পরমাণুর সংঘর্ষে, সংযোগে একটা জায়মান symphony এই সৃষ্টি। এর কোনো উদ্দেশ্য নেই। অর্থ নেই। প্রেম ছাড়া, বিস্ময় ছাড়া একে অনুভব করা যায় না। কাকে ভালোবাসা, কোনো নারীকে? একটা নগ্ন শরীরের উপর আকর্ষণ? প্রেম মানে বিস্ময়ের প্রতি আকর্ষণ। বিস্ময়ের মধ্যে আত্মমগ্ন হওয়া। বিস্ময়হীন প্রেম অভ্যাস। মিথ্যা। বিজ্ঞান তাই কাব্য, যখন বিস্ময়। নারী তাই কাব্য, যখন বিস্ময়। এ মহাবিশ্ব তখন কাব্য, যখন বিস্ময়।
আমার বুক ঠেলে কান্না পাচ্ছে। কারোর জন্যে না। কিন্তু সব কিছুর জন্যে। যে চাষীর হাতের ফসলে আমি লালিত তার জন্য। যে তাঁতির হাতের পোশাকে আমার শরীর আবৃত তার জন্যে। যে অগুনিত মানুষের বোধের, খোঁজের অক্ষরে আমার প্রাণ, মন, বোধ জাগরিত তাদের জন্য। আমি হাঁটছি। এমন অন্ধকারেই হাঁটছি। কোথাও যাওয়ার জন্য নয়। বিস্ময়ের তাগিদেই আমি হাঁটছি। কিছুর খোঁজ নেই আমার। শুধু তাগিদ, গভীর তাগিদ। গভীর প্রেম। গভীর বিস্ময়। অনন্ত। একটা বোঝা না বোঝায় মেশা অস্তিত্ব, আমি - মহাকাল আর এ মহাবিশ্ব। অসীম অ্যালগরিদম। "তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী"।